হারুন-আর-রশিদ : এফবিসিসিআই ও এনটিভি আয়োজিত কেমন বাজেট চাই অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, এবারের বাজেটটিও আগের মতোই হবে। শুধু নতুন কিছু বড় প্রকল্পের ঘোষণা থাকবে এবং বড় প্রকল্পকে গুরুত্ব দিতে থাকবে স্বতন্ত্র বাজেট। শুক্রবার ২০ মে ২০১৬ রাতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভি এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি এও বলেন, আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এ কারণে যে দশমবার বাজেট ঘোষণা করছি। তবে ধারাবাহিকভাবে এটা আমার অষ্টম বাজেট। প্রত্যাশা করছি একটি ভালো বাজেট উপহার দেব। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাজেট উচ্চাভিলাষী হওয়া প্রয়োজন এবং উচ্চাভিলাষী হওয়া বাজেট করারই সুফল পাচ্ছি আমরা। ওই অনুষ্ঠানে বিগত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছরের বাজেট বিশ্লেষণে তিনি দেখেছেন, বাজেট যাই করা হয়, তার বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হয় না এবং এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশে প্রধান শক্তি ১৬ কোটি মস্তিষ্ক। কিন্তু আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। এত সস্তা জনশক্তিকে কাজ লাগাতে পারলে বাজেটে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। সাত মাসে রাজস্ব ঘাটতি ১২ হাজার কোটি টাকা। আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৭৯ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে এই হার ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়া ২ দশমিক ৪, ভারত ৫ দশমিক ৯, থাইল্যান্ড ২ দশমিক ৭, ফিলিপাইনে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতে গত ডিসেম্বর (২০১৫) শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণেই বাংলাদেশে ঋণের সুদের হারও বেশি। আমরা প্রত্যাশা করছি, বাজেটে এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট বক্তব্য থাকবে। মানুষের আমানতের টাকা এভাবে দুষ্ট খাতে ব্যয় হবে, যার কোনো বিচার হবে না, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ টাকা যা দেশের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান, এই অর্থ দিয়ে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব।
বর্তমানে ১৭-৫-২০১৬ প্রথম আলো লিখেছে লিড নিউজ আকারে, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা। নিয়মিত খেলাপি ঋণের শীর্ষে ৫ সরকারি ব্যাংক। সোনালি ব্যাংক-৮২৭১ কোটি, বেসিক ব্যাংক ৬৮২৪ কোটি, জনতা ব্যাংক ৫০৪০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৪৮১৫ কোটি এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ৪০৭০ কোটি টাকা। যোগফলে দাঁড়ায় এক লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, বিপুল পরিমাণ এই খেলাপি ঋণ দেশের জন্য অশনি সংকেত। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আসন্ন বাজেটে এ ব্যাপারে কৈফিয়ৎ তলব করে বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা রাখবেন (১৮-০৫-২০১৬) রাষ্ট্রযন্ত্র। অন্যদিকে রিজার্ভ বৃদ্ধি বিনিয়োগ মন্দারই ইঙ্গিত দেয়Ñএ বক্তব্য বিশ্বব্যাংকের।
আমরা ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছিÑ এবারের বাজেট প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার। আয়ের উৎস কত হবে সেটাও জানা যাবে। পাশাপাশি এটাও বলে দেওয়া যায় আয় ও ব্যয়ের মধ্যে যে ঘাটতি থাকবে তার অংক প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। আমরা মনে করি, অদ্যাবধি অর্থনীতিকে টেনে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সেটা অর্থমন্ত্রীর সূচক, ব্যবসায়ীদের সূচক আর জনগণের সূচক সব ক্ষেত্রেই সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট। কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে খুব বেশি রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে তাও বলা যাবে না। এরপরও কেন যে এই সুযোগ বছরের পর বছর দেয়া হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
এদিকে রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তখনই এগিয়ে আসবে যখন দেশীয় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসবে। ভারী শিল্প-কারখানায় কেন যে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ধনীরা নগরীতে আবাসন কোম্পানি, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খাতে টাকা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী বেশি। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় তারা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। তাহলে বিদেশিরা কোন আশ্বাসে এদেশে টাকা লগ্নি করবে। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। গ্রæপ অব কোম্পানির সাইনবোর্ড লাগিয়ে ধনী ব্যবসায়ীরা আমদানিনির্ভর কোম্পানি সেজে বসে আছে। সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য সামগ্রী ভারত ও চীন থেকে আমদানি করতে হয়। আমি এপ্রিল মাসে ভারত গিয়ে দেখেছি টাটা, বিরলা, বাজাজ, রিলায়েন্স তাদের নিজ দেশেই উচ্চমানের লিফট, স্কেলেটার, কম্পিউটার, স্মার্টফোন ইত্যাদি নির্মাণ করছে। একটি জেমসক্লিপ, সুই তৈরির কারখানা স্বদেশে নির্মাণ করতে ভয় পাচ্ছে বাংলাদেশের কথিত শিল্পপতিরা। বাংলাদেশে ভারী শিল্পে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। স্বাধীনতার পূর্বে আদমজি ইস্পাহানী, বাওয়ানিরা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমান বাংলাদেশে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে আদমজি পাটকল, স্টিল মিল, ইস্টার্ন রিফাইনারি, কাগজ শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে ২৩ বছরে বাংলাদেশকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তান আমলে গড়া বড় বড় শিল্প-কারখানা এখন বলতে গেলে মৃত। আমাদের প্রত্যাশা থাকবেÑ এ ব্যাপারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে রাষ্ট্রযন্ত্র। বাংলাদেশে জীবনযাত্রার মান যে হারে বেড়েছে, সেই হারে তাদের আয় বাড়েনি। ভারতে পণ্য সামগ্রীর মূল্য ঢাকার চেয়ে কম। এক বেলা খেতে গেলে খরচ মাত্র ৫০ থেকে ৭০ রুপি লাগে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই একই খাদ্য খেতে গেলে ১০০-১৫০ টাকা লাগবে। তাছাড়া ভারতে ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষের রেল ভাড়া প্রায় অর্ধেক। ৪০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে সে দেশের সরকার। আমাদের সরকার ষাটোর্ধ্ব মানুষদের সিনিয়র সিটিজেন টাইটেল দিয়েই কেল্লাফতে অর্থাৎ আর কিছু প্রবীণদের জন্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মানুষের বেঁচে থাকার ৫টি মৌলিক অধিকারও শাসক গোষ্ঠী কেড়ে নিচ্ছে। এসব ব্যাপারে বাজেটে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমরা দেখতে চাই।
মাথাপিছু আয় যতটা বেড়েছে তার চেয়ে মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে দুই থেকে তিনগুণ। একজন মানুষ তার আয় অনুযায়ী ব্যয় করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে স্বীয় বাজেট সামাল দিচ্ছে। তিন শ্রেণীর গরিব মানুষ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অর্জনের বড় কারিগর- (১) গার্মেন্ট সেক্টরে কর্মরত নারীরা, যারা আধপেটা খেয়ে ১৫/১৬ ঘণ্টা শ্রম দেয়। (২) প্রবাসে কর্মরত বাঙালি শ্রমিক। (৩) আর হচ্ছে কৃষককূল, যারা জমিতে ফসল ফলায় এবং চিংড়ি মাছ চাষ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের পথকে প্রশস্ত করে। এই তিন ধরনের মানুষ বিদেশি সাহায্যের কানাকড়িও পায় না। পায় ধনী-বণিক শ্রেণির মানুষ। ঢাকায় যত বিলাসী গাড়ি দেখা যায় তার মালিক ওই তিন শ্রেণির মানুষেরা নয়। অথচ বিদেশি সাহায্যে ঋণ পরিশোধের প্রধান দায়ভার তাদের বহন করতে হয় না। এক কথায় যার উত্তর সুদাসলে ঋণের যে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়, তার প্রধান জোগান দেয় দেশের সাধারণ মেহনতী মানুষ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব কর তারা বহন করে। সহজভাবে বললে বলা যায় যে, বিদেশি সাহায্য আমাদের ঋণগ্রস্ত করছে। বিনিয়োগ ও সঞ্চয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখেনি। এটাই বাস্তব কথা।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান কয়েক বছর আগে একটি আলোচনা সভায় বলেছেন, বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াও আমরা স্বনির্ভর হতে পারি, যদি রাজস্ব আদায় শতভাগ সম্ভব হয়। ছোটখাটো দুর্নীতির দিকে নজর না দিয়ে বড় মাপের দুর্নীতির ১৫ শতাংশ কমাতে পারলেই এটা সম্ভব হবে। বড় বড় রাজস্ব-কর যারা ফাঁকি দেয়, তারা সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি বা উঁচু স্তরের মানুষ সেটাও রাষ্ট্রযন্ত্রের সদিচ্ছা থাকলে বন্ধ করা সম্ভব। গরিবের টাকায় বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তারা যদি জনস্বার্থের কথা একটু বিবেচনা করতে আগ্রহী হন তাহলে রেমিট্যান্স আরো বৃদ্ধি পাবে। জনশক্তি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করলে বিদেশি সাহায্যের বিশাল অংক যা প্রতিবছর বাজেটে থাকে তাও কমিয়ে আনা সম্ভব। আমরা বিদেশনির্ভর বাজেটে অব্যস্ত হয়ে পড়েছি তা থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে জনস্বার্থে যোগাযোগ সেক্টরকে কত উন্নতমানের করা যায় সেই চিন্তায় রাজ্য সরকারগুলোর ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আমাদের গা ঘেঁষা পশ্চিমবাংলায় মেট্রো রেলের ভাড়া যেমন সাশ্রয়ী তেমনি আরামদায়ক। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে শাসক দল জনতার উন্নয়নের নামে দেশকে আরো ক্ষতির দিকে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ভূখÐ অনুপাতে মানুষ এত বেশি, আগামী দিনে যা ভয়াবহ রূপ নেবে। এখন আমাদের সুষম বাজেট যদি ঘোষণা করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার দিকে ধাবিত হবে। বাজেটে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া সময়ের দাবি হিসেবে আমরা মনে করছি।
ধনীদের টাকা দিয়ে মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করা যাবে না। ক্যাটাগরি অনুযায়ী মাথাপিছু আয় বিভক্ত করে দেখাতে হবে। (১) ধনীদের আয় (২) উচ্চমধ্যবিত্ত (৩) মধ্যবিত্ত (৪) নি¤œ মধ্যবিত্ত (৫) একেবারে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়। এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করলে বোঝা যাবে দেশের কত শতাংশ মানুষ ১৪০০ ডলার আয় করছে। মাথাপিছু আয় বাড়লে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও বেড়ে যাবে। কিন্তু সঠিক তথ্য জানা দরকার।
তাছাড়া, দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী যারা দীর্ঘ বছর রাষ্ট্রের সেবা দিয়েছেন, এখন পর্যন্ত তাদের জন্য সরকার চিকিৎসা, যাতায়াত, ভাতার কোনো ব্যবস্থা করেনি। সরকারি চাকরিজীবীদের ছাড়া বাংলাদেশে কয়েক লাখ লোক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তারা আজ অবসর জীবনযাপন করছে তাদের ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। জাতিকে এভাবে বিভক্ত করা সুশাসনের অন্তরায় বলা যায়।
আমরা চাই, করের আওতা বৃদ্ধি পাক। বেকারত্ব মোচন তহবিল সৃষ্টি করতে হবে। অন্যদিকে ঘাটতি বাজেট অর্থই হলো জনগণের আমানতের ওপর হাত দেয়া। এই আচরণ গণবান্ধব বাজেটের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বলে আমরা মনে করি। সর্বশেষে বলবÑ রাজনীতিতে সুস্থতা ফিরিয়ে আনার জন্য টেকসই গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। সুশাসন আসবে না যদি প্রকৃত গণতন্ত্র দেশে বিরাজমান না থাকে। রাষ্ট্রযন্ত্র এসব বিষয় নিয়ে ভাববে, এটাই প্রত্যাশা করি।
য় লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামনিস্ট
যধৎঁহৎধংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন