বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ এখনো। কারণ, দেশের বেশিরভাগ মানুষের সংশ্লিষ্টতা এখনো কৃষিতেই। গত জুলাই মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮৫% কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট। উপরন্তু জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪%। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কৃষি ভিত্তিক শিল্প খাত যুক্ত করা হয়নি। এটা করা হলে কৃষি খাতের অবদান আরও অনেক বেড়ে যাবে। অর্থাৎ দেশে কৃষি খাতের অবদান এখনো সর্বাধিক। তবুও এই খাতে অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে। কারণ, প্রতিবছরই কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপক হারে, তথা অতীতের তুলনায় পাঁচগুণ হারে! এ ব্যাপারে গত ১৬ আগস্ট এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘স¤প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএসএআইডির অর্থায়নে এবং ন্যাশনাল ফুড পলিসি ক্যাপাসিটি স্ট্রেনদেনিং প্রোগ্রাম এর আওতায় এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৯৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৯ হেক্টর কমে দাঁড়ায় ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪১ হেক্টরে। কিন্তু এর মাত্র ১০ বছরে ২০১০ সালে ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর কমে মোট কৃষি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৭ হেক্টরে। বর্তমানে তা ৫ লাখ হেক্টরের নিচে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ০.১৩৭% হারে কমলেও ২০০০ থেকে ২০১০ সাল মেয়াদে ওই হারের পাঁচগুণের বেশি ০.৭২৮% হারে কমেছে। দেশে কৃষি জমি হ্রাস পাওয়ার কারণ হচ্ছে: দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরিকল্পিত আবাসন, নগরায়ণ, শিল্পায়ন। যেখানে খুশি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। স্থাপন করা হচ্ছে শিল্পকারখানা। ব্যক্তিগত বাড়িঘর কৃষি জমিতে তৈরি হচ্ছে। যেমন: প্রতিবছর আবাসন খাতে ৩০ হাজার ৮০৯ হেক্টর, নগর ও শিল্পাঞ্চলে ৪ হাজার ১২ হেক্টর এবং মাছ চাষে ৩ হাজার ২১৬ হেক্টর জমি যুক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে জনসংখ্যা। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে’। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ন্যাশনাল রিসার্স গ্রান্ড এডমিনিস্ট্রেটর নূর আহমেদ খোন্দকারের অভিমত হচ্ছে: ‘বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এ ধরনের গবেষণা হয়েছে। ফসলি জমি কমার কোন গবেষণা না থাকায় এর আগে সঠিক তথ্য নিয়ে বিভ্রান্ত হতো। কিন্তু এখন গবেষণায় ফসলি জমি হ্রাস পাওয়ার যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। অধিক ফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন না হলে এরই মধ্যে ফসলি জমি হ্রাসের প্রভাব পড়ত খাদ্য নিরাপত্তায়। তারপরও ফসলি জমি কমে আসার এই হার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি’। স্মরণীয় যে, ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে শিল্পাঞ্চল ও আবাসন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ ব্যাপারে ২১/৭/১৯ তারিখে প্রকাশিত এক দৈনিকের খবরে প্রকাশ, ‘৩০ বছরের মধ্যেই বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠতে চলেছে চাঁদে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, চাঁদই মেটাবে মর্ত্যলোকের অনেক অভাব। উন্নয়নের গতির সঙ্গে ছুটতে একসময় এই চাঁদ ছাড়া আর কোনও গতিই থাকবে না হয়তো। এরই মধ্যে নাসা চাঁদে মানুষের বসতি স্থাপনের বেশ কয়েকটি নকশা তৈরি করেছে। সেই মতো কাজও এগিয়ে নিচ্ছে তারা’। হয়তো এর স্বল্প সময় পরই মঙ্গলে ও অন্য গ্রহেও শিল্পাঞ্চল ও আবাসন গড়ে তোলা হবে।
কৃষি জমি হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি খুবই আশংকাজনক। তাই এ ব্যাপারে অনেক আগেই সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তা হয়নি। অর্থাৎ দেশের কৃষি জমি রক্ষা করার জন্য আইনগত কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরও। এ ব্যাপারে এক সূত্রে জানা গেছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কৃষি জমি সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১৩ সালে আইনের খসড়া প্রণয়ন করে পাঠানো হয় মন্ত্রিসভায়। মন্ত্রিসভায় এটি একদফা অনুমোদন দিলেও পরবর্তীতে কিছু সংশোধনীর জন্য আবার ফেরত পাঠানো হয়। এরপর একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও এখনও তা রয়ে গেছে পর্দার আড়ালে’। স্মরণীয় যে, স¤প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুনরায় কৃষি জমি ও জলাশয় রক্ষা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন আইন। আইন বলেই সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কৃষি জমি ও জলাশয় রক্ষা করবে। নতুবা সরকার প্রধানের উক্ত নির্দেশ কার্যকর করা কঠিন। তাই জরুরি ভিত্তিতে কৃষি জমি সুরক্ষার খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুবা কৃষি জমি হ্রাস পেতে পেতে শেষ হয়ে যাবে। দেশের উন্নতির সব অর্থ খাদ্য আমদানির গহ্বরে চলে যাবে। দ্বিতীয়ত উক্ত আইনটি কেন এতদিন চূড়ান্ত করা হয়নি, তা খতিয়ে দেখা এবং এ ক্ষেত্রে কারও গাফিলতি থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
কৃষি জমি শুধুমাত্র শিল্প, আবাসন, নগরায়ন ইত্যাদিতেই হ্রাস পাচ্ছে না, সে সাথে প্রতি বছরই নদী ভাঙ্গনেও বিপুল পরিমাণে কৃষি জমি এবং বাড়ী-ঘর, রাস্তাঘাট ও স্থাপনাসমূহ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু নদী ভাঙ্গনের এলাকার লোকজনরা নিঃস্ব হয়ে ঠাই নিচ্ছে শহরে। এতে করে শহরের পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাই নদী ভাঙ্গনও রোধ করা জরুরী। নদী-খাল বিল, হাওড় বাঁওড় পুকুর দীঘি, জলাশয় ইত্যাদি দীর্ঘদিন যাবত সংস্কার না করার কারণে এসব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে পানি ধারণের ক্ষমতা নেই বললেই চলে। তাই বর্ষার মওসুমে সামান্য বৃষ্টি হলেই কিংবা ভারত থেকে ব্যাপক পানি এলেই নিমিষের মধ্যেই ভয়াবহ বন্যা হয়ে সবকিছু তলিয়ে যায়। আবার নদীর পাড়/বাধ ভেঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। আবার শুষ্ক মওসুমে পানির অভাবে কৃষি ও প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। অথচ নদী খাল বিল ইত্যাদি সংস্কার করা হলে একদিকে যেমন বর্ষা মওসুমে পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত এবং সে সাথে পানি দ্রুত নেমে যেতে পারতো। অন্যদিকে বন্যা ভয়াবহ হতে পারতো না। নদী ভাঙ্গনও হ্রাস পেত। অপরদিকে, শুষ্ক মওসুমে পানির অভাব হতো না। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে নদী খাল বিল ইত্যাদি ভালভাবে সংস্কার করা জরুরী। সে সাথে সব বাধগুলিকে সার্বক্ষণিক মজবুত করে রাখা দরকার, যাতে সহজে ভেঙ্গে যেতে না পারে। যেসব স্থানে এখনো বাধ নির্মাণ করা হয়নি, সেখানে দ্রুত বাধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে, কৃষি খাতকে সম্পূর্ণরূপে আধুনিক করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা রয়েছে। যেমন: এ দেশের কৃষি জমি ভাগ হতে হতে অতি ছোট হয়ে পড়েছে। ফলে এসব জমিতে কিছু কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার করা সম্ভব নয়। সেসব যন্ত্রের জন্য বড় পরিসর দরকার। তাই সারাদেশে সমবায়ের মাধ্যমে বড় বড় কৃষি খামার গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই সব ধরণের কৃষি যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া, অধিক ফলনশীল বীজ ব্যবহার করতে হবে প্রতিটি ফসলের জন্যই। তাহলেই স্বল্প জমিতেই অধিক ফসল উৎপাদন হবে। সর্বাধুনিক জাতের মৎস্য,হাস-মুরগী ও পশু পালন করা দরকার। উল্লেখ্য যে, এবার কুরবানির হাটে রাজা-বাদশা, মহারাজ ইত্যাদি নামে খুব বড় আকারের গরু বিক্রি হয়েছে অনেক, যাদের ওজন ৩০-৪০ মন। এগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশ থেকে বাচ্চা গরু এনে দেশেই বড় করা হয়েছে। এসব জাতের গরু বিপুল সংখ্যক দেশে এনে পালন করা দরকার। এছাড়া, এসব জাতের গরুর প্রজনন করা যেতে পারে দেশের পশু প্রজনন কেন্দ্রগুলোতে। অন্যদিকে, দেশের সব মুরগীর খামারেই টার্কি মুরগীর চাষ করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কারণ টার্কি মুরগীর মাংস ৪-৫ গুণ বেশি হয় অন্য জাতের মুরগীর চেয়ে। উল্লেখ্য যে, বর্ণিত বিষয়গুলো করা হলেই স্বল্প দিনের মধ্যেই দেশে সব ধরণের খাদ্যের উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা সৃষ্টি হবে। রফতানি করে বিপুল মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। কিন্তু কৃষি জমি রক্ষা, নদী ভাঙ্গন রোধ, কৃষি যান্ত্রিকরণ, অধিক ফলনশীল বীজ ব্যবহার ইত্যাদি করা হলেই দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। কারণ, মানুষ বৃদ্ধির হার যদি বর্তমান ধারায় (জন্ম হারের প্রবৃদ্ধি ২% এর অধিক) অব্যাহত থাকে, তাহলে দেশে খাদ্য উৎপাদন যতই বৃদ্ধি করা হোক, তা দিয়ে খাদ্যের চাহিদা পূরণ হবে না, আমদানি করতেই হবে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং দারিদ্র্য দূর করার জন্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক।
দেশে দ্বিতীয় সম্ভাবনার খাত হচ্ছে নদী ও সমুদ্র। সা¤প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে নদী ও সমুদ্রে কৃষি, আবাসন, শিল্প, বাজার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশে হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণ করা হচ্ছে এবং তা লাভজনকভাবে চলছে। এ দেশেও নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ ও ভেলায় বিভিন্ন ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছে। এমনকি নদীতে নৌকায় সোলার প্যানেল স্থাপন করে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। নদী ও উপকূলে বায়ু বিদ্যুতও উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। এ ছাড়া রয়েছে বিশাল উপকূল। এসবকে ভালভাবে ব্যবহার করতে পারলে দেশের নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়ে যাবে। স্মরণীয় যে, দেশের নদী ও উপকূলে মাঝে মধ্যেই বিশাল আকারের চর জেগে উঠছে। এসব চরকেও অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগানো দরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন