শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

এদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে

এইচ এম আব্দুর রহিম | প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভির সংবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রায় চোখে পড়ে ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা বিষয়ক খবর। এ সংক্রান্ত খবর পড়তে পড়তে মানুষের মন বিষিয়ে উঠেছে রীতি মতো। অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃটান্ত মূলক শাস্তি না হওয়ায় শতকরা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ অশ্লীলতায় আইয়ামে জাহেলিয়াতের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। ধর্ষণের হাত থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্রী থেকে শুরু করে চার-পাঁচ বছরের কোমলমতি শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ও ধর্ষণ করার ঘটনা তো সমাজে অহরহ ঘটে চলেছে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মান সম্মানের ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানায় না। তখন বিষয়টি লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকে। এরপরও যে খন্ডিত চিত্র সমাজের কাছে ভেসে উঠে তা ভয়ানক।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির রিপোর্টে ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণের কথা বলা হয়। বাস, প্রাইভেটকার, অটোরিকশা ও ট্রাকে এসব ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গণপরিবহনের চালক হেলপার সহ সহযোগীরা মিলে ৯টি গণ ধর্ষণ ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটায়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া পরিসংখ্যান থেকে জানাযায়,গত ৫ বছরে বাংলাদেশে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষনের শিকার হয়েছে। ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে ২৭৮ জন কে। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ শিশু কিশোরী। এর মধ্যে ৬ থেকে ১২ বছরের মেয়ে বেশী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। চলতি বছর জানুয়ারীর ১৮ দিনে ২৩টি ধর্ষণের চেষ্টার খবর সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ জন শিশু কিশোর। ধর্ষনের পর হত্যার শিকার হয় এরাই বেশি। এছাড়া ধর্ষণের পর শতকরা ৯০ শতাংশ ঘটনা লোক লজ্জার ভয়ে অনেকে প্রকাশ করে না। কি এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আমরা দিনাতিপাত করছি। তবে আমাদের মধ্যে মস্তবড় এক গলদ রয়েছে-রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সদিইচ্ছার ভিতরে। সেই গলদের নাম বিচারহীন সংস্কৃতি। তুচ্ছ কারণে ধর্ষনের মত ঘটনা তখনই সংঘটিত হয়,যখন রাষ্ট্রে বিচারহীনতার পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। এ সমাস্যাটি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ কারণে যে,এই দেশে ধর্ষনের বিচার করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের দুর্বলতা ও দীর্ঘ সূত্রতা এখন প্রকট।
আইন প্রয়োগকারীদের একটি অংশ ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি বিরূপ ধারণা প্রকাশ করেন। তারা নারীটির ব্যক্তিগত চরিত্র সর্ম্পকে সন্দেহ পোষণ করেন। ফলে ধর্ষণের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করার জন্য যতটা আন্তরিকতার সাথে আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন,বাস্তবে তা ঘটতে দেখা যায় না। শুধু আইন প্রয়োগকারীদের মধ্যে নয়,অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ফলে কঠোর আইন থাকার সত্তে¡ ও প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। এ অবস্থায় গণপরিবহণে নারী নির্যাতন ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। রুপা গণধর্ষণ-হত্যা সহ আগের ঘটনাগুলোর যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো এবং গণপরিবহনের মালিকরা যদি শ্রমিকদের যথাযথভাবে সচেতন করতে পারতেন তাহলে এ ধরণের ঘটনা কমে আসতো। গত বছর বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমে চলন্ত বাসে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টায় ২০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ২০১৩ সালে দুটি, ২০১৫ সালে চারটি, ২০১৬ সালে তিনটি, ২০১৭ সালে ৬টি, ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৭টি।
আইন সালিশের জরিপে যে পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবে এই সময়ে ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৯ হাজারের বেশী। দেশে প্রতিদিন ১১টি করে ধর্ষণের মামলা হচ্ছে। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত কম। নায্য বিচার থেকে অনেকে বঞ্চিত। ক্ষমতা আর অর্থের দাপটে অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে বিচার না পেয়ে আদালতের সিড়ি চোখের পানিতে ভিজাচ্ছে অনেকেই।
আজ দেখা যাবে নুসরাতের হত্যাকারীদের বিচারের দাবীতে সভা, সমাবেশ, মানব বন্ধন হচ্ছে। তার পর অন্যন্য ঘটনার মত হারিয়ে যাবে। এভাবে আর কত নুসরাতের জীবন দিতে হবে এ দেশের মানুষ তা জানে না।
মেয়েরা আর কত যৌন হয়রানির শিকার হবে? দেশের ছাত্রীদের কে যৌন হয়রানি থেকে উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করা আবশ্যক। যৌন হয়রানি বন্ধে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাই কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিঠি’ গঠন করে তার কার্যক্রম জোরদার করা সহ বিভিন্ন নির্দেশনা বাস্তবায়নের সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ কমিটি গঠনের নির্দেশনা থাকলে কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সালমা আলী ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশু যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিক নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে একটি রিট আবেদন করেন। শুনানী শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট রায় দেন। এ রায়ে হাইকোর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি’ নামে কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। হাইকোর্টের এ রায়ের পর বাংলাদেশ বিশ্ব বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন জিসিইউ একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়ে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এখন যৌন নির্যাতন বন্ধে মাধ্যমিক থেকে বিশ্ব বিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি কমিটি গঠনে রাষ্ট্রের কঠোর নির্দেশ প্রয়োজন। হাই কোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, কমিটিতে ৫ জন সদস্য থাকবে।এই কমিটির বেশীর সদস্য হবে নারী। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দুজন সদস্য নিতে হবে। সম্ভব হলে একজন নারী কে কমিটি প্রধান করতে হবে। যাতে মেয়েরা তাদের অভিযোগ গুলো মহিলাদের কাছে পেশ করতে পারে।
সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি শিক্ষা বর্ষের পাঠদান কার্যক্রমের শুরুতে এবং প্রতিমাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওরিয়েন্টশনের ব্যবস্থা করতে হবে। হাইকোর্টের এই নির্দেশনাটি আইনে রুপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসাবে কাজ করবে এবং সব সরকারী বে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। হাই কোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক যে কোনো ধরনের নির্যাতন যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফি, যে কোন ধরনের অশালীন চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলা ও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে।
এদিকে বিচারধীন কিছু মামলার দ্রুত সুরাহার ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্ট বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে নির্দিষ্টভাবে নারী নির্যাতন মামলা নেই। দেশের প্রায় ১০ ধরনের ট্রাইবুনাল করা সব ধরনের মামলারর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাই উচ্চ আদালতের নির্দেশে সব থেকে বেশী স্থগিত থাকছে। বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৫১টি বিচারধীন নারী নির্যাতন মামলার মধ্যে ৯৪৯টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।
সারা দেশে সব ধরণের ফৌজদারি অপরাধের দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে তুলনায় দেখা যায়,নারীদের মামলা গুলোর বিচার হতে বেশী সময় লাগে। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ থেকে ২৩ শে মের একটি দৈনিকের ছয় পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিদেনে দেখানো হয়, দেশে সব অপরাধের মামলায় দন্ড লাভের গড় হার ১৫ শতাংশের বেশি। অথচ ঢাকাতেই নারী নির্যাতনের ছয়টি অপরাধের মামলায় সাজার হার ৩ শতাংশের কম। এই পরিসংখ্যান কিন্তু প্রকান্তরে নারীর মামলাতেই উচ্চ আদালতের স্থগিতকরণের হারটা বেশি, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
লেখক: সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন