মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়া

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ হারুন জামান

এদেশের গণমানুষের হৃদয় নিংড়ানো অপরিসীম ভালোবাসা, অবিচল আস্থা, বিশ্বাস আর প্রত্যয়দৃপ্ত চেতনার নাম জিয়াউর রহমান। তিনি অন্ধকারের পথ থেকে জাতিকে সম্ভাবনার উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। ইতিহাসের ধ্রুবতারা, সময়ের সাহসী সারথী। স্বাধীনতার ঘোষক, সফল রাষ্ট্রনায়ক, সেনাপ্রধান, সমাজ সংস্কারক, সর্বোপরি একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ, মুসলিম বিশ্বের অকৃত্রিম বন্ধু ও আধুনিক চিন্তার ধারক-বাহক।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহারে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন লুটপাট শুরু করে। নেতৃত্বের কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় ও সিদ্ধান্তহীনতায় দিশেহারা জাতি যখন দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে জাতিকে জেগে ওঠার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল একজন অখ্যাত মেজর জিয়া, যার প্রতি কোনো নির্দেশনা ও জনগণের পক্ষ থেকে কোনো দাবি, প্রত্যাশা না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র স্বজাতির প্রতি অফুরান ভালোবাসা, দেশপ্রেমের টানে জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে প্রথমে নিজেকে ‘হেড অব দ্য স্টেট’, পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধে মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠতম ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজেকে ইতিহাসের অপরিহার্য অংশ করে নেন। জিয়াউর রহমানের তুলনা তিনি নিজেই, তার কোনো বিকল্প নেই।
যতই ইতিহাস বিকৃত করে তার নাম মুছে ফেলার চক্রান্ত হোক না কেন তিনি তার কর্মের জন্য এদেশের জনগণের হৃদয়ে চিরজাগ্রত থাকবেন। ব্যক্তির মৃত্যু হয়, কিন্তু আদর্শের মৃত্যু কখনো সম্ভব নয়। যতই মুছে ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে তত বেশি তিনি জনগণের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিচ্ছেন। জিয়া ছিলেন, জিয়া আছেন, জিয়া থাকবেন, যত দিন বঙ্গোপসাগরের গর্জন, আজানের ধ্বনী, পাখির কলরব এবং এই ভূমিতে মানুষের পদচারণ থাকবে। জিয়া রবে গৌরবে।
১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম ছিল কমল। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন মেধাবী। লাজুক, চিন্তাশীল ও মৃদুভাষী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। পিতা মনসুর রহমান ছিলেন একজন কেমিস্ট। মাতা-জাহানারা খাতুন রানী গৃহিণী হলেও ছিলেন শৌখিন সংগীতশিল্পী। তিনি করাচি বেতারে গান করতেন প্রায় নিয়মিত।
কলকাতার হেয়ার স্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু। তিনি ১৯৫২ সালে করাচি একাডেমি থেকে কৃতিত্বের সাথে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে করাচি ডি.জে কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। তিনি দক্ষতা ও সাহসিকতার সহিত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি বেগম খালেদা খানমের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্ব পদক লাভ করে বাঙালি সৈনিকদের মর্যাদার আসনে আসীন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনানিবাসে কর্মরত বাঙালি সেনাদের অবহেলা, অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য দুর্বল ভাবা যেন পাকবাহিনীর অভ্যাসে পরিণত হয়ে পড়েছিল। সেখানে মুষ্টিযুদ্ধ প্রতিযোগিতায় বাঙালি সেনাদের অংশগ্রহণ ছিল ধৃষ্টতার মতো। বাাঙালি সেনা অফিসার জিয়াউর রহমান এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে জেদের বসবতী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের শুধু পরাহতই নয়, একেবারে তুলাধোনা করে ছাড়ল। এ বিজয়ে বাঙালি সেনাদের মনোবল অনেকগুণ বেড়ে যায় এবং এ বিজয়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী চেতনাবোধের সূচনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, নির্বাচনী-পরবর্তী আন্দোলন সংগ্রাম ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পাক সেনাদের গতিবিধির ওপর তীক্ষè দৃষ্টি রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। ১৯৭০ সালে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে বদলি হন।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতার-পরবর্তী সিনিয়র অফিসার হওয়া সত্ত্বেও সেনাপ্রধানের দায়িত্ব না দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদের দায়িত্ব দিলে তিনি দিন-রাত পরিশ্রম করে সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন কাজে আত্মনিয়োগ করে সেনাবাহিনীতে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাকে সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্যান্টনমেন্ট বাসভবনের বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে আনেন। ১৯৭৫ এর ২৫ আগস্ট সেনাপ্রধানের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু মোহাম্মদ সায়েমের অসুস্থতা ও দায়িত্ব পালনের অপারগতার কারণে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করে গণতন্ত্রের স্বীকৃত পন্থায় আস্থা-অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে জনসমর্থন যাচাই করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট মনোনীত প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে ১ কোটিরও বেশি ভোটে পরাজিত করে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি বহুদলীয় রাজনীতির ধারা প্রবর্তনের জন্য ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইসলামী মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক বহুদলীয় ধারাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। তিনি এই দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। মহাসচিব ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। জিয়া ১৯৭৯ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করেন। ওই নির্বাচনে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাসদ, মুসলিম লীগ, আইডিএল, সিপিবিসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে এবং এই নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। প্রধান বিরোধী দল ছিল আওয়ামী লীগ।
জিয়াউর রহমান স্বল্প সময়ের দেশ পরিচালনায় যে বিশাল উন্নয়ন ও কর্মকা-ের স্বাক্ষর রেখেছেন তা ইতিহাসে বিরল। দেশের এমন কোনো শাখা বা বিভাগ নেই যেখানে তার হাতের স্পর্শ পড়েনি। প্রেসিডেন্ট জিয়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকার পরও অতি সাধারণের মতো জীবনযাপন করতেন। কোনো ধরনের লোভ-লালসা তাকে স্পর্শ করতে পারত না। তিনি নিজ ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি আস্থাশীল থাকলেও চিন্তা ও চেতনায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তার শাসন আমলে এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল অহংকার করার মতো। তিনি মসজিদ মাদ্রাসার পাশাপাশি মঠ-মন্দির, গির্জা প্রতিষ্ঠা করে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। জিয়া ধর্মীয় পরিচয়ে নয়, বাংলাদেশি হিসেবে সবার স্ব-স্ব ধর্ম পালনের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেন। তিনি প্রতিদিন ১৬-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করতেন। সময় সময় জনগণের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য মধ্য রাতে বের হয়ে যেতেন এবং চলার পথে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে কোনো প্রটোকল না নিয়ে গ্রামের মেঠোপথে হাঁটা শুরু করতেন এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানুষের সার্বিক অবস্থার খোঁজখবর নিতেন।
জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক জারিকৃত সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি করার গণতান্ত্রিক ধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও এদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য ১৯ দফা যুগান্তকারী কর্মসূচি ঘোষণা করে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন, খাল খনন, মৎস্য চাষ, শিল্প বিপ্লব, শিক্ষা বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব ও বন্ধ কলকারখানা চালুর মাধ্যমে দেশকে আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের বদনাম ঘুচিয়ে স্বনির্ভর দেশে পরিণত করেন। তার আমলেই প্রথম বিদেশে চাল রপ্তানি করা হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি, বিদেশি বিনিয়োগ, দেশে প্রথম গার্মেন্ট শিল্প ও ইপিজেড প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি প্রতিবেশী দেশসহ সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর সাথে বিশেষ সুসম্পর্ক, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারে প্রবেশ তার বৈদেশিক নীতির অভূতপূর্ব সাফল্য। তিনি ছিলেন সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, যুব ও মহিলাদের কর্মসংস্থান, দেশে খেলাধুলার উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। তিনি ছিলেন দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘এদেশের মাটি ও মানুষ আমাদের সংস্কৃতির উৎস’, বাংলাদেশ আমাদের শেষ ঠিকানা। তাই তার সভা-সমাবেশে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’ গানের সাথে হাততালির মাধ্যমে তিনি অনুষ্ঠান শুরু করতেন। তার শাসন আমলে জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখায় মহান নেতা শেরে বাংলা এ কে এম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ জাতীয় নেতাদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বিশাল হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে গেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ছিলেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন শেষে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের ৪ নম্বর কক্ষে ঘুমে নিমজ্জিত। বাইরে মূষলধারে বজ্রবৃষ্টি। সে সময়ের একদল বিপদগামী সেনা কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার হয়ে এদেশের গণমানুষের নেতা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে। জিয়াউর রহমান কর্মজীবন শুরু করেন সৈনিক হিসেবে এবং তার জীবনাবসান হয় একজন সফল রাজনীতিবিদ ও গণমানুষের নেতা হিসেবে। ঢাকা মানিকমিয়া এভিনিউতে স্মরণকালের বৃহৎ নামাজে জানাজা তার প্রতি জনগণের ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শের কর্মী-সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের উচিত জিয়াউর রহমানকে বুকে ধারণ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে জিয়াউর রহমানের কর্মময় আদর্শ তুলে ধরা।

 লেখক : সাবেক দফতর সম্পাদক, বিএনপি-চট্টগ্রাম মহানগর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন