সৈয়দ ইবনে রহমতমেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) শিক্ষার্থীরা তাদের ৫
দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন করছে অনেক দিন ধরেই। বিশেষ করে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গত ১৬ মে থেকে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট পালন করছে এই সাদা এপ্রোনধারী শিক্ষার্থীরা। গতকাল ১ জুন এই প্রবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত ১৭ দিন তারা খোলা আকাশের নিচে কাটালেও কর্তৃপক্ষের কারো মন গলার আভাস পাওয়া যায়নি। আন্দোলনরত ম্যাটস শিক্ষার্থীরা যে শুধু প্রেস ক্লাবের সামনে বসেই রোদে পুড়ছে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজছে তা নয়, বরং তারা তাদের দাবির কথা কর্তৃপক্ষের কান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে নানাভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সারা দেশেই ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের আন্দোলনটাকে। ঢাকাতেও চলছে মিছিল, শ্লোগান, স্মারকলিপি প্রদানসহ নানা তৎপরতা। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির দপ্তর পর্যন্ত তারা তাদের দাবিগুলোর কথা স্মারকলিপি আকারে পৌঁছে দিয়েছে, কিন্তু তাতেও সাড়া মিলছে না রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে।
কর্তৃপক্ষের অনিহা দেখে যে কেউ ভাবতে পারেন, ম্যাটস শিক্ষার্থীরা হয়তো অযৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। অথবা এসব দাবি মেটানো সরকারের পক্ষে অত্যন্ত ব্যয় বহুল। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকার এ ব্যাপারে কান-মুখ নাড়ার প্রয়োজন মনে করছে না। বিষয়টি আসলে কি তাই? মোটেই না। বরং প্রতিটি দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী। ম্যাটস শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো- ১. উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা; ২. উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসারদের বেতন-ভাতা ১১তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে উন্নতিকরণ; ৩. কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নতুন পদ সৃষ্টি এবং তাতে ম্যাটস শিক্ষার্থীদের পদায়ন; ৪. মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং কোর্সের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মেডিক্যাল এডুকেশন বোর্ড অব বাংলাদেশ’ নামে স্বতন্ত্র বোর্ড গঠন এবং ৫. ইন্টার্নি শিক্ষার্থীদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন এবং ভাতা প্রদান।
উচ্চ শিক্ষার অধিকার যে কোনো নাগরিকেরই আছে। অবাক করার বিষয় হলো, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে মধ্যম মানের ডাক্তার তৈরি করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিৎ করার লক্ষ্যে ম্যাটস কোর্স চালু করা হলেও তাদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে তিন বছরের তত্ত¡ীয় এবং এক বছরের হাতে-কলমে শিক্ষার মধ্যেই বনসাই হয়ে আছে ম্যাটস কোর্স সম্পন্নকারীরা। চাকরির ক্ষেত্রে না আছে তাদের পদোন্নতি, না আছে দক্ষতা বৃদ্ধির কোনো সুযোগ। অথচ স্বল্প সময়ে এবং অল্প ব্যয়ে মধ্যম মানের চিকিৎসক তৈরির সিদ্ধান্তটি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। প্রথম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনাতেই তিনি এটি রেখেছিলেন এবং এই মধ্যম মানের চিকিৎসকদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথাও বলেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭৬ সালে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস)-এর যাত্রা শুরু হয়। ৪০ বছর অতিবাহিত হয়েছে, অথচ এর পরও এই কোর্স সম্পন্নকারীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ না পাওয়াটাকে কীভাবে মেনে নেয়া যেতে পারে?
তিন বছর মেয়াদি মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস)-এর তত্ত¡ীয় কোর্সের পর এক বছর ইন্টার্নি করার পর শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ থেকে ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি (ডিএমএফ) সনদ পায়। এরপর বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে নিবন্ধন গ্রহণ করে তৃণমূল পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত হয়। যাদেরকে সহজ ভাষায় ডিপ্লোমা ডাক্তার বলেই অবহিত করা হয়। দেশের অন্যান্য বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্সধারীদের চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমানে দশম গ্রেডে (পূর্বের দ্বিতীয় শ্রেণি) বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ম্যাটস শিক্ষার্থী তথা ডিএমএফ সনদধারীদের ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে এক ধাপ নিচের তথা ১১তম গ্রেডের বেতন-ভাতা। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং মানহানিকর। আর সেটা স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও উপলব্ধি করেন। সেকারণেই তিনি গত ২০১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক সমাবেশে ঘোষণা করেছিলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসারদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে (তৎকালীন বেতন স্কেল অনুযায়ী) উন্নীত করা হবে।’ অথচ এর পর পেরিয়ে গেছে সতের মাস। তারপরও একই দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের!
আগে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানে সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো ম্যাটস কোর্সে। ফলে যারা প্রতি বছর পাস করে বের হতো তাদের যথেষ্ট চাকরির সুযোগও থাকত। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে ম্যাটস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়ায় বর্তমানে ৮টি সরকারি ম্যাটসের পাশাপাশি ১৯৫টি বেসরকারি ম্যাটস থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিএমএফ সনদ নিয়ে বের হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় তাদের কর্মক্ষেত্র নেই বললেই চলে। ফলে গত কয়েক বছরেই ডিএমএফ সনদধারী বেকারের সংখ্যা বারো হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দশ বছরে এই সেক্টরে বেকারের সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব, তাদের জন্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির কথা রাষ্ট্রেরই ভাবা উচিৎ।
আন্দোলনকারীদের চতুর্থ দাবি- মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং কোর্সের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মেডিক্যাল এডুকেশন বোর্ড অব বাংলাদেশ’ নামে স্বতন্ত্র বোর্ড গঠন। এটাও তাদের নতুন কোনো দাবি নয়, বরং ইতিপূর্বে তাদের এ দাবি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের আলাপ-আলোচনায় যৌক্তিক বিবেচিত হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৯ জুন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল যে, স্টেট মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির নাম পরিবর্তন করে ‘মেডিক্যাল এডুকেশন বোর্ড অব বাংলাদেশ’ নামে নামকরণ করা হবে। কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তা আর বাস্তবায়ন করা যায়নি। বরং চলতি বছর ২০১৬ সালের ৬ মার্চ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ডিপ্লোমা চিকিৎসা শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং যুগোপযোগী করার জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদকে বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশ প্যারামেডিক্যাল শিক্ষা বোর্ড’ নামে একটি বোর্ড গঠন করা হবে। অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ে ইতিপূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্ত বদলে দিয়ে ম্যাটস শিক্ষার্থীদের মর্যাদা আরও কমিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে কোনো একটি পক্ষ।
অন্যদিকে ম্যাটস শিক্ষার্থীদের তিন বছরের তত্ত¡ীয় শিক্ষার পর এক বছরের ইন্টার্নি তথা হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণের বাধ্যবাদকতা রয়েছে। এরশাদ সরকারের আমলে ম্যাটস শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নি করার সময় ভাতা দেওয়া হতো। কিন্তু পরে ইন্টার্নিশিপ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ইন্টার্নি বাধ্যতামূলক করে দেয়। বাস্তবে যার প্রয়োজনীয়তাও আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এবার ইন্টার্নি চালু করা হলেও শিক্ষার্থীদের ভাতা প্রদানের কোনো ঘোষণা এখন পর্যন্ত দেয়নি সরকার। এখন প্রশ্ন হলো, এমবিবিএস কোর্স সম্পন্নকারীদের সরকার ইন্টার্নি ভাতা দিচ্ছে, সম্প্রতি তা দ্বিগুণ করা হয়েছে। অন্যান্য ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তির পর থেকেই বৃত্তি দেওয়া হয়, তাহলে ডিএমএফ শিক্ষার্থীরা তা কেন পাবে না?
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে উপর্যুক্ত যৌক্তিক দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করেও ম্যাটস শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি তারা বাসায় গিয়েও মন্ত্রীর দেখা পায়নি, মন্ত্রণালয়ে গিয়েও সাড়া পায়নি মন্ত্রীর। তাহলে কি ধরে নিব যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিষয়টি অবগত নন? মোটেই তা নয়, বরং তিনি এ আন্দোলনের কথা ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই মন্ত্রণালয় এবং বাসায় শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশি বাধার শিকার হয়েছে। মিছিলের পরিবর্তে কয়েকজন প্রতিনিধিকে দিয়ে স্মারকলিপি পৌঁছানোর নির্দেশনাও মন্ত্রীর কাছ থেকেই এসেছে বলে অনুমিত। তারপরেও তিনি চুপ করে আছেন কিংবা ম্যাটস শিক্ষার্থীদের কান্না শোনার মতো অবসর উনার নেই। অথচ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি এই শিক্ষার্থীদেরও অভিভাবক। অভিভাবক হিসেবেই তিনি তাদের কথা শুনতে পারতেন, এমনকি প্রেস ক্লাবের সামনে এসে প্রয়োজনীয় আশ্বাস দিয়ে তা কার্যকর করতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি কিছুই করেননি। তাই স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন আসে যে, কোনো অভিভাবক যদি তার অধীনস্থদের এভাবে এড়িয়ে চলেন তাহলে তিনি কি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন বলে ধরে নেওয়ার সুযোগ আছে?
আসলে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা মানবিক নয়। যার কারণে শুধু ম্যাটস শিক্ষার্থীরা নয়, বরং নার্সদের আন্দোলন, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট এবং ফার্মাস্টিদের আন্দোলন কিংবা শিক্ষকদের আন্দোলন যাই বলি না কেন কোনোটাতেই সহজে রাষ্ট্রপক্ষ সাড়া দিতে চায় না। সব কিছুকেই এড়িয়ে যাওয়া কিংবা দমন করার প্রবণতা গ্রাস করেছে এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে। তা নাহলে এসব দাবি মেটাতে কত টাকা লাগে? ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রাণলয় তাদের অদক্ষতার কারণে যেসব বরাদ্দ ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছে তার সিকি ভাগও কি এখানে লাগবে? না, তা লাগবে না। তাহলে এদের কথা ভাবা হচ্ছে না কেন?
প্রয়োজনের তুলনায় এদেশের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কম হলেও পরিকল্পনাহীনতা এবং অদক্ষতার কারণে সেটারও সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারে না মন্ত্রণালয়। আর যেখানে যে পরিমাণ খরচ করা হয় তার বেলাতেও প্রয়োজনীয়তার মাপকাঠিতে বিবেচনা না করেই করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। তাছাড়া, কর্তাদের ঝোঁক থাকে উন্নয়ন প্রকল্প এবং কেনাকাটার দিকেই। কেননা, সেখানে নয়-ছয় করার সুযোগ থাকে ঢের বেশি। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হয় দেশের জনগণ, বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো নিশ্চুপ, তাই শেষ ভরসা প্রধানমন্ত্রী। তিনি কি উদ্যোগ নেবেন, তার পিতার গৃহীত সিদ্ধান্তে গড়া ম্যাটস কোর্সধারীদের ন্যায্য দাবি পূরণ করে এদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিৎ করতে?
য় লেখক : সাংবাদিক
ংধুবফরনহৎধযসধঃ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন