মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লাইফস্টাইল

খাদ্য ও পুষ্টির সন্ধানে

ডা: মাও: লোকমান হেকিম | প্রকাশের সময় : ১৩ জুন, ২০১৯, ৯:৪৪ পিএম

ক্ষুদ্র ও গরিব বাংলাদেশের হাজারো সমস্যার মধ্যে অন্যতম মারাত্মক জাতীয় সমস্যা হলো অপুষ্টি। আর্থিক অনটন, খাদ্য সংকট, পুষ্টি জ্ঞানের অভাব ও কুসংস্কার হলো এর মূল কারণ। মা ও শিশুরা হলো অপুষ্টির সহজ ও নির্মম শিকার। বিদেশী বিশেষজ্ঞ ব্রাডফিল্ড লিখেছেন, বাংলাদেশের অন্তত অর্ধেক লোকের মধ্যে পুষ্টিহীনতা রয়েছে। পুষ্টি উপাদানের অভাবে বিভিন্ন বয়সের লোকদের মধ্যে নানারকম রোগবালাই দেখা দেয়। সময়মত এসব রোগের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিলে দৈহিক ও মানসিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ দমনের জন্য প্রতিদিন পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে হলে একজন ব্যক্তির জন্য সুষম খাদ্য নির্বাচন, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও পুষ্টিমূল্য বজায় রেখে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া অর্থনৈতিক অবস্থা, খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির উপরও পুষ্টি অনেকটাই নির্ভর করে। 

খাদ্যের কয়েকটি উপাদান যেমন-শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করাই হলো সুষম খাবার । শর্করা শরীরে শক্তি ও কার্যক্ষমতা যোগায়। চাল, গম, যব, আলু, মিষ্টি আলু, কচু, চিনি, মধু, ঘুড় ইত্যাদিতে প্রচুর শর্করা পাওয়া যায়। প্রতি গ্রাম শর্করা থেকে ৪ কিলো ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়।
প্রোটিন হলো দেহ গঠন ও ক্ষয় পূরণকারী খাদ্য। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ডাল, বরবটি, সিম, মটরশুঁটি ইত্যাদি দেহ গঠনে সহায়তা করে। প্রতি গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। চর্বি বা ফ্যাট দেহের কর্মক্ষমতা বজায় রাখে এবং ত্বক সুন্দর ও মসৃণ রাখে। সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, তিলের তেল, ঘি মাখন, চর্বিযুক্ত মাছ, মাংস, ডিমের কুসুম ইত্যাদি চর্বি জাতীয় খাদ্য। প্রতি গ্রাম চর্বি থেকে ৯ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়।
পানি শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। দিনে কমপক্ষে ৮-১০ গøাস পানি পান করা দরকার। এছাড়া বিভিন্ন ফলের রস, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা দরকার। আঁশ দেহের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন নিয়ন্ত্রণ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, অন্ত্রনালীর সুস্থতা বজায় রাখে। খাদ্যের আঁশ উদ্ভিজ খাদ্য থেকে পাওয়া যায়। যেমন-লাল আটা, যব ভুট্টা, যবের ছাতু, সীমের বীচি, ডাল ও ডালজাতীয় খাদ্য, খোসাসহ ফল যেমন-কালোজাম, আঙ্গুর, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি ও সব ধরনের শাকসবজি।
খনিজ লবণ যেমন-ফসফরাস, লৌহ, আয়োডিন, জিংক যা দেহ গঠন, ক্ষয় পূরণ পরিপোষণ, দেহের শারীরবৃত্তিয় কাজ করে। আয়োডিন গলগÐ রোগ প্রতিরোধ করে। লৌহ রক্তস্বল্পতা দূর করে হাত ও দাঁতের গঠন মজবুত করে। জিংক মানসিক বৃদ্ধি ও হাড়ের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবুজ ও রঙিন শাক-সবজি, পাকা তেতুঁল, সামুদ্রিক মাছ, আয়োডিনযুক্ত লবণ ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ পাওয়া যায়।
ভিটামিন এ, ডি,ই,কে, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, সি সব রকমের সবুজ ও রঙিন শাক-সবজি, ফল, টক জাতীয় ফল, ডিম, দুধ, কলিজা, ছোট মাছ, লেবু, চা ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য। ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘ডি’ রিকেট রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ত্বকের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘সি’ স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু, মা ও বৃদ্ধরা পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক ও মানসিক বিপর্যয় ডেকে আনে। শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবে পেটের অসুখ, হাম, নিউমোনিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি না ঘটার কারণে আত্মকেন্দ্রিকতা, অবসাদ, ব্যক্তিত্বহীনতা দেখা যায় এবং মেধাশক্তি বিকশিত হতে পারে না। ফলে এসব ছেলেমেয়ে অলস ও উদাসীন, পরনির্ভর নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। শিশুর জন্য জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধই যথেষ্ট এবং ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পুষ্টিকর পরিপূরক খাবার দিতে হবে। সেই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে খাদ্য পরিবেশন করা হয়। তাছাড়া সঠিক রান্নার পদ্ধতি, নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা সবই স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকে প্রভাবিত করে। মারাত্মক পুষ্টিহীন শিশুদের শুধু, ডাল, আলু, সবুজ তেল দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি খাইয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। শিশুর পুষ্টির সাথে সাথে বাড়ন্ত ও কৈশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের পুষ্টির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক-সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন চুড়ান্ত। তাই পুষ্টির চাহিদাও এ সময়ের পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল। এ বয়সে মেয়েদের অপুষ্টি বেশি দেখা যায়। এ বয়সে কিশোর কিশোরীদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও ক্যালোরির চাহিদা পূরণ করতে হয়। পরিমিত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, বিশুদ্ধ পানি, নিয়মিত শারীরিক শ্রম, বিশ্রাম, খেলাধূলা ইত্যাদি বিষয়ের উপরও নজর দিতে হবে। মায়ের পুষ্টি শিশুর তুষ্টি। অর্থাৎ সুস্থ ও স্বাস্থ্যবতী মাই কেবলমাত্র স্বাস্থ্যবান সন্তানের জন্ম দিতে পারে।
পুষ্টিহীন মায়ের সন্তানের জন্মকালীন ওজন কম হয় এবং অসুস্থ, হাবাগোবা, রুগ্ন হয়ে জন্মায়। পরবর্তীতে নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়। গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী অবস্থায় মায়েদের খাবারের প্রয়োজন সাধারণ অবস্থার চেয়ে বেশি থাকে। এ সময় প্রয়োজন অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রন, জিংকসমৃদ্ধ খাবার খেতে হয়। অনেক সময় পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে পুষ্টির অভাবে নিজের চাহিদার, ঘাটতির সাথে সাথে সন্তানও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ঘাটতি নিয়ে জন্মায়। মাকে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন রঙিন শাকসবজি, ফল, টক জাতীয় ফল, পানি ও পানি জাতীয় খাবার প্রয়োজন অনুযায়ী খেতে হবে। তাছাড়া এ সময় চিন্তামুক্ত ও আনন্দভাব নিয়ে থাকতে হবে। অনেক সময় কুসংকার ও ভ্রান্ত ধারণা মায়ের অপুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে বৃদ্ধ বয়সেও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য পুষ্টির চাহিদা রয়েছে । বয়স বাড়লে কাজ করার ক্ষমতা ও খাবারের চাহিদা কমে যায়। হৃৎপিÐের কার্যক্ষমতা কমে যায়, রেচনতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়, দাঁত-হাড়ের সমস্যা ও বাত-ব্যাধি দেখা দেয়, পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়, রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এ বয়সে সাদা আটা, চাল, চিনি, ময়দা ইত্যাদি খাবার কম খেতে হবে। এ সময়ে পানি ও পানিজাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। হজমে সহায়ক, কোষ্ঠকাঠিন্য রোধক, বাত ও ওজন নিয়ন্ত্রক খাবার খেতে হবে। লাল আটা, বিভিন্ন আঁশ জাতীয় শাক-সবজি, ফল, চর্বিহীন মাছ-মাংস ইত্যাদি খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে হাঁটতে হবে। না হলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। বয়স চল্লিশের পর থেকে ডিমের কুসুম, ঘি, মাখন, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাছ, মাংস শর্করা জাতীয় খাদ্য খাওয়াকমাতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে ক্যালসিয়াম ও লৌহের অভাব বেশি দেখা যায়। দুধ (সর তুলে), দুধের তৈরি খাবার, পনির পায়েস ইত্যাদি খাওয়া যায়। পুষ্টির সমস্যার জন্য অজ্ঞতা ও অসচেতনতাও দায়ী। বাজারের টিন ও প্যাকেটজাত খাবার থেকে বাড়িতে তৈরি খাবার অনেক বেশি পুষ্টিকর। যে দেশের জনগণের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা যত ভালো, সে দেশ তত বেশি উন্নত। সুষম পুষ্টিকর খাবারই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারে। তাই পরিমিত ও নিয়মিত আহার, শারীরিক ব্যায়াম, বিশ্রাম, নিদ্রা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। তাই পুষ্টি সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করে তোলা আপনার আমার সকলের দায়িত্ব। সুস্থ সবল জীবন চান-সুষম খাবার রোজই খান।
চিকিৎসক-কলামিস্ট
মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন