রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

সামাজিক অপরাধ নতুন কিছু নয়। কোনো সমাজই পুরোপুরি অপরাধমুক্ত নয়। তবে তা সহনীয় মাত্রায় রয়েছে কিনা, তাই দেখার বিষয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশে সামাজিক অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভয়াবহ ও বিভৎস রূপ ধারণ করেছে। একের পর এক নৃশংস ও নির্মম হত্যাকান্ড মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষ। কোনো ঘটনা প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত:পর মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় ভাইরাল বা প্রচারনার পর ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি হলে যেন কিছুটা টনক নড়ে। তারপর কিছুদিন পর তা হারিয়ে যায়। যেন আরেকটি ঘটনার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। ধারাবাহিকভাবে নৃশংস ঘটনা ঘটার মূল কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং অপরাধ করে অপরাধিদের পার পেয়ে যাওয়া। গত সপ্তাহে বরগুনায় রিফাত শরিফ হত্যান্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর হত্যাকান্ডে জড়িত তরুণদের অতীতের নানাবিধ অপকর্মের তথ্য প্রকাশিত হতে শুরু করে। এদের আচরণ ও তৎপরতা অনেকটা মাফিয়া গ্যাংয়ের মত। রিফাত শরিফ হত্যারা প্রধান আসামী নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজি গং স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠার তথ্য ইতোমধ্যে বের হয়ে এসেছে। এমনকি স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে চাপাতি নিয়ে হামলার চেষ্টা ও হুমকির কথাও জানা যায়। কতটা প্রভাবশালী ও বেপরোয়া হলে এই সন্ত্রাসীদের পক্ষে এটা করা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়। 

প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বরগুনার আলোচিত রিফাত শরিফ হত্যার মূল আসামিরা এখনো ধরা পড়েনি। তাদের পেছনে প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়া বা স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আত্মীয়তার কারণে এসব খুনির পার পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন অনেকেই। তা নাহলে এমন চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের পরও আসামীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে কিভাবে? স্থানীয় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিহত রিফাতের পরিবারকে হত্যা মামলাটি আপোস মিমাংসার জন্য চাপ দিয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এমন একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামীরা যদি পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্নের উদ্রেক করবে। এটাই প্রতিষ্ঠিত হবে প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে ভয়ংকর খুনিরাও পার পেয়ে যেতে পারে। এই অপসংস্কৃতি যদি চলতে থাকে, তবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বলে কিছু থাকবে না। শুধু রিফাত হত্যাই নয় গত কয়েক সপ্তাহে এমন আরো বেশ কিছু নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে যার সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের রকমফের যাই হোক, অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশের চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পেশীশক্তির বিস্তার একশ্রেণীর কিশোর-তরুনদের নানারকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি রোধে এখনই পদক্ষেপ না নিলে কিংবা অপরাধীদের গ্রেফতার করে শাস্তির মুখোমুখি করতে না পারলে সুষ্ঠু সামাজিক পরিবেশ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যাকান্ডের পর সামাজিক অপরাধ নিয়ে দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা যে সব মতামত ও মন্তব্য প্রকাশ করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রথমত: রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া, বিচার দীর্ঘায়িত হওয়া এবং মামলার দুর্বলতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনীহা বা শৈথিল্যের কারণে প্রকৃত অপরাধির পার পেয়ে যাওয়ায় এ ধরনের হত্যাকান্ডসহ তরুণ শ্রেণীর মধ্যে অপরাধমূলক প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এর জন্য সমাজে ও রাজনীতিতে নেতিবাচক কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করা হলেও তা হঠাৎ করেই ঘটে যায়নি। এগুলো আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি ও সমাজে নীতি- নৈতিকতা চর্চার অভাব ও প্রশয়ের কারণেই ঘটে চলেছে। বরগুনায় যে কয়জন তরুণ মিলে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্য চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে তাদের পেছনে প্রভাবশালী মহলের প্রশ্রয় থাকতে পারে। ইতিপূর্বে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে উঠতি বয়েসী তরুণদের বেপরোয়া অপরাধমূলক কর্মকাÐ ও গ্যাং কালচারের সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে গড়ে ওঠা বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি একদিকে সাধারণ মানুষকে আইনের প্রতি আস্থাহীন করে তুলছে, অন্যদিকে প্রভাবশালীদের পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে কিশোর-তরুণদের মধ্যে সংঘবদ্ধ গ্যাং বা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে ভূমিকা রাখছে। রিফাত হত্যাকাÐের আগে সংঘটিত অনুরূপ বহু হত্যাকাÐের বিচার এখনো পায়নি নিহতদের পরিবার। এর কারণ অজানা নয়। এ ধরনের অপসংস্কৃতি চালু রেখে আইনের শাসন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধতা। মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি জাগিয়ে তোলা বাঞ্চনীয়। পরিবারের পিতা-মাতা এবং সমাজের সচেতন শ্রেণীর এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজ সন্তান এবং এলাকার কিশোর-তরুণদের আচরণ ও তৎপরতার উপর তাদের বিশেষ নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নজরদারি, সচেতনতা এবং কাউন্সেলিং ও শাসনের সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে গুরুতর অপরাধ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন