শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মাছ বিক্রেতাদের বিক্ষোভ

এবার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

সাগরে মৎস্যখনি সুরক্ষা চায় সরকার। প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার উপর চলছে নিষেধাজ্ঞা। এর প্রতিবাদে জেলেদের পর এবার রাস্তায় নামলেন মাছ বিক্রেতারা। ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন তারা।

তাদের সাথে অবরোধ বিক্ষোভে অংশ নেন ফিশিং বোট মালিক ও শ্রমিকেরা। বন্দরনগরীর প্রবেশ পথ কর্ণফুলী সেতু এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধের ফলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশের হস্তক্ষেপে এক ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক পানি সীমায় (ইইজেড) প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ ও কাঁকড়াসহ কঠিন আবরণযুক্ত সামুদ্রিক প্রাণীর (ক্রাস্টাসিয়ান্স) জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং মাছের মজুদ সংরক্ষণ, সুষ্ঠু ও সহনশীল আহরণ নিশ্চিত করার স্বার্থে ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর এ সময় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে।

তবে ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ছিল ৪৫ দিন। এ বছর তা বাড়িয়ে ৬৫ দিন করা হয়েছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে গত ২০ মে থেকে সাগরে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে মাছ ধরা বন্ধ আছে। নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হবে ২৩ জুলাই।

সরকারি তরফে বলা হচ্ছে, এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার একান্ত অর্থনৈতিক পানি সীমায় সামুদ্রিক মাছের মজুদ বাড়াতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রজনন মৌসুমে অবাধে মাছ ধরা হলে স্বীকৃত মৎস্যখনি হিসেবে পরিচিত এ পানি সীমায় মাছের আকাল দেখা দেবে। এতদিন ধরে প্রজনন মৌসুমে কেবল যান্ত্রিক ট্রলারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রাখা হলেও চার বছর পর এবারই ছোট নৌযানসহ সব ধরনের নৌযানগুলোকে এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।

আর এ কারণেই ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিটি জেলে পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। এরপরও জেলে এবং মৎস্যজীবীরা আন্দোলনে নেমেছে।

সর্বশেষ গতকাল কর্ণফুলী সেতু এলাকায় সড়ক অবরোধ করে মাছ বিক্রেতা এবং ফিশিং ট্রলার মালিক ও শ্রমিকেরা। সকাল সাড়ে ১০টায় কর্ণফুলী সেতুর গোলচত্বরে মানববন্ধন শুরু করেন শ’খানেক মাছ বিক্রেতা ও নৌযান মালিক। সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণকারী বোট মালিক সমিতি যৌথভাবে এই কর্মসূচির আয়োজন করে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কিছুক্ষণ পর মানববন্ধনে কয়েক হাজার মাছ বিক্রেতা, ফিশিং বোট মালিক ও শ্রমিক সমবেত হয়। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের সময় কর্ণফুলী সেতুর উপর গাড়ির দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। বাকলিয়াসহ আশপাশের এলাকায়ও যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভ শেষেও যানজট এক ঘণ্টারও বেশি স্থায়ী ছিল।

বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন বলেন, ১১টার দিকে মানববন্ধনে লোক সমাগম বেড়ে যায়। এ সময় তারা সড়কের উপর এসে বিক্ষোভ শুরু করলে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। তবে তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়েছি। সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকার বলেন, ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। অথচ সরকার এখন জেলেদের সাগরে যেতে দিচ্ছে না। আমরা যারা মাছের ব্যবসা করি, আমাদের ঘরে এখন অভাব-অনটন। এজন্য আমরা রাস্তায় আসতে বাধ্য হয়েছি।
তিনি বলেন, স্টিলবডি ও কাঠবডির ফিশিং ট্রলারের ক্ষেত্রে প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। কারণ এসব ট্রলার নির্বিচারে বড় মাছের পাশাপাশি জাটকা, পোনা মাছ আহরণ করে। কিন্তু উপকূলীয় জেলেরা ছোট ছোট নৌযানে নির্দিষ্ট কিছু মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে।

এবার এসব জেলেরাও মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। সমাবেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। তিনি বলেন, অবিলম্বে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। আমরা ৭২ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। দাবি না মানলে, আবার আমরা রাজপথে নামব। মৎস্যজীবীদের সবার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আন্দোলন করা হবে। ইলিশের প্রজনন মৌসুমেও ২২ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকে, সেটা আমরা মেনে নিয়েছি। আষাঢ় মাসে ইলিশ ধরার মৌসুম শুরু। এখন আমাদের সব বোট বসে আছে।

এর আগে গত রোববার সীতাকুন্ড উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে দেড়ঘণ্টা বিক্ষোভ করেন নগরীর পতেঙ্গা থেকে সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট পর্যন্ত ৩৮টি জেলেপল্লীর বাসিন্দারা। তাদের দাবি, ছোট নৌকা ও জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাখা যাবে না। পরে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক তাদের নিয়ে বৈঠক করে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান। নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে মীরসরাইসহ বিভিন্ন এলাকার জেলেরা ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ডিসিদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

তবে সরকার এ নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি বাস্তবায়নের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ সুরক্ষায় এ নিষেধাজ্ঞার কোন বিকল্প নেই। গত বছরের আগস্টে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহায়তায় নরওয়ের অত্যাধুনিক গবেষণা জাহাজ আরভি ড. ফ্রিডজফ নেনসেন বঙ্গোপসাগরে মৎস্য সম্পদ নিয়ে গবেষণা ও জরিপ পরিচালনা করে। বাংলাদেশ সীমায় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ বিপন্ন হওয়া প্রসঙ্গে তারা উদ্বেগজনক কিছু তথ্য দেয়। মূলত তাদের ওই গবেষণার পর সরকার মৎস্য সম্পদ সুরক্ষায় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।

বাণিজ্যিক ট্রলারের তুলনায় আর্টিসান (যান্ত্রিক/অযান্ত্রিক) নৌযানে কম মৎস্য আহরণ করা হয়। আর তাতে প্রজনন মৌসুমে মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়না বলে মৎস্যজীবীদের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে তাও মানতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে বাণিজ্যিক ট্রলার অর্থাৎ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার নৌযান মাত্র ২৫৫টি। আর এর বাইরে আর্টিসান নৌযানের সংখ্যা ৬৭ হাজার ৬৬৯টি। মৎস্য দপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭-১৮ মৌসুমে বাণিজ্যিক ট্রলার দিয়ে মাছ ধরা হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন।

অন্যদিকে আর্টিসান নৌযানে মাছ ধরা পড়ে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। তাছাড়া ছোট নৌযানগুলোতে প্রজনন মৌসুমে মা মাছের পাশাপাশি ব্যাপকহারে রেণু পোনাও ধরা পড়ে। আর এ কারণে সব ধরনের মাছ ধরার নৌযানকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে সাময়িক অসুবিধা হলেও সামুদ্রিক মৎস্যখনি সুরক্ষিত হবে

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন