ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষির। উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অংশে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়েছে ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির আমন ধান। এর বাইরে ধানের চিটা পড়ার আশংকাও রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে তরিতরকারি- শাকসবজি ও মাছের উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনিতেই এবার আমনের আবাদ কম হয়েছে, ফলে উৎপাদন কম হবে বলে আগে থেকেই আশংকা করা হচ্ছে। আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৯ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। বাস্তবে আবাদ হয়েছে ৫৬ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টরে। এতে উৎপাদন কমবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ২৫ লাখ টন। সিত্রাংয়ে উৎপাদন ক্ষতি হতে পারে আরো অন্ত ১০ লাখ টন। সবমিলে যে ক্ষতিটা দাঁড়াবে, সেটা বিশাল। এতে খাদ্যনিরাপত্তা বড়রকমে ঝুঁকিতে পড়বে। উল্লেখ করা যেতে পারে, খাদ্য মজুদের পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। গত কয়েক মওসুমে ধান-চাল সংগ্রহলক্ষ্য অর্জিত হয়নি। খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং দরিদ্র্যের সহায়তায় স্বল্পমূল্যে সরকারিভাবে যথেষ্ট পরিমাণ চাল বিক্রীও করা হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই মজুদ কমেছে। পক্ষান্তরে আমদানির মাধ্যমে মজুদ বাড়ানোর চেষ্টাও সফল হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়া হলেও চাল আমদানি তেমন একটা বাড়েনি। চালসহ খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চÑ প্রায় ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সব কিছুর দাম যথেচ্ছ বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে খাদ্যাভাব, দারিদ্র, পুষ্টিহীনতা ও মানসিক বিপর্যয় সীমা ছাড়াতে বসেছে। উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানির মাধ্যমে অবিলম্বে খাদ্যের নিরাপদ মজুদ গড়ে তুলতে না পারা, খাদ্যাভাবই বাড়বে না, দেশ দুর্ভিক্ষের মুখেও পড়তে পারে। বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতিও অত্যন্ত নাজুক। খরা-বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়েছে বা কমে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ খাদ্য পরিস্থিতিকে আরো ঝুঁকিতে নিক্ষেপ করেছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্যের আমদানি-রফতানি বা অবাধ চলাচলে নজিরবিহীন সংকট দেখা দিয়েছে। সবমিলে যে অবস্থা, তাতে আগামী বছর বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশে খাদ্যোৎপাদন যে কমবে, সেটা ফাও-ও বলেছে। বলেছে, এ বছর অন্তত ০.০৩ শতাংশ উৎপাদন কমবে। খাদ্যনিরাপত্তার হুমকিতে থাকা ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। উৎপাদন কমলে এ অবস্থানের যে অবনমন ঘটবে, সেটা বলাই বাহুল্য। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর আসলে বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করা যায়। তবে শর্ত হলো, আমদানি করার মতো অর্থ থাকতে হবে, খাদ্যও থাকতে হবে। ২০০৮ সালের দিকে বিশ্বে যখন খাদ্য সংকট দেখা দেয়, তখন বর্ধিত মূল্য দিয়েও খাদ্য কিনতে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশেরও এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। এবারের অবস্থা ভিন্ন। এবার আমদানি করার মতো অর্থও নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমন একটা পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করাও সম্ভব হবে না। বৈদেশিক মুদ্রার অভাব বা ডলার সংকটে খাদ্যসহ জরুরি আমদানি ব্যহত হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ানোর সুযোগ-সম্ভাবনাও কমে আসছে। ইতোমধ্যেই খবর পাওয়া গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার সকল উৎসেই ভাটার টান ধরেছে। রফতানি আয়, প্রবাসী আয় ও উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড় সবই কমেছে। ৮০ শতাংশের বেশি রফতানি আয় আসে গার্মেন্টপণ্য থেকে। গার্মেন্টপণ্যের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। কিন্তু ওই দুই বাজারে প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। সেপ্টেম্বরে গার্মেন্টবাজারে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছিল ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। অক্টোবরে সেটা ২০ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। এমন আশংকাই প্রকাশ করেছেন বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ। এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণ যে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্বিপাক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মন্দা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যতদিন বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশেষ করে যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে ততদিন বিশ্বের অর্থনৈতিক অধঃগতি ও নাজুক অবস্থা থেকে উঠে আসা অসম্ভব। যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। তার প্রভাব বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সকল কিছুর উৎপাদনের ক্ষেত্রে পড়ছে। বাংলাদেশ এ প্রভাবের বাইরে নেই। জ্বালানি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রায় পুরোপুরি বিদেশনির্ভর। ফলে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর প্রতিক্রিয়া পণ্যমূল্য, উৎপাদন ও রফতানিতে পড়ছে। বস্ত্রশিল্পের মালিকরা ক’দিন আগে বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের কারণে তাদের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা নিরবছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ চায়। এজন্য বাড়তি মূল্য দিতেও রাজি। বস্ত্রশিল্প ও গার্মেন্টশিল্প পরস্পর নির্ভরশীল। এর কোনো একটিতে সংকট দেখা দিলে অন্যটিও সংকটে পড়ে। রফতানি আয় ধরে রাখতে বস্ত্র ও গার্মেন্ট শিল্পের সার্বক্ষণিক সচলতা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রবাসী আয় প্রতি মাসেই কমছে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে অনেক কমেছে। উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড়ের প্রবাহও অত্যন্ত নি¤œগামী। বৈদেশেক মুদ্রার নিরাপদ মজুদ না থাকলে আমদানিই নয়, উন্নয়নকাজ চালানো, দায় পরিশোধ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বাধা ও বিভ্রাট দেখা দেয়।
বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিও দুর্ভিক্ষের আশংকা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ যাতে খাদ্যাভাব বা দুর্ভিক্ষের শিকার না হয় সেজন্য তিনি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাকিদ দিয়েছেন। সকল খালি জায়গায় খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। তার এ আহŸান অত্যন্ত যৌক্তিক, বাস্তবিক ও সময়ানুগ। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে খাদ্যশস্যসহ মাছ, পল্ট্রি, তরিতরকারি, শাকসবজি ও ফলফলারীর উৎপাদন বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, খাদ্যপণ্য বলতে শুধু চাল ও গমই বুঝায় না, আরো অনেক কিছুই খাদ্যপণ্যের অর্ন্তগত। কাজেই, কৃষিতে উৎপাদনের একটা জোয়ার তৈরি করতে হবে। কৃষি, খাদ্য, বাণিজ্য ইত্যাদি মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে বসে একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও উপায় নির্ধারণ করতে হবে এবং কাজে নেমে পড়তে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়ে উৎপাদন বিপ্লবে শরীক হতে পারে। একইসঙ্গে গণমুখী কর্মসূচী, উৎপাদনমুখী প্রকল্প, বিনিময়মূলক কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একদিকে খাদ্যসংস্থান, অন্যদিকে কর্মের ব্যবস্থা করতে পারলে খাদ্যাভাব বা দুর্ভিক্ষ রোধ করা সহজ হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন