বাংলাদেশ রেলওয়ের বিপুল আয়তনের জমি, সম্পত্তি ও পুকুর বিধিবহির্ভূত লিজ দেয়া হচ্ছে। জমি দখল করে কর্মচারীদের বাসাবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রয়োজন না থাকলেও কোচ, ইঞ্জিন কেনা এবং লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা, সঠিক তদারকি এবং মনিটরিংয়ের অভাবে রেলের শত শত একর বেহাত হচ্ছে। এ রকম অন্তত ১০টি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়েতে।
এ তথ্য দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতিপ্রবণ খাতগুলোর ওপর অনুসন্ধান শেষে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’ এ প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। প্রতিবেদনটি গতকাল মঙ্গলবার দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান আবদুল গনি রোডস্থ রেলভবনে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের কাছে হস্তান্তর করেন। উৎস চিহ্নিত করার পাশাপাশি দুর্নীতি বন্ধে ১৫টি সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতির উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে (পূর্বাঞ্চল) চট্টগ্রাম এবং (পশ্চিমাঞ্চল) রাজশাহীর অধীনে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি লিজ/হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে। রেলওয়ের অনেক জলাশয়/পুকুর নিয়মবহির্ভূতভাবে লিজ দেয়া হয়। যার ফলে সরকারি রাজস্ব যথাযথভাবে আদায় হয় না। রেলওয়ের জায়গায় রেল সংশিষ্টদের যোগসাজশে স্থাপনা নির্মাণ করতে দেয়া হয়। এ থেকে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন।
সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা, যথাযথ তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাবে রেল বিভাগের শত শত একর ভূমি বেদখল হয়ে আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধভাবে দখল করে বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন। রেলওয়ের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ, ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ক্রয়/সংগ্রহসহ অন্যান্য কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়।
রেলওয়ের বিভিন্ন সেকশনের স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও আধুনিকীকরণেও অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। ডাবল লাইন, সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণকাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। রেলের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও দুর্নীতি হয়।
রেলের ডিএস/কারখানা সৈয়দপুর, নীলফামারী, বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল, পাকশি বাংলাদেশ রেলওয়ে, ঢাকা; বাংলাদেশ রেলওয়ে, লালমনিরহাট; পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এবং এমজি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন নিলামে যন্ত্রাংশ বিক্রি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়। এ ক্ষেত্রে যথাযথ উপাদান লাইনে না দেয়া, যন্ত্রাংশ সংস্থাপন যথাযথভাবে না করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ হয়। রেলের অধীনস্থ ওয়ার্কশপগুলো কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে ¯িøপার ফ্যাক্টরি অকার্যকর রেখে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করা হয় বলেও মানুষের ধারণা। টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে কালোবাজারি হয়। এতে রেলওয়ের কর্মচারীরাও জড়িয়ে যান। একশ্রেণীর দালাল রেলওয়ের কর্মচারীদের সহযোগিতায় আন্তঃনগর ট্রেনে বেশিসংখ্যক টিকিট কেনার মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে। এতে দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
যাত্রীবাহী ট্রেন ইজারা দিতে দুর্নীতি হয়। ট্রেনে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে জনসাধারণ কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হন। সব ট্রেনে সরবরাহকৃত ও বিক্রীত খাবারের মান নিম্নমানের। জনস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক নয় মর্মে জানা যায়। এ ছাড়া ট্রেনে সরবরাহকৃত খাবারের দামও তুলনামূলক বেশি। এখানে যথাযথ তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। রেলওয়েতে জনবল নিয়োগে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা নেয়ার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করা।
বিভিন্ন ধরনের ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক প্রকাশ্য/ই-টেন্ডারিং, দরপত্র আহŸান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ প্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ সিনিয়র কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদন দাখিলের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার বলেন, দুদকের নজরদারি কেবল রেলপথ মন্ত্রণালয়ে নয়। দেশের সর্বত্রই দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে নজরদারি রয়েছে। দুর্নীতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি উল্লেখ করে দুদক কমিশনার বলেন, দুদক দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নিরলসভাবে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। দেশের বিকাশমান অর্থনৈতিক গতিধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে দুর্নীতি দমন, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন