রমজান মাসে রোজাদারের কাছে প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দের। কারণ এ মাসে আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের বারিধারা পৃথিবীতে বর্ষিত হয় সারাদিনের উপবাসের ক্লিষ্ট যাতনার অবসানে যখন ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন আর তার সয় না। দিনের শেষে ইফতারের অপেক্ষা করা সত্যি এক অদ্ভুত আনন্দের মাত্রা জোগান দেয় রোজাদারদের। ইফতারের সময় রোজাদার অপার প্রশান্তি অনুভব করে থাকেন এবং ইফতারের পর মনোদৈহিক ও আধ্যাত্মিক তৃপ্তির এক অনাবিল সুখানুভূতিতে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান বলে মনে করে থাকেন। রমজানের পাঁচটি সুন্নতের দ্বিতীয়টি হলো ইফতার। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার বান্দাদের মধ্যে তারা আমার বেশি প্রিয়, যারা দ্রুত ইফতার করে’ (তিরমিজি শরিফ)।
ইফতার শব্দটি আরবি ‘ফাতর’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ভঙ্গ করা বা ছিঁড়ে ফেলা। এখানে ‘ফিতর’ যে অর্থ প্রদান করে, তা হচ্ছে এমন খাদ্য যা দ্বারা রোজা ভঙ্গ করা হয়। আরবি শব্দ ইফতারের অর্থ হলো রোজা ত্যাগ করা। একজন রোজাদারের যথাসময়ে ইফতার করা একান্ত প্রয়োজনীয়। সারাদিন রোজা পালন করে যথাযথভাবে সময়মতো ইফতার করার গুরুত্ব অত্যধিক। সূর্যাস্তের পর বেশি দেরি না করে ইফতার করা উত্তম। বৈধ কারণ ছাড়া বিলম্বে ইফতার করা মকরুহ। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি ওই ব্যক্তিকে সর্বাধিক ভালবাসি, যে ইফতারের সময় হওয়া মাত্র ইফতার করে নেয়’ (তিরমিজি)। ইফতারের কিছুক্ষণ আগে থেকে খাদ্যসামগ্রী সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা সুন্নাত। কারণ, এ সময়ে মানুষ খুবই ক্ষুধার্ত থাকে এবং একমাত্র আল্লাহর ভয়ে খাবার সামনে হাজির থাকা সত্তে¡ও মুখে তোলে না। এতে আল্লাহ খুব খুশি হন। কারণ, ইফতারের সময়টা হলো বিনয় ও আল্লাহর জন্য ধৈর্য্য ধারণের চরম মুহূর্ত। এ সময় জাহান্নাম থেকে মুক্তিদানের মুহূর্ত।
নিজে ইফতার করার পাশাপাশি অন্যকে ইফতার করানোর মধ্যে প্রচুর সওয়াব ও বরকত নিহিত রয়েছে। রোজাদার নিজেও ইফতার করবে এবং সম্ভব হলে অন্যকেও এতে শরিক করবে। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে ব্যক্তির গোনাহ মাফ হবে এবং একইসঙ্গে রোজাদার ব্যক্তির সমপরিমাণ সওয়াব সে-ও পাবে।’ সাহাবিরা রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী, আমাদের মধ্যে এমন অনেক লোক আছে, যারা অন্যদের ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। জবাবে রাসুল (সা.) বললেন, ‘কাউকে পেট ভরে ইফতার করাবে- এমন কোনো শর্ত নেই। কেউ রোজাদার ব্যক্তিকে একটি মাত্র খেজুর বা পানি দ্বারা ইফতার করালেও সে সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। এতে রোজাদারের সওয়াবের কোনো কমতি হবে না বরং আল্লাহ নিজের রহমতের ভান্ডার থেকে এ সওয়াব প্রদান করবেন।’ একটি কথা উল্লেখ করা যুক্তিসঙ্গত মনে করি, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, এতে অসাম্যের কোনো রেশ নেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রমজানের কিংবা অন্য কোনো দিনে কার্টুন ভর্তি করে ইফতার প্রদানের কোনো যৌক্তিকতা ইসলাম ধর্মে নেই। এতে খাবারের অপচয় বাড়ে। সামাজিক অসাম্যের রেশও দেখা দিতে পারে। যদি সওয়াবের মনোভাব নিয়ে কেউ আত্মীয়তা রক্ষা করতে সামান্য পরিমাণ ইফতার সামগ্রী কারও বাড়িতে নিয়ে যান, এতে অসুবিধার কিছু দেখা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় রমজান মাসে আত্মীয়ের বাড়িতে ইফতারি প্রদানের নামে বর্তমানে যেন নিয়ম চালু রয়েছে। মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে কার্টুন বোঝাই ইফতার পাঠানো, এসব ইসলামের নামে অপসংস্কৃতি ছাড়া কিছু নয়। এই প্রথায় ধনী পিতার সাময়িক আমোদ ও আদরের মেয়ের প্রতি ভালবাসা মনে হলেও ইফতারি প্রদানের তৈরি ট্রেন্ডের জন্য বা অত্যাচারিত হচ্ছেন সে-সব দরিদ্র বাবা, অন্যের দেখাদেখি বাধ্য হয়ে মেয়ের সুখের জন্য ধারদেনা করে রেওয়াজগুলো মানতে বাধ্য হচ্ছেন। গরিব পিতা কার্টুন বোঝাই ইফতারি পাঠাচ্ছেন মেয়ের স্বামীর বাড়িতে মেয়ের সুখের জন্য। নিভৃতে তারা অত্যাচারিত হচ্ছেন। সুতরাং, ইসলামের নামে এসব বাড়বাড়ন্তে সওয়াবের পরিবর্তে গোনাহগার হওয়ার আশঙ্কা অবজ্ঞা করা যায় না। তাই আমাদের এসব অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন মনে করি। কারণ, কুরআন ও হাদিসবহির্ভূত কোনো কিছু ইসলাম গ্রহণ করে না আর এসব নিঃসন্দেহে সামাজিক অসাম্যের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়।
শরিয়তের নির্দেশ মতো ইফতার করলে এতে যথেষ্ট কল্যাণ নিহিত আছে। এ সময় আল্লাহর কাছে বান্দাহর দোয়া কবুল হওয়ার উত্তম সময়। ইফতার যে কোনো মিষ্টিদ্রব্য দিয়ে করা উচিত। রমজান মাসে রাসুল (সা.) মাগরিবের আজান হলে কয়েকটি ভেজা খেজুরের মাধ্যমে ইফতার করতেন। ভেজা খেজুর না থাকলে সাধারণ শুকনো খেজুর খেতেন। এর ব্যতিক্রম হলে সামান্য পানি-ই ছিল রসুল (সা.)-এর ইফতার। সুতরাং, এসব সামগ্রী দিয়ে নবী (সা.)-এর মতো আড়ম্বরহীন ইফতার হওয়া উচিত। যদি এসব কারো কাছে না থাকে, যে কোনো প্রকার হালাল খাদ্যই হচ্ছে ইফতার। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসূলে করিম (সা.) প্রতিটি রোজার মাঝরাতে পানাহার, ইফতার বর্জনকে নিষেধ করেছেন। তখন একজন লোক আরজ করে বলল, ওহে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি যে এমনটি করেন। উত্তরে হুজুর (সা.) বললেন, তোমরা আমার মতো কে আছ? হ্যাঁ, সত্যি আমি ওই রকম রোজা রাখি। কেননা, আমার দয়াময় আল্লাহ আমাকে খাওয়ান আর পানও করান।’ সুতরাং, এই হাদিস থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, ইফতার রোজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর সুষ্ঠুতার মধ্যে সিয়ামের পূর্ণতা নির্ভর করে।
পরিশেষে বলব, রমজান মাসে সিয়াম পালনের অর্থ হচ্ছে শুধু দিনের বেলা খাবার পরিহার নয়, বরং নিজেকে বিভিন্ন প্রকার পাপাচার থেকে বিরত রাখার অঙ্গীকার। রোজা সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই প্রতিদান প্রদানের অঙ্গীকারবদ্ধ। আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দা সহজে পৌঁছার বড় মাধ্যমই হলো রোজা। রোজা পালনের ফজিলত ও প্রতিদান দেন আল্লাহ নিজেই। অন্য সব আমলের সওয়াব ফেরেশতাদের মাধ্যমে পৌঁছান কিংবা আমলের সওয়াব পূর্বনির্ধারিত থাকে। কিন্তু রোজাই একমাত্র আমল, যার সওয়াব আল্লাহ নিজেই দান করবেন। কেননা, মানুষ সব আমল তার নিজের জন্য করে আর রোজা আল্লাহর জন্য। মানুষের সিয়াম সাধনা জগতের মালিকের জন্য। আল্লাহর কথা প্রিয় নবীর কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছে, ‘সিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশগুণ’ (বোখারি)। তাই রমজান মাসের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করে আল্লাহ সবাইকে রোজার প্রতিটি আমল উত্তমভাবে পালন করার সামর্থ্য দিন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন