মাহমুদ ইউসুফ
কেবল বাহুবল বা অস্ত্রবল বা জনবল দিয়ে দেশ রক্ষা হয় না। দেশ রক্ষার জন্য দরকার জাতীয় ঐক্য এবং নৈতিক মনোবল। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, প্রশাসনযন্ত্র এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর সমন্বয় সাধনে যেকোনো রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার মৌলিক শর্ত। এর সাথে দরকার নৈতিকতা, আদর্শ, দৃঢ় চেতনা, সুশিক্ষা, সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ^াস। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এগার ও বারো শতকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এর সবগুলোই ছিল অনুপস্থিত। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ছিল সবমৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমজনতার মানবাধিকার বলতে কিছু ছিল না। তৃণমূল জনসাধারণ ও সরকারের অবস্থান তখন দুই মেরুতে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দাসত্ব, শোষণ, লুণ্ঠন, গ্লানি, বঞ্চনায় জর্জরিত বাংলার মানুষ। সেনদের আগ্রাসন প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চরমপত্র খ্যাত বিশিষ্ট সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী এম আর আখতার মুকুল বলেছেন, “ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং ক্ষাত্র মতে বিশ^াসী বহিরাগত ও অবাঙালি সেন রাজারা যুগের পর যুগ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর এমন অত্যাচার অব্যাহত রেখেছিল যে, ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের সময় স্থানীয় অধিবাসীদের কেউই রাজা লক্ষ্মণ সেনের পক্ষে অস্ত্র তুলে নেয়নি। সম্ভবতঃ সর্বশেষ সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন এ ব্যাপারে অবহিত ছিলেন বলেই কোনরকম লড়াই ছাড়াই রাজধানী ছেড়ে স্বপরিবারে পলায়ন করেছিলেন। একটা বহিরাগত শাসকগোষ্ঠী যখন নিজেদের কৃতকর্মের জন্য স্থানীয় গণমানুষের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয় এবং জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে বাধ্য। ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করছে।”(এম আর আখতার মুকুল, কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, সাগর পাবলিশার্স, ঢাকা, প্রকাশ ১৯৮৭, পৃ. ২৪৫)
সার্বিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তুর্কি মহাবীর বখতিয়ারের আবির্ভাব। সূচিত হয় বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন এক বিপ্লবী অধ্যায়। এর ধারাবাহিকতাতেই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন মানচিত্র। আজকে দেশের ১৭ কোটি মানুষ স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে গর্বিত। এই স্বাধীনতার ভিত্তি রচনা করেছিলেন ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি। বিষয়টি অনেকের কাছে খটকা লাগতে পারে, অবিশ^াস্য বা বিতর্কিত মনে হতে পারে, রহস্য বা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতে পারে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা! কিন্তু এটা চূড়ান্ত সত্য। হক-বাতিলের যুদ্ধে বখতিয়ার জয়লাভ করেন। সেই জয়ের সাড়ে সাতশ’ বছর পর ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। বর্তমান বাংলাদেশ অংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় ভারত থেকে বিমুক্ত হয়। যদি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হতো তাহলে এটা ভারতের অংশেই থাকতো। আর বখতিয়ারের বঙ্গ জয়ের কারণেই এদেশে ইসলামের ব্যাপক প্রচার প্রসার সম্ভব হয়। ফলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এ অঞ্চল পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয়। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, বাঙালি মুসলমানদের ভোটেই পাকিস্তান জন্মলাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভোটে পাকিস্তান কায়েম হয়নি। ১৯৭১ সালে এ পাকিস্তান থেকেই বাংলাদেশের জন্ম। তাই বখতিয়ারই এ জাতিরাষ্ট্রের আদি জনক। প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তবে স্বাধীন সুলতানি আমলের (১৩৩৮-১৫৩৮) সে গৌরবময় বাংলার পুরোটা আমরা পাইনি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ও বর্ণহিন্দুদের ষড়যন্ত্রে।
সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষবাদী, নাস্তিক, মুরতাদ, রবীন্দ্রপূজারি, কমিউনিস্ট, শাহবাগী, ধর্মান্ধ, ধর্মব্যবসায়ী, বাম-রামপন্থীদের বখতিয়ারকে নিষ্প্রয়োজন। বাইবেলের অনুসারী খ্রিস্টান, গৌতমবুদ্ধের অনুসারী বৌদ্ধ সম্প্রদায় বা ভ্রান্ত মতবাদী উপজাতি বা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীরও বখতিয়ারকে দরকার নাও হতে পারে। আর বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, গিতার অনুসারী হিন্দু দাবিদার মুশরিক পৌত্তলিকদের তো বখতিয়ার চক্ষুশূল; জনমশত্রু। কিন্তু বখতিয়ারকে তাদের দরকার প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে, হামেশা যারা আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দিন ইসলাম কায়েম করতে চায়। পিতাকে বাদ দিয়ে পুত্রের চলে না। পিতার আদর্শকে ধারণ করেই পুত্রকে বাঁচতে হবে। শুধু নিজে ধারণ নয়, সামগ্রিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করাই হবে তার আসল কাজ। যে সন্তান পিতাকে ভুলে যায়, জনককে স্মরণ করে না সে অবশ্যই সুসন্তান নয়। তার মতো হতভাগ্য দুনিয়ায় দ্বিতীয় আর নেই। বখতিয়ার খিলজিও আমাদের পিতৃতুল্য।
এ দেশে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, শান্তির পতাকা উড্ডীন করেন ইতিহাসের মহানায়ক বখতিয়ার। ইসলাম হলো পরশ পাথর যার পরশে লোহাও সোনা হয়ে যায়। এ পরশ পাথর বহন করে এনেছেন বখতিয়ার। প্রতিষ্ঠা করেছেন ইসলামি ভাবধারার স্বাধীন রাষ্ট্র। ইসলামের ঝা-া তুলে ধরেছেন সবার ওপরে। দুর্গম পাহাড় পর্বত, স্বাপদসঙ্কুল বনজঙ্গল, খর¯্রােতা নদ-নদী পেরিয়ে বহুক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে সুদূর আফগানিস্তান থেকে এ দেশে এসেছেন কুরআনের বাণী নিয়ে, সত্যের আলো ছড়াতে, বাতিলের দর্প অহঙ্কার চূর্ণ করে দিতে। ওই সময়ের কথা ভাবতে হবে। বর্তমানের বিমান, ট্রেন, অত্যাধুনিক স্থলযানের হিসেবে তাল মেলালে চলবে না। নৌকা, পদব্রজ, পালকি বা হাতি-ঘোড়া ছাড়া ছিল না কোনো যানবাহন। অপরিচিত মানুষ, অচেনা পথ, দূরদেশ ওসব বিষয় বাদই দিলাম। চারদিকে শত্রু আর শত্রু। জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। এছাড়া আছে নানা প্রজাতির হিং¯্র জন্তু জানোয়ার। সামনেই শত্রু সৈন্য, প্রতি পদে পদে বিপদ। এতকিছু উপেক্ষা করে দিন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে অবিশ^াসীদের দরজায় কড়া নাড়েন বখতিয়ার। অথচ আমরা পারি না প্রতিবেশী একজন সেক্যুলারের কাছে মহানবীর মাহাত্ম্য তুলে ধরতে। পারি না তার কাছে কুরআনের দাওয়াত পৌঁছাতে। তারপরও আমরা দাবি করি মুসলিম! জন্মসূত্রেই যদি মুসলিম হওয়া যায় তাহলে আদম শাহ, শাহ মাখদুম, শাহজালাল, শাহ পরান, মাহিসওয়ার, ইরাক ইয়েমেন আরব থেকে এদেশে আসার কী দরকার ছিল?
ইসলাম চিরপ্রগতিশীল ধর্ম। এর চিরন্তন আহ্বান থাকবে চিরকাল। পৃথিবীর মানুষকে শান্তির পথে স্থিতিশীলতার পথে নিয়ে আসাই এর মৌলিক দায়িত্ব। দুনিয়ার যেকোনো প্রান্ত থেকেই ডাক আসুক না কেন নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত বনি আদমের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের অপরিহার্য দাবি। ইসলামে জাতীয়তাবাদ বা সীমারেখার কোনো স্থান নেই। পৃথিবীটাই তার দেশ। মক্কা, মদিনা হলো তার কেন্দ্র বা রাজধানী। যেটা পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলও বটে। ইসলাম সমগ্র দুনিয়ার জন্য, মহানবী (সা.) সমগ্র দুনিয়ার জন্য, মুসলিমরাও সমগ্র দুনিয়ার জন্য। নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে থাকার নাম ইসলাম বা মুসলিম নয়। জাতীয়তাবাদ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বর্ডার, নির্দিষ্ট সীমারেখা ইসলাম অনুমোদন দেয় না।
রাজা দাহিরের কারাগার থেকে এক ধর্ষিত তরুণীর চিঠি পেয়ে সিংহের মতো গর্জে ওঠেছিলেন বসরার শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। স্পেনের রাজা রডারিক কর্তৃক এক ইহুদি কন্যা ফ্লোরিন্ডার বলাৎকারের খবরে প্রচ- ঝাঁকুনি দেয় মুসার হৃদয়ে। তদ্রুপ বাংলার নির্যাতিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আর্তচিৎকারে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে আসেন অসীম সাহসী বীর বখতিয়ার। উদ্ধার করেন শতাব্দিকালব্যাপী গৃহকোণে আবদ্ধ বাকহীন বাঙালিদের অত্যাচারী সেন-বর্মনদের কবল থেকে। এক্ষেত্রে অষ্টম শতকের মুহাম্মাদ বিন কাসিম, তারিক বিন যিয়াদ বা বখতিয়ার সমমর্যাদার অধিকারী। বখতিয়ার গড়েছিলেন তাওহিদি রাষ্ট্র, বুলন্দ করেছিলেন আল্লাহু আকবার শ্লোগান। সেই রাষ্ট্র কেড়ে নিয়েছে ক্রুসেড নেতা লর্ড ক্লাইভ ও জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদ, রায়দুর্লভ, গৌতম মিত্র মাড়োয়ারিরা। এখন সময় এসেছে বখতিয়ার সৃষ্ট সেই মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। মহানবীর আদর্শই বখতিয়ারের আদর্শ। তাই বখতিয়ারের সেই আদর্শকে লালন করেই বর্তমান জাহেলি সমাজকে ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে, গড়তে হবে ইসলামের সাম্য ও ভাতৃত্বে পরিপূর্ণ আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
য় লেখক : গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন