হজ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- ইচ্ছা করা, সাক্ষাত করা, সফর করা, ভ্রমণ করা ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় হজ বলা হয়- নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ পদ্ধতিতে কিছু ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করা। অর্থাৎ- আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাঁর পবিত্র ঘর কা’বা শরীফ প্রদক্ষিণ করা, আরাফাত ও মুজদালাফায় অবস্থান করা ইত্যাদি। জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধরিত সময়। এ সময় হাজিরা আল্লাহর পবিত্র ঘর কা’বা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা ইত্যাদি বরকতময় স্থানে অবস্থান করে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করেন। হজের পূর্বে অথবা পরে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক যিয়ারত করেন। মদিনার বরকতময় স্থানসমুহ তথা জান্নাতুল বাকী, উহুদ পাহাড়, বদর প্রান্তর-সহ বহু ঐতিহাসিক স্থান দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের একটি হচ্ছে হজ। এটি একটি আবশ্যকীয় গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ আদায় করা ফরজ। এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- ‘যে সকল মুসলমানদের পথের সামর্থ আছে, তাদের ওপর আল্লাহর জন্য হজ পালন করা কর্তব্য। যে লোক তা মানে না (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ পৃথিবীর কোন কিছুই পরোয়া করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান- ৯৭)
হজ আদায়ের জন্য আর্থিক সামর্থ থাকার পাশাপাশি শারিরিক সামর্থ থাকাও জরুরী। হজ ফরজ হওয়ার পর যদি পরবর্তীতে কোনো ব্যক্তি স¤পদহারা হয়ে যায় বা শারিরিক সামর্থ হারিয়ে ফেলে তবে তার ওপর ফরজ হজ হওয়ার হুকুম রহিত হবে না। সময়মত হজ আদায় না করার পরিণতি সম্পর্কে হাদিস শরীফে কঠোর হুশিয়ারি উচ্ছারিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তির মক্কা শরীফ যাতায়াতের সম্বল সামর্থ রয়েছে কিন্তু হজ আদায় করেনি, সে যেন ইহুদী বা খৃষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করে।’ (মুসলিম)
সুতরাং প্রত্যেক সামর্থবানের জন্য উচিৎ- ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ এই বিধানটি সঠিক সময়ে আদায় করে নেওয়া। এমনও হতে পারে বিলম্ব করার কারণে অসুস্থতা এসে যেতে পারে কিংবা আর্থিক সামর্থ নাও থাকতে পারে। মৃত্যু কখনজানি এসে যায়! সম্পদ কখনজানি বিলীন হয়ে যায়! হজ ফরজ থাকা অবস্থায় যদি মৃত্যু হয় তাহলে পরিণতি ভালো হবে না।
আল্লাহর সন্তুষ্টির আসায় সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা হজ আদায় করে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত রহমত ও বরকত। হজ আদায় করতে প্রচুর অর্থ সম্পদ ব্যয় হওয়ার কারণে সম্পদ কমে না। এক বর্ণনায় রয়েছে- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হজ ও ওমরাহ সফরে এই বৈশিষ্ট্য রেখেছেন যে, দূর-দূরান্ত থেকে হজে আগমন করতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, এর কারণে পার্থিব দারিদ্র্য ও উপবাসে নিমজ্জিত হতে হয় না; বরং হজ ও ওমরায় ব্যয় করলে দারিদ্র্যতা ও অভাবগ্রস্ততা দূর হয়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা আসে। এ প্রসংঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘দূর-দূরান্ত থেকে যারা এসে উপস্থিত হয়, তা তাদেরই উপকারে নিমিত্ত।’ (সূরা হজ- ২৯)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হজ্জে মাবরুর বা কবুল হজের বিনিময় হলো জান্নাত।’ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যে হজ করে এবং তাতে অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে, যেন সে আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে এসেছে; অর্থাৎ জন্মের অবস্থায় শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সে-ও তদ্উপই হয়ে যায়। (বোখারী-মুসলিম)
কাবাগৃহে সর্বপ্রথম হজ আদায় করেন হযরত আদম (আ.)। তারপর অন্যান্য নবী-রাসূলগণ এ দায়িত্ব পালন করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সময় থেকে হজ ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত হয়। ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে সিরিয়া থেকে হিযরত করে কা’বা শরীফের অদূরে নির্জন ভুখন্ডে আসেন। সে সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে তিনটি নির্দেশ দেন- ১. আমার ইবাদাতে কাউকে শরীক করো না। ২. আমার গৃহকে (কা’বা গৃহকে) পবিত্র রাখো। ৩. মানুষের মধ্যে বায়তুল্লাহর হজ ফরজ হওয়ার ঘোষণা দাও। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার করো। তারা আসবে পায়ে হেটে এবং সর্বপ্রকার বাহনে সোওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।’ (সূরা হজ- ২৮)
এ আদেশের পর হযরত ইব্রাহিম (আ.) মাকামে ইব্রাহীমে দাড়িয়ে উচ্ছ কণ্ঠে হজের ঘোষণা করেন। কোন কোন বর্ণনায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন- ‘লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো।’ ওই বর্ণনায় আরো উল্লেখ আছে যে, হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এই ঘোষণাটি স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেয়া হয়। শুধু তখনকার সময়ের জীবিত মানুষ পর্যন্ত নয়; বরং ভবিষ্যতে কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আগমনকারী ছিলো, তাদের সবার কান পর্যন্ত এ ঘোষণার আওয়াজ পৌছে দেয়া হয়। যার যার ভাগ্যে আল্লাহ তা’লা হজ লিখে দিয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই এই আওয়াজের জবাবে ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলেছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ইব্রাহীমি আওয়াজের এই জওয়াবই হলো হজে ‘লাব্বাইকা’ বলার মূল ভিত্তি। (তাফসিরে মা’রিফুল কুরআন)
মহান আল্লাহর এ আদেশ পালনার্থে হজের সময় বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান কা’বা শরীফে এসে সমবেত হন। বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলে কাধেকাধ মিলিয়ে সাদা রঙের সেলাই বিহীন বিশেষ পোশাক পড়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিতির স্বীকৃতি দেন। তারা নিজেদের উপস্থিতি ও একত্ববাদের স্বীকৃতি স্বরূপ ঘোষণা করেন- ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ অর্থ- ‘আমি হাজির তোমার সান্নিধ্যে, হে আল্লাহ! আমি হাজির তোমার দরবারে, আমি হাজির তোমার দরজায়, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির তোমার দরগায়। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, সকল নিয়ামত তোমারই, আর তোমার রাজ্যে তোমার কোনো অংশীদার নেই।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন