হোসেন মাহমুদ
পরীক্ষার প্রশ্নে ভুল হয়েছে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, পরীক্ষার খাতায় নম্বর দেয়া হয়নি কিংবা ভুল নম্বর দেয়া হয়েছে ইত্যাদি বিষয় এক সময় চিন্তাও করা যেত না। এখন তা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হতে চলেছে। শুধু কি তাই? এখন একটি পেপারে কয়েক শ’ ছাত্রছাত্রীর ফলাফলেও ভুল হয়ে যায়, প্রশ্নপত্রের সেটে গরমিল হয়, উত্তরপত্র মেলে না। ফলে তারা গণ-ফেল করে। তা নিয়ে যখন শোরগোল হয় তখন তড়িঘড়ি সংশোধনের ব্যবস্থা করে পরীক্ষার ফলাফলেই পরিবর্তন ঘটানো হয়। এসব ব্যাপার সাম্প্রতিককালে আমাদের শিক্ষাবোর্ডগুলোতে ঘটছে। আর তা কমছে না তো বটেই, দিনে দিনে ভুল আরো বাড়ছে, আর পরিণতিতে জীবন বিসর্জন দিয়ে সে ভুলের মর্মান্তিক খেসারত দিচ্ছে ঘটনার শিকার শিক্ষার্থীরা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী এবং শিক্ষার পরিবেশকে শিক্ষার্থীবান্ধব করার প্রচেষ্টার সাথে এসব ঘটনা মেলে না।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা পরবর্তী কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। এক. ফলাফলের ত্রুটি সংশোধন। এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের এক সপ্তাহ পর ১৮ মে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে ১৪,১৫৮ জন শিক্ষার্থীর গ্রেড পরিবর্তন করা হয়েছে। এরমধ্যে গণিত বিষয়ের সংশোধিত ফলাফলে নতুন করে পাস করেছে ৩ জন, আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮৩৬ জন শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ১১১৫ জন। উল্লেখ্য, গত ১১ মে এসএসসির ফল প্রকাশের পরদিন চট্টগ্রাম মহানগরের কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা চট্টগ্রাম বোর্ড কার্যালয়ের সামনে গিয়ে গণিতের ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। তাদের অভিযোগ ছিল, গণিত বিষয়ের নৈর্ব্যক্তিক ‘গ’ ও ‘ঘ’ সেটের প্রশ্নপত্রের উত্তর মূল্যায়নের সময় ত্রুটির কারণে সঠিক ফলাফল আসেনি। এতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী গণিতে জিপিএ-৫ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তখন বোর্ডের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের গণিতের ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের আশ্বাস দেয়া হয়। এ ব্যাপারে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মাহবুব হাসান বলেন, ‘গণিতের বহুনির্বাচনীর (এমসিকিউ) ‘গ’ ও ‘ঘ’ সেটের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের প্রশ্নপত্রে ভিন্নতা ছিল। যা প্রধান পরীক্ষক বা অন্য কারও নজরে আসেনি। এমসিকিউ অংশের উত্তরপত্রের মূল্যায়নে কিছু প্রশ্নের উত্তরমালায় ভিন্নতা তৈরি হয়। পরবর্তীতে ত্রুটি বের করে ফলাফলে সংশোধনী আনা হয়েছে।’
দুই. বরিশাল শিক্ষাবোর্ডে হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ফল বিপর্যয়ের অসহায় শিকার হয় ১১শ’রও বেশি শিক্ষার্থী। সবাই ফেল করে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেরা শিক্ষার্থীরাও ছিল। এ ঘটনায় অনেক পরীক্ষার্থীর অভিভাবকের প্রশ্ন, যারা সকল বিষয়ে এ প্লাস পায় তারা কি করে এক বিষয়ে ফেল করে? তারা বোর্ড অফিসে যোগাযোগ করেন। অন্যদিকে ২১ মে’র মধ্যে ওই পেপারের উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য আড়াইশ’র তো আবেদন পড়ে। বোর্ড কর্তৃপক্ষ উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের কাজ শুরু করে ওইদিন সন্ধ্যায় সংশোধিত ফল প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. শাহ আলমগীর বলেন, হিন্দুধর্ম বিষয়ে পরীক্ষার্থী ছিল প্রায় সাড়ে ৯ হাজার। এরমধ্যে ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্র পায় প্রায় ১১শ’ পরীক্ষার্থী। তাদের মধ্যে কয়েকশ পরীক্ষার্থীর ফলাফলে বিপত্তি ঘটে। নৈর্ব্যক্তিকের উত্তরপত্রের ওএমআর শিট কম্পিউটারে দেখা হয়। যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে এমনটা হয়েছে। অন্যদিকে বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান পরীক্ষকের অসতর্কতার কারণে ‘হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়ে ‘গ’ সেটের নৈমিত্তিক উত্তরপত্র ‘খ’ সেটের নৈমিত্তিক উত্তরের স্থলে কম্পিউটারে সেটিং করায় বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে ফল বিপর্যয় হয়েছে। তিনি বলেন, এই অস্বাভাবিক ফল দেখে প্রথমে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে হিন্দু ধর্মের সকল নৈমিত্তিক উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন করে শনিবার বিকালেই বোর্ডের ওয়েবসাইটে সংশোধিত ফল ঘোষণা করা হয়। তিনি আরও বলেন, হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে প্রায় এক হাজার দুইশ’ পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। এদের মধ্যে ৯০ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এই পুনর্মূল্যায়নের কারণে বোর্ডে পাসের হার বাড়বে। বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, দু’জন প্রধান পরীক্ষকের অদক্ষতার কারণে এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিধিমোতাবেক শাস্তি প্রদান করা হবে।
তিন. বরিশাল বোর্ডে পরীক্ষার ফল বিভ্রাটের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে হৃদয় নামের এক শিক্ষার্থী। জানা যায়, হৃদয় পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তার রোল নম্বর খুঁজে পায়নি। কিন্তু সে আশা করেছিল যে জিপিএ-৫ পাবে। জানতে পারে যে সে হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ফেল করেছে। এতে সে মানসিকভাবে প্রচ- বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাসায় ফেরার পথে সে একটি ভবনে উঠে চারতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এদিকে বোর্ড কর্তৃপক্ষ উক্ত পরীক্ষার ফল সংশোধন করার পর দেখা যায় হৃদয় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার মা-বাবার হাহাকারÑ এখন জিপিএ-৫ দিয়ে আমরা কী করব? তার বাবা বলেন, শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের ভুলে আমার ছেলের মূল্যবান জীবন গেল। আমার ছেলের দুর্ঘটনার পর তারা তাড়াহুড়ো করে নতুন ফল দেয় যাতে আরো কিছু ছাত্র পাস করেছে। তাদের ভুলের কারণে তো আরো প্রাণহানি ঘটতে পারত। তারা এখন কম্পিউটারের ভুল বলে পার পেতে যাচ্ছে। তারা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। অথচ এখনো তারা দায়িত্বে আছে।
চার. মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড থেকে এবার দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক ছাত্রের পিতা জানান, তার ছেলে মেধাবী ছাত্র বলে তার ব্যাপারে তাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু অন্য সব পেপারে সে এ প্লাস পেলেও ইংরেজিতে এ প্লাস পায়নি। ফলে তার ফলাফল প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। ছেলের দৃঢ় বিশ্বাস, ইংরেজিতেও তার এ প্লাস না পাওয়ার কথা নয়। এর আগে জেএসসিতে তার প্রত্যেক বিষয়ে এ প্লাস সমমানের নম্বর ছিল। সে অত্যন্ত আশাহত। তিনি ছেলের ইংরেজি উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করতে ২৩ মে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে যান। সেখানে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তাকে বলেন, উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। তাতে অনেক ঝামেলা। তিনি বলেন, যা দেখা যেতে পারে তা হল পরীক্ষক নম্বর দিতে ভুল করেছেন কিনা, নম্বর ঠিকমত রেকর্ড করা হয়েছে কিনা, পরীক্ষার্থী কোনো ভুল করেছে কিনা যে কারণে সে নম্বর কম পেয়েছে।
বাস্তব অবস্থা থেকে দেখা যাচ্ছে যে পরীক্ষকরা উত্তরপত্র পরীক্ষার সময় ভুল করতে পারেন। তা হতে পারে যে তিনি একটি প্রশ্নের উত্তরে হয়ত নম্বরই দেননি, হতে পারে নম্বর যোগ করার সময় একটি উত্তরের নম্বর যোগ করতে ভুলে গেছেন, এ রকম আরো কিছু। পরীক্ষার ফলাফলের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভুল যে কত বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে যে গত কয়েক বছরে পরীক্ষার ফল চ্যালেঞ্জের ঘটনা বাড়ছে। ২০১৪ সালে ৪৩ হাজার পরীক্ষার্থী ফল চ্যালেঞ্জ করেছিল। গত বছর ফল চ্যালেঞ্জ করে ১ লাখ ২৯ হাজার ৩০১ জন। আর এ বছর ফল চ্যালেঞ্জ করেছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৮ জন পরীক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম ও বরিশাল বোর্ডের ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ভুল করেছেন সংশ্লিষ্ট পরীক্ষকরা। তারা যে ভুল করছেন তা দেখার ব্যবস্থা নেই। ফলে ভুল ভুলই থেকে যাচ্ছে। তার পরিণতি হচ্ছে লজ্জাস্কর। তার জন্য যাদের লজ্জা পাবার কথা তারা তা পাচ্ছেন না, বরং নিজেদের দায় মোচনের জন্য ভুলের দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছেন তথাকথিত যান্ত্রিক ত্রুটির উপর। যেমন বরিশালে ভুল করেছেন সংশ্লিষ্ট পরীক্ষক। আর ফলাফল ঘোষণা করেছে বরিশাল বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ধরা যাক, এ ভুল করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হবে (২৭ মে পর্যন্ত শাস্তি দেয়ার কথা জানা যায়নি)। কিন্তু পরীক্ষা ফেলের লজ্জায় আত্মহত্যা করা কিশোর হৃদয়ের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী হবে? এর ক্ষতিপূরণ কী?
ঢাকা বোর্ডের একজন সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক একটি সংবাদপত্রে এ বিষয়ে বলেন, সাধারণত কোনো বিষয়ের ফল নিয়ে যখন সন্দেহজনক কিছু দেখা যায়, তখন তা চূড়ান্ত করার আগে চেক করা উচিত। বরিশাল বা চট্টগ্রাম বোর্ডে এবার যা হয়েছে তা সংশ্লিষ্টদের সচেতনতার ঘাটতি। তারা আরো সচেতন হলে এমন ঘটনা ঘটত না। প্রাণহানিও হতো না।
এ অবস্থায় সকল পরীক্ষায় ত্রুটিবিহীন ফল প্রকাশের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবেক পাকিস্তান আমলে প্রশ্নপত্রে ভুল, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে ভুল হওয়া কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কথা শোনা যায়নি। তেমনি তা শোনা যায়নি কয়েক বছর আগেও। দুর্ভাগ্যক্রমে একশ্রেণির দায়িত্বহীন ও নীতিহীন মানুষের জন্য আমাদের এ লজ্জাস্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের তো বটেই, জাতির জন্যও এ এক অভিশাপ। সবাই এর আশু প্রতিকারের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই শুধু জাতি এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে। তাই সরকারকে বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে।
অন্যদিকে মাদরাসা বোর্ড কর্তৃপক্ষ খারাপ ফলাফলের শিকার হওয়া পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিষয়টি পরিহার করেছেন। কোনো শিক্ষার্থী যদি সব পেপারে এ প্লাস পায় আর একটি পেপারে যদি না পায় এবং সে যদি নিজের ভালো পরীক্ষার ব্যাপারে প্রত্যয়ী হয়, তাহলে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যবস্থা করলে অসুবিধা কী? এটা কি পরীক্ষার্থীর অধিকার নয়? ফলাফলের এদিক-ওদিক তার জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে আবার বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণও করতে পারে। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ ফি নিতে পারেন। তাদের মনে রাখতে হবে যে, উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের ফল ইতিবাচক হলে, তা শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে, তার অভিভাবকের লালিত স্বপ্ন পূরণের দিকে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তার মূল্য তো কম নয়। এ বিষয়টি বিবেচনা করা হলে অনেক পরীক্ষার্থীই উপকৃত হতে পারে। অভিভাবকরাও অনেক পেরেশানি থেকে বাঁচতে পারেন।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন