জলবায়ুর পরিবর্তনজণিত প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাবিধ সংকট এখন অন্যতম বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ুদূষণ, পানি ও মাটি দূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার হুমকির মুখে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণ প্রাকৃতি ও জীববৈচিত্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অসচেতনতা এবং এসব দ্রব্যের দেদার উৎপাদন ও ব্যবহার শুধু পরিবেশ দূষণই নয়, প্রাণ-প্রকৃতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণের কারণে জীববৈচিত্র বিনষ্ট এবং মৎস্যশূন্য হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের কণা মাছের দেহে প্রবেশ করছে এবং সেসব মাছ খাওয়ার ফলে মানুষ ক্যান্সরাসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থার তথ্য মতে, বছরে ৮০ লাখ টনের বেশি প্লাস্টিক ও পলিথিন দ্রব্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। বঙ্গোপসাগরে কি পরিমান পড়ছে তার কোনো পড়ছে তার সঠিক তথ্য নেই। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন জণিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বৈশ্বিক উদ্যোগে বেশ তৎপরতা থাকলেও প্লাস্টিক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় সমুদ্রদূষণ ভয়ংকর পরিস্থিতি ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় সমুদ্র দূষেণ মাছ উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। আমাদের দেশেও সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
প্লাস্টিক ও পলিথিনসহ যেসব বর্জ্য ডাস্টবিনে, সুয়ারেজ লাইনে বা নদীতে ফেলা হয় তা পানির সাথে ভাসতে ভাসতে বা পলিমাটির সাথে সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে জমা হওয়া এসব প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের নানা স্থানে মহাভাগাড় সৃষ্টি করছে। সাধারণ প্লাস্টিক বর্জ্য মাটির সাথে মিশে না। এগুলো পচতে কমপক্ষে ৫০০ বছর লাগে। কয়েক বছর আগে পাওয়া একটি গবেষণা তথ্য অনুসারে, সমুদ্রে বর্তমানে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন টন বা ১৫ কোটি মেট্টিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য রয়েছে। ২০৪০ সাল নাগাদ সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমান ৬০ কোটি মেট্টিক টনে পৌঁছাবে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। সমুদ্রে পড়া প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো সামুদ্রিক পানির ¯্রােত, ঢেউ, রাসায়নিক বিক্রিয়া ও সূর্যরশ্মির কারণে কয়েক বছরের মধ্যেই ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে ক্ষুদ্র কণায় পরিনত হয়। সমুদ্র গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন মাইক্রো প্লাস্টিক। সমুদ্রের পানিতে ক্রমবর্ধমান হারে ছড়িয়ে পড়া এই মাইক্রো প্লাস্টিক সমুদ্রের মাছসহ প্রায় প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের গবেষণায় সামুদ্রিক মাছের পেটে যে পরিমান মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া গেছে তা আমাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। মাইক্রো প্লাস্টিক মাছের পেট থেকে শরীরে এবং খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানব শরীরে বিস্তার লাভ করছে। এর ফলে মানুষ ক্যান্সার, কিডনি রোগ থেকে শুরু করে অন্যান্য দূরারোগ্য ব্যাঁধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। সমুদ্র দূষণ এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন জাহাজ থেকে নিক্ষিপ্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। শত শত মাছ ধরা ট্রলার থেকেও এসব বর্জ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে, নদীবাহিত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য। এসব বর্জ্য সমুদ্রের জীববৈচিত্রের পরিবেশ বিনষ্ট করছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নদ-নদী দূষণের শিকার হয়েছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী নদীর পানির দূষণের মাত্রা এখন পরিশোধনেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশে কয়েক মিটার পুরো পলিথিনের আস্তরণ সৃষ্টি হয়েছে। দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৮ হাজার মেট্টিক টন পলিথিন পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এর বেশিরভাগেরই নদ-নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। কৃষিজমি উর্বরতা হারাচ্ছে। মৎস্য উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও দূষণের কারণে তা হুমকির মুখে রয়েছে। চিংড়ি রফতানি করে বছরে কয়েক শ’ কোটি টাকা আয় হলেও দূষণ রোধ করা না গেলে তা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণের কারণে সমুদ্র দূষণের মাত্রা নিরাপদ মাছের উৎপাদন যেমন ব্যাহত হবে, তেমনি মৎস্যশূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে। এহেন বাস্তবতায় দূষণ কমিয়ে আনার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সমুদ্রের প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য অপসারণের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার এবং উৎপাদন বন্ধের স্থায়ী উদ্যোগ নিতে হবে। অভিজ্ঞ মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতে হবে। যারা পরিবেশবিদ ও পরিবেশ দূষণরোধে অভিজ্ঞ তাদের মন্ত্রণালয়ের সাথে যুক্ত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন