কালাম ফয়েজী
বিপ্লবের ফলে ফ্রান্স কর্তৃত্বের অভাব অত্যন্ত প্রকটরূপে দেখা দেবে, আসবে স্থিতিহীনতা। এজন্য আগমন ঘটবে একজন জনপ্রিয় অধিনায়কের; সেই অধিনায়ক জানবেন কি কৌশলে সৈন্যদের আনুগত্য লাভ করা যায়। আকর্ষণ করা যায় সবার দৃষ্টি। সেনাবাহিনী ব্যক্তিগত কারণে তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে। এরূপ অবস্থা যখন সৃষ্টি হবে, সেনাবাহিনীতে যখন এই ব্যক্তি তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন তখন তিনি হবেন তোমাদের প্রভু। এই প্রভু হবেন তোমাদের রাজা, তিনিই হবেন তোমাদের প্রজাতন্ত্রের ভাগ্য নিয়ন্তা”। কথাগুলো বলেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের অনেক আগে ব্রিটিশ চিন্তাবিদ এডমন্ড বাক। (পৃ: ১৮, নেপোলিওঁ বোনাপার্ট, রণনীতি ও কূটনীতি)।
নেপোলিওঁ বোনাপার্টের জন্ম কর্সিকা দ্বীপের মধ্য শ্রেণির এক সাধারণ পরিবারে। স্বাধীনতা সংগ্রামে কর্মিকাবাসীর তৎপরতা দেখে মুগ্ধ হয়ে ফরাসি দার্শনিক রুশো এক সময় লিখেছিলেন, “আমার কেন যেন আশঙ্কা হচ্ছে যে, এই দ্বীপ সমগ্র ইউরোপকে হতবাক করবে”। বোনাপার্ট রুশোর সে আশঙ্কা বাস্তবে রূপায়িত করেন সমগ্র ইউরোপব্যাপী তার সংগ্রামশীল কর্মকা-ের মাধ্যমে।
ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয় ১৭৮৯ সালে আর নিপোলিওঁ বোনাপার্টের জন্ম হয় তার মাত্র ২০ বছর আগে ১৭৬৯ সালে কর্সিকায়। কর্সিকা হলো একটা দ্বীপ। পূর্বে এ দ্বীপ জেনোয়ার অধীন ছিল। বোনাপার্টের জন্মের এক বছর আগে ফ্রান্স দ্বীপটি কিনে নেয় জেনোয়ার কাছ থেকে। তখন থেকে এ দ্বীপ ফরাসি সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। বোঝাই যাচ্ছে কর্সিকা ফ্রান্সের মূল ভূখ-ের বাইরের একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ।
১৭৮৫ সালে বোনাপার্ট যখন ফরাসি গোলান্দাজ বাহিনীতে সাব লেফটেনেন্ট পদে নিযুক্ত হন তখন এই যুবসৈনিকের বয়স মাত্র ১৭ বছর। ওই বয়সেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন বীরসুলভ ব্যক্তিগত স্বপ্ন বাস্তবায়নের। কখনো ভাবতেন, তার জন্মস্থান কর্সিকা হবে একটি স্বাধীন দেশ। তিনি হবেন সে দেশের স¤্রাট। তিনি দিনে সৈনিক হিসেবে কাজ করতেন, রাতে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তেন বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, অংকশাস্ত্র, ভূগোল ইত্যাদি।
তিনি বাল্যবয়স থেকেই ছিলেন এক অভাবনীয় স্মৃতিশক্তির অধিকারী নাটকীয় ব্যক্তিত্ব। রাজনীতি-কূটনীতি উভয় বিষয়ে তিনি পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনি শিক্ষা লাভ করেন পারির সামরিক স্কুলে। শৈশবেই তার চরিত্রে পরিলক্ষিত হয় কর্সিকার গৌরব ও গাম্ভীর্যের ভাবধারা। তার সাথে যুক্ত হয় স্বকীয়তা, নির্ভীকতা, শান্ত ও অটল প্রকৃতি। যুবক বয়সেই বোনাপার্ট যে প্রতিভাদ্বীপ্ত কর্মশীলতা, প্রভূত্বব্যঞ্জক মেজাজ ও নেতৃত্বসুলভ ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেন, তাতে তার শিক্ষক এবং সতীর্থরা খুবই মুগ্ধ হন। উঁচু, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব, উন্নত রুচি ও চিন্তা-চেতনার জন্য তিনি সকলের প্রশংসা লাভ করেন।
১৭৮৯ সাল থেকে ফ্রান্সকে অনেক বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে হয়। বিপ্লব উত্তর রাজনৈতিক, সামাজিক অনেক দ্বন্দ্বে বিতর্কে-কোন্দলে-হানাহানিতে ফ্রান্স একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বিপ্লবীদের কোন্দল, দলাদলি, ব্যক্তিগত রেষারেষি ও চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের ফলে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এতে বিপ্লবের ওপর থেকে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে অনেকে। কেউ কেউ পুনরায় রাজতন্ত্রেই ফিরে যেতে চায়। এমনি দেশব্যাপী মহাসংকট চলাকালে ফ্রান্সের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে নিপোলিওঁ বোনাপার্টের। নিপোলিওঁ মূলত ছিলেন একজন সৈনিক। সামরিক জীবনে অতি অল্পকালের মধ্যেই তিনি অনন্য সাধারণ ও উচ্চাভিলাষী অধিনায়ক রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
১৭৯৬ সালে বোনাপার্ট ইতালি আক্রমণের দায়িত্ব পান। একজন সৈনিক হিসেবে ইতালি অভিযান বোনাপার্টের জীবনে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ রণাঙ্গনে তিনি তার অভাবিত সামরিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। প্রথমবারের মত এই যুবক মাত্র ২৭ বছর বয়সে অধিনায়কত্ব করেন ইতালির রণাঙ্গনে। একের পর এক সাফল্যের মাধ্যমে তিনি পরিচয় রাখেন তার তারুণ্যসুলভ সৌর্যবীর্য, উৎসুক্য ও আন্তরিকতার। সর্বক্ষেত্রে তিনি তার কৌশলগত নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। তার ত্বরিৎ তৎপরতা, কর্মমুখরতা ও অসীম সাহসিকতা দেখে তার প্রতিপক্ষ শুধু হতবাকই হয়নি, তাকে ঘায়েল করার সমস্ত ধ্যানধারণাই পরিত্যাগ করে।
এই বিপ্লবী অধিনায়ক শুধু ইতালির রণক্ষেত্রেই তার অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেননি, কালে তিনি ইউরোপব্যাপীও ফ্রান্সের প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে স্বাক্ষর রাখেন। পরবর্তীতে পারির রাজনৈতিক মঞ্চে এ শক্তিমান ব্যক্তির আবির্ভাবে ফরাসি বিপ্লব নাটকে আরেকটি অংকের সংযোজন হয়। তার মাধ্যমে বিপ্লব পূর্ণতা লাভ করে। তিনি ছিলেন একদিকে বিপ্লবী আদর্শের প্রতিভূ, অপরদিকে ছিলেন বিপ্লবাত্মক বিশৃঙ্খল কর্মকা-ের বিপক্ষে শৃঙ্খলার প্রতীক। তার অসাধারণ মেধা, চরিত্র, ইচ্ছাশক্তি ও দুঃসাহসিকতা, অভাবিত কর্মস্পৃহা, সাংগঠনিক দক্ষতা, ক্ষিপ্রতা, অন্তঃদৃষ্টি ও অমননীয় সংকল্পের ফলে তিনি এক মহান রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন।
রাষ্ট্রনায়ক হয়ে তিনি ক্ষমতার দম্ভে বিকৃত হয়ে যাননি, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতি কৃষি-শিল্প ও বাণিজ্যিক উন্নয়নেও অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিশেষ কোন পরিসরে তার সংস্কারমুখী পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, জনহিতকর কর্ম, চারু ও শিল্পকলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-; বিশেষ করে নাটক, সংবাদপত্র, রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা, সরকারি প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, সঙ্গীত, সাহিত্য সব কিছুতেই তিনি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন এবং তাতে সফলও হন।
সামাজিক সাম্যের পাশাপাশি আর্থিক সমৃদ্ধি লাভের ফলে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে তারা মোটেই বিচলিত হননি। প্রকৃতপক্ষে ইহজাগতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনে তার ইতিবাচক তৎপরতার ফলে তাকে ফরাসি বিপ্লবের প্রকৃত উত্তরসূরি বলা যায়। জনহিতকর কর্মেও বোনাপার্ট একজন অতি উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক রূপে প্রমাণ রাখেন। জনকল্যাণ ও সেবামূলক কর্মে অবদান রেখে তিনি মূলত ফ্রান্সকে স্থায়ীভাবে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করেন। এসব কাজের মধ্যে ছিল ফসলি জমিতে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা, অধিক ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থাকরণ, পুল ও রাস্তাঘাট নির্মাণ। আধুনিক ফ্রান্স আজ যেসব জমকালো রাজপথের অধিকারী তার বেশিরভাগ তৈরি হয় বোনাপার্টের আমলে। ফ্রান্সে তিনি ২২৯টি প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করেন। আজও ওই রাস্তাগুলোই ফ্রান্সের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।
তিনি বহু খাল খনন ও সংস্কার করেন, বাঁধ ও পুল নির্মাণ করেন। সমুদ্রবন্দর ও পোতাশ্রয় সম্প্রসারিত করেন। এর ফলে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বিস্তৃতি লাভ করে।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার খ্যাতির মূল কারণ হচ্ছে তার অসীম কর্মস্পৃহা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি। ফরাসি জাতির কাছে তিনি ছিলেন একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত ও সতত অনুপ্রেরণার উৎস। অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে তিনি যে ব্যাপক আকারে সংস্কারমূলক কর্মকা- বাস্তবায়ন করেন তাতে ওই দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বিশেষ করে বুর্জোয়া, ব্যবসায়ী, মেহনতী মানুষ, সাধারণ কৃষক-শ্রমিক এবং ধর্মীয় ক্যাথলিক সকলে তার সমর্থনে এগিয়ে আসে।
বলা চলে বোনাপার্ট এমন এক সময়ে ফ্রান্সের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে উপস্থিত হন যখন দীর্ঘকালব্যাপী বিপ্লব চলার পর সমগ্র দেশে দুর্নীতি, অরাজকতা, অযোগ্যতা ও অর্থনৈতিক সংকট জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আরো বাড়িয়ে তোলে। এরূপ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সারা ফ্রান্সের নাগরিকদের মধ্যে এমন প্রত্যয় জন্মে যে, একমাত্র সামরিক বেশে সজ্জিত ব্যক্তির আবির্ভাব হলে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করা যাবে। ফরাসি জনমানুষের মধ্যে হতাশা ব্যাপক আকার ধারণ করে। ফলে তিনি যখন দৃশ্যপটে চলে আসেন তখন মূলত দেশের জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
সম্ভবত তার মধ্যে বিচক্ষণতার অভাব ছিল না, জনতার মধ্যে তার উপস্থিতি ছিল চল্লিশ হাজার সৈন্যের শক্তির অনুরূপ। (ঋবষরী গধৎশযধস রহ ঘবি ঈড়সনৎরফমব গড়ফবৎহ ঐরংঃড়ৎু, ভল্যুম-৪, পৃ: ২৮৯)। তিনি বুঝতে পারেন শুধুমাত্র সামরিক কর্মকা-ের মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে না। মানুষকে দোড়গোড়ায় যেতে হলে সামরিক বিজয় লাভের পাশাপাশি প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও তাকে সমান দক্ষতা দেখাতে হবে। এজন্য কনসাল হিসেবে দায়িত্ব পাবার পর থেকে তিনি দৈনিক ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেন। তার পনের বছরের শাসনামলে তিনি আশি হাজার চিঠি পাঠান বা নির্দেশ জারি করেন। সামরিক শাসকের পাশাপাশি তিনি ছিলেন সবিশেষ বাগ্মীতার অধিকারী। তিনি তার অনুরাগী ও অনুগামীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ শ্রম আদায় করে নিতে পারতেন। সবসময় তার মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেতো। তিনি সদা ব্যস্ত থাকতেন এবং দেশসেবায় অন্যদের ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করতেন।
নেপোলিওঁ বোনাপার্টের ওপর যতটা অধ্যয়ন করেছি এবং তার জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জেনে আমার কাছে মনে হয়েছে তার নাটকীয় উপস্থিতি, তার সামরিক মেধা এবং প্রশাসনিক প্রতিভা সবই আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তুলনীয়। বোনাপার্ট যেমন বিপ্লবী সরকারের দ্ব্যর্থহীন সমর্থক ছিলেন, তেমনি জিয়াউর রহমানও স্বাধীনতা অর্জনকারী শক্তির একজন অগ্রগণ্য যোদ্ধা ছিলেন। জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন এবং স্বাধীনতা লাভের পর যথানিয়মে ব্যারাকে ফিরে যান। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার দেশের শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং স্থিতি আনয়নে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি, যেমন পারেননি ফ্রান্সের বিপ্লবী জেকোবিন সরকার।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা এলেও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত দেশে নিয়মিত সরকার গঠনে ছাব্বিশ দিন অপেক্ষা করতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে ফিরে প্রবাসী সরকার ভেঙ্গে দেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন এবং তিনি নিজে তার অধীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছরে যারা দেশ পরিচালনায় দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, এক ধাক্কায় তাদের সরিয়ে ফেলায় অদক্ষ অপরিণামদর্শী-অনভিজ্ঞ লোকজন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করাতে যে অরাজক-অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেটা ছিল বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভয়াবহ। ১৯৭২-এ শেখ মুজিবের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে অরাজকতা বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, খুনাখুনি, চুরি ডাকাতি, হানাহানি, অভাব, হাহাকার, গুম-হত্যা-মারামারি। কেন উদ্ভব হলো এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির? এর অনেক কারণ থাকতে পারে। সবচেয়ে বড় কারণ নেতৃত্বের দুর্বলতা, চৌকস ও দক্ষ নেতৃত্বের অপর্যাপ্ততা। ফজলুল কাদের চৌধুরী, খান-এ-সবুর, আতাউর রহমান খান, মোহন মিয়ার মতো নেতাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভুল থাকলেও নেতা হিসেবে তারা অনেক দক্ষ ছিলেন। শেখ মুজিব গ্রেটলিডার হিসেবে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে যতটা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন, ক্ষমতা গ্রহণের পর তেমন দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে পারেননি। তার ওপর চাটুকার মোসাহেব সুবিধাভোগী লোকদের দাপটে তাজউদ্দিনের মতো লোকরাও পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে অরাজকতা বিশৃঙ্খলা-জুলুম-নির্যাতন, গুম-হত্যা, চুরি-ডাকাতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এসব প্রশমনে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতে জনগণ আরও রুষ্ট হয় এবং মুজিব সরকারের কবল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দেশ-জনতা পথ খুঁজতে থাকে। তার অনিবার্য ফল ছিল ’৭৫ এর দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকা- এবং তার পরবর্তী ৭ নভেম্বরের জনতা ও সামরিক বাহিনীর যৌথ বিপ্লব ও সংহতি, যার পথ বেয়ে ক্ষমতার পাদপীঠে চলে আসেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জিয়ার আবির্ভাব কোন নাটকীয় ঘটনা নয়, বরং মুজিব সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যর্থতা ও অরাজকতার ফসল। এছাড়া জিয়াউর রহমানের অতীত বীরত্ব এবং কর্মময় জীবনের নিষ্ঠা-সততা সম্পর্কে তার সহকর্মীসহ অনেকের ধারণা ছিল। ফলে দেশের সাধারণ মানুষ জিয়াকে পেয়ে তার বক্তব্য শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এক বাক্যে মানুষ তাকে সমর্থন জানায় এবং দৃঢ়ভাবে এ আশা পোষণ করে যে, আর যা হোক দেশ এখন রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হলো। দেশ আর কখনো সিকিমের মতো করদরাজ্যে পরিণত হবার সম্ভাবনা নেই।
দেশে একদিকে ভয়াবহ আকাল অপরদিকে সরকারের প্রশাসনিক অরাজকতা, আওয়ামী নেতা-পাতি নেতাদের খাই খাই ত্রাস এবং জাসদসহ বাম-নেতাদের মুজিববিরোধী প্রচার-প্রপাগান্ডা ও আন্দোলন, সব মিলিয়ে দেশব্যাপী এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে, মানুষ ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠেছিল এবং এর থেকে বেরিয়ে যাবার পথ খুঁজছিলো। যেমন খুঁজেছিলো ষোড়াশ লুই এর দুঃশাসন থেকে রক্ষা পাবার জন্য ফ্রান্সের লোকজন। কিন্তু মুশকিল হলো ষোড়শ লুই এর পর জেকোবিন যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন তাতে জনগণ শান্তিতে ছিল না। চারদিকে হত্যা, গুম, অরাজকতা, অস্থিরতা ও নির্দিষ্ট ‘আদেশ দানে ঐক্য’ ছিল না। শত শত বছর যে দেশের মানুষ রাজশাসনে অভ্যস্ত তারা কি রাতারাতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে পারে? পারে না। তারজন্য সময় লাগে, রাজনৈতিক, সামরিক ও পেশাগত স্থিরতা- স্থিতিশীলতার দরকার হয়। কিন্তু জেকোবিনের দল সে স্থিরতা কায়েম করতে না পারায় দেশের নাগরিকদের বড় একটা অংশ রাজতন্ত্রেই ফিরে যেতে চাচ্ছিল। আবার কেউ কেউ অরাজকতা ত্রাস ও স্বেচ্ছাচার থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য মনে মনে রাজার মতই এমন একজন আদর্শবান একনায়কের আশা করছিল, যে একনায়ক দেশকে তাৎক্ষণিক বিপর্যয় ও অস্থিরতা থেকে রক্ষা করবেন। সেক্ষেত্রে নেপোলিয়নের মতো একজন সেনানায়কের আগমনেকে সকল মত-পথ ও পেশার মানুষই স্বাগত জানিয়েছিল, যেমন জানিয়েছিল সাহসী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে।
এমনিতেই ১৯৭৫-এর আগে আওয়ামী দুঃশাসনের জন্য শেখ মুজিবুরের ওপর জনগণ রুষ্ট ছিল। তার ওপর ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের জন্যও দেশের আপামরজনতা ভীষণ অনিশ্চয়তায় ভুগছিল। তখন এমন একটা অবস্থা ছিল যে, তখন না ছিল কারো জীবনের নিশ্চয়তা না, কর্মের নিশ্চয়তা, না ইজ্জত আব্রুর নিশ্চয়তা। গ্রামেগঞ্জে এমনিতেই দুর্ভিক্ষের হাহাকার বিরাজ করছিল, তার ওপর কেউ যদি এক দুই সের চাল বা অন্য বাজার সদাই নিয়ে বাড়ি ফিরতো, দেখা যেতো সেই দরিদ্র লোকটি ওইটুকুন দ্রব্য নিয়েও নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারতো না। তার চেয়ে অভাবী মানুষরা ডাকাত সেজে দুর্বল লোকের মালামাল কেড়ে নিয়ে যেতো।
ঠিক এমন নির্মম অনিশ্চয়তার দিনে জিয়া এসে যখন হাল ধরলেন দেশের মানুষ তখন আশায় বুক বাঁধল। মনে মনে ভাবলো, যাক বাবা জানটা তো বাঁচলো। দেশটাতো রক্ষা পেলো। জিয়া যখন সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে বললেন বা নানান শ্রেণি পেশার মানুষকে যার যার কাজে নিয়োজিত হতে বললেন, কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করলো না। সকলে তার কথা বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত হয়ে গেল। (চলবে)
লেখক : কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন