আবুল কাসেম হায়দার
বড় বাজেট বড় সমস্যা। বড় আশা, বড় সম্ভাবনা নিয়ে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট গত ২ জুন ’১৬ পেশ করেছেন। বড় স্বপ্ন ও কঠিন বাস্তবতা নিয়ে এই বাজেট এসেছে। ৩ লক্ষ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয়, ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা আয়, আর ৯৭ লক্ষ ৮৫৩ কোটি ঘাটতি দেখিয়ে এই বাজেট এসেছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘সমৃদ্ধি অর্জনের অভিযাত্রায় অনেকটা পথ এগুলেও আমাদের যেতে হবে আরো অনেক দূরে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সাত বছরে আমাদের নিরন্তর কর্ম প্রচেষ্টার সঙ্গে সর্বস্তরের জনগণের একাত্মতা, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ধারাকে নির্বিঘœ ও গতিশীল রেখেছে। এতে সবার জীবনে এসেছে আয়, উন্নতি ও স্বাচ্ছন্দ্য’।
বাজেটের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক :
১. আকাক্সক্ষা বিপুল, সামর্থ্য কম। আয়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী। বাজেট বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। মোট বাজেটের ৭১.৩ শতাংশ অর্থই আসবে জনগণের কাছ থেকে। বাকি অর্থ আসবে দান থেকে। বাজেটে প্রবৃদ্ধির আশা করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। বিগত বছরে যা ছিল ৭ শতাংশ। অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত বাজেটে রয়েছে ৯ শতাংশ বৈদেশিক ঋণ, ১.৬ শতাংশ বৈদেশিক অনুদান, ১৮.১ শতাংশ অভ্যন্তরীণ আয় থেকে, ৯.৫ শতাংশ আসবে কর ব্যতীত অন্যান্য খাত থেকে, ২.১ শতাংশ এনবিআর বহির্ভূত কর, ৫৯.৭ শতাংশ আসবে নির্বাচিত কর থেকে।
২. ১০টি মেগা প্রকল্পের জন্য মেগা বাজেট রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। এটি বাজেটের একটি ভালো দিক। বড় বড় প্রকল্পগুলোকে আলাদা করে, আলাদা বাজেট দেখানোর ফলে বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রকল্প দ্রুত সমাধান করা সহজ হবে। মেগা প্রকল্পসমূহ হচ্ছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেল প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা মেট্রো রেল প্রকল্প, আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লাইনবিশিষ্ট সড়ক প্রকল্প প্রভৃতি।
৩. ছোট ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার আরও ১ বছর পর্যন্ত প্যাকেজ ভ্যাট আদায় নিয়ম ঠিক রেখেছেন। এই প্যাকেজসমূহকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ২৮ হাজার টাকা, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনে ২০ হাজার টাকা, জেলা শহরে ১৪ হাজার টাকা, অন্যান্য এলাকায় ৭ হাজার টাকা। তবে প্যাকেজ ঠিক রাখলেও টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ করেছেন। তাতে ছোট ব্যবসায়ীদের উপর চাপের সৃষ্টি হবে।
যেসব বিষয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন :
শিক্ষা খাতে : সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শিক্ষা খাতে। কিন্তু তাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা খাতে জিডিপি তুলনায় বাজেট দেওয়া হয়েছে ১.৯ শতাংশ মাত্র। অথচ ভুটানে আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। ভুটানে জিডিপি তুলনায় ৫.৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকে। আফগানিস্তান, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানে জিডিপি তুলনায় বাজেট হচ্ছে যথাক্রমে ৪.৬ শতাংশ, ৪.১ শতাংশ, ৩.৯ শতাংশ, ২.৫ শতাংশ। আর আমাদের সর্বনি¤েœ ১.৯ শতাংশ। বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ প্রায় ৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে এমপিও করার অপেক্ষায়। হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানও নি¤œমুখী হতে বাধ্য। তাই বাজেট পর্যালোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী এই খাতে বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করে সমস্যাসমূহের আশু সমাধান করবেন।
তৈরি পোশাক শিল্প তথা বস্ত্রখাত : বিগত বছরে তৈরি পোশাক শিল্পে এআইটি ছিল দশমিক ৩০ শতাংশ। বস্ত্রখাতে ছিল এআইটি দশমিক ৬০ শতাংশ। করপোরেট কর ছিল দশমিক ৩৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী করপোরেট কর কমিয়ে করেছেন ২০ শতাংশ। কিন্তু এআইটি নির্ধারণ করেছেন দেড় শতাংশ। বিপুল এআইটি কর্তনের ফলে তৈরি পোশাক শিল্পসহ বস্ত্র খাত বেশ চাপের মুখে পড়বে। দেশের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প তথা বস্ত্রখাত। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই খাতে কর্মে নিয়োজিত। বস্ত্রখাতের স্পিনিং, ডাইং, ফিনিশিং ও উইভিং খাত আর একটা বৃহত্তম খাত। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশ থেকে ২ হাজার ৫৪৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। কাজেই এই খাতকে আরও বেশি সুনজরে রাখতে হবে। তৈরি পোশাকসহ বস্ত্রখাতের সকল উপার্জনের উৎস কর ৩০ শতাংশে নিয়ে আসা প্রয়োজন। আর কর্পোরেট করও ২০ শতাংশে ঠিক রাখা জরুরি। আশা করা যায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
শিল্পখাত চাপের মুখে : ঘোষিত বাজেটকে অনেকটা গতানুগতিক বাজেট বলা যায়। নতুন শিল্পে বিনিয়োগের বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্পে কর্পোরেট কর ৩০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। তাও এআইটি বাড়িয়ে কর হয়েছে দেড় শতাংশ। শিল্প নীতিতে বিভিন্ন শিল্পখাতকে বেশ উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু বাজেটে তা তেমন দেখা গেল না।
ভ্যাটের বোঝা বাড়ছে : অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির জন্য এবারের বাজেটে ভ্যাট আদায় অধিক বাস্তবায়ন ও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এমন কি মোবাইল বিলের উপর ভ্যাট আরোপ করে নতুন বার্তা দিয়েছেন। মানুষের কথা বলার উপর অতিরিক্ত কর আরোপ কোনোক্রমেই ঠিক হয়নি। গরিব ও সাধারণ মানুষ ভ্যাটের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়বে। বর্তমানে ২২টি খাত সংকুচিত মূল্য ভিত্তিতে বিশেষভাবে ভ্যাট ছাড়ের সুবিধা পাচ্ছে। ৮টি খাতে বিশেষ কর উঠিয়ে বর্ধিত হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। মোটরগাড়ি মেরামতে ভ্যাটের হার ৭ থেকে বাড়িয়ে ১০ করা হয়েছে। প্যাকেজ ভ্যাটও বৃদ্ধি করা হয়েছে। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে প্যাকেজ ভ্যাট চালু রয়েছে। কিন্তু ভ্যাট বৃদ্ধি করে ব্যবসায়ীদের নতুন সমস্যায় ফেলেছে। আবার বিবেচনা করে প্যাকেজ ভ্যাট পূর্বের অবস্থানে নেওয়া প্রয়োজন।
সম্পূরক শুল্ক : প্রস্তাবিত বাজেটে অধিকাংশ আমদানিকৃত পণ্যের সম্পূরক শুল্ক প্রত্যহার বা হ্রাস করা হয়েছে। তাতে আমদানি উৎসাহিত হবে। বিদেশি পণ্য কম মূল্যে পাওয়া যাবে। কিন্তু তাতে দেশীয় পণ্য মূল্যের হ্রাসের ফলে বাজার হারাবে। এমনিতে আমাদের দেশের শিল্পখাত প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার পণ্যের চাপে দিশেহারা। এমন সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার বা হ্রাসের ফলে দেশীয় পণ্য বাজার হারাবে। দেশীয় শিল্প রক্ষার স্থানে সম্পূরক শুল্ক পূর্বের মতো বহাল রাখা প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশীয় শিল্প স্থাপনে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবে না। লাভ না হলে কেউ শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসার কোনো কারণ নেই।
বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা : অর্থমন্ত্রী মনে করেন বাজেট উচ্চাভিলাষী কিন্তু বাস্তবায়ন যোগ্য। তিনি মনে করেন, এনবিআর’র সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। জনশক্তি বেশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। অভিজ্ঞতাও বেশ বেড়েছে। তাই বাজেট বাস্তবায়নে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু বাস্তবে সরকারের জনশক্তির সক্ষমতা এতবড় বাজেট বাস্তবায়নের পর্যায়ে এখনও বৃদ্ধি পায়নি। তবে দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ বাণিজ্যে সক্ষমতা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এনবিআর’র সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন। অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। ভালো ভালো চৌকস কর্মকর্তা নিয়োগ করা প্রয়োজন। কিন্তু নিয়োগ বাণিজ্য হওয়ার কারণে দক্ষ, অভিজ্ঞ, শিক্ষিত জনশক্তির একটি বড় অংশ সরকারি চাকরিতে যেতে পারে না। এমনকি পরীক্ষায় দুর্নীতির ফলে, দলীয়করণের ফলে ভালো ছাত্রছাত্রীরা কোনো চাকরি পাচ্ছে না। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। আশা করি, সমাপনী বক্তব্যে এ বিষয়ে বেশকিছু নির্দেশনা অর্থমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে, সরকারের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেবেন। যাতে করে আগামী বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা বেশ বৃদ্ধি পেতে সহায়ক হবে।
সুশাসন ও আইনের শাসনের অভাব : দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ শান্তিতে নেই। প্রকল্প খাতে বিনিয়োগে সরকার বিনিয়োগ সাহায্য পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবস্থায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। একদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানি খাতের স্বল্পতাই মূলত দায়ী, তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এই অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। বাজেটে মন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করেননি। তবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তাতে আশা করছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো হয়ে যাবে। সকল অন্যায়, অবিচার, অনিয়ম দূর হয়ে দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে! তা হলে ভালো। আমারা খুব সুখে থাকব। আমাদের দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ প্রচুর বৃদ্ধি পাবে।
ঘুষ, দুর্নীতি প্রসঙ্গ : দেশে দুর্নীতি এখন তৃণমূল পর্যায় পৌঁছে গেছে। ঘুষ, দুর্নীতি, অনাচার, অনিয়ম আজ নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থার জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্য ছিল একটি সুখি, সুন্দর, দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ কায়েমের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এ বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা করেননি। উন্নয়ন খাতের অর্ধেক অর্থ লোপাট হচ্ছে, তা কি আমরা বিশ^াস করি। যদি না হয় তবে কেন উন্নতি চোখে পড়ে না। কোনো রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরির পর, বছর শেষে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরে থেকে যাচ্ছে। জবাব দেওয়ার কেউ নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন আর দুর্র্নীতি দমনে ব্যস্ত নয়। এখন দুর্নীতি দমন কমিশন চারিত্রিক সনদ প্রদানে ব্যস্ত। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর আজ্ঞা পালনে যেন দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যস্ত। এইভাবে চললে দেশে দুর্নীতির পাহাড় সৃষ্টি হবে। দুর্নীতি, ঘুষ ইত্যাদির লাগামকে শক্ত হাতে ধরতে হবে। দুর্নীতি, ঘুষকে ‘না’ বলতে হবে। তবেই সমাজে স্থিতি আসবে। উন্নতি আসবে, মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারবে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ : মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বেশ পুরনো প্রতিষ্ঠান। তাদের ছক বাধা বেশকিছু কাজকর্ম রয়েছে। কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মাদকের ব্যবসা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে শহরে এলে ইয়াবাসহ এই বিভিন্ন প্রকার নেশার ব্যবহার দেখা যেত। এখন মাদকের ব্যবহার তৃণমূলে তথা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। যুবসমাজ আজ মাদকে আক্রান্ত হচ্ছে প্রচুর। কিছু সরকারি ও বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র এই সকল মাদকাশক্ত যুবক-যুবতীদের নিরাময় করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার পরিমাণ খুব সীমিত। দিনের পর দিন মাদকের ছোবল থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না।
অর্থমন্ত্রী বাজেটে সামান্য অর্থ রেখেছেন মাদক নির্মূল খাতের জন্য। কিন্তু তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। দেশ থেকে মাদককে দূর করতে হলে পুরো সরকারকে আন্তরিক হয়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মাদক আজ মহামারী আকারে দেশে দেখা দিয়েছে। এই মহামারী থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে। তাই জাতীয় ভিত্তিক কর্মসূচির প্রয়োজন। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু কোথাও কোথাও দেখা যায় পুলিশের কিছু অসাধু লোক নিজেরাই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। আবার কোথাও দেখা যায়, খোদ সংসদ সদস্যই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে অভিযুক্ত। তাহলে কীভাবে দেশ থেকে মাদক দূর হবে?
বাজেট বক্তৃতায় এবং মন্ত্রিসভায় বিষয়টিকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার। স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ তার বিরাট অংশ মাদক ও মাদকজাতীয়দ্রব্য ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়। মাদককে ‘না’ বলতে পারলে স্বাস্থ্যখাতের বিপুল পরিমাণ অর্থ বেঁচে যাবে।
বিনিয়োগ বৃদ্ধি : প্রস্তাবিত বাজেটে বিশাল ব্যয় মেটাতে ২ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকার চেয়ে বেশি অর্থ এনবিআরকে যোগান দিতে হবে। তাই জনগণের উপর চাপ বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ বৃদ্ধি বা বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার মতো কোনো পদক্ষেপ বর্তমান বাজেটে দেখছি না। বিনিয়োগ বৃদ্ধি না হলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে না। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না হলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পেলে সমাজে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে। আমাদের বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা গ্যাস ও বিদ্যুতের স্বল্পতা। এখনও অনেক কারখানা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে চলতে পারছে না। গ্যাসের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখন দেশে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে তার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ খাত ও গ্যাস খাত : বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার বিগত ৭ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ১৪.৫৩৯ মেগাওয়াট। কিন্তু প্রকৃত উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৮.৩৪৮ মেগাওয়াট। দেশে বর্তমানে গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক ১৭৪৪-২৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু চাহিদা রয়েছে উৎপাদন ক্ষমতার দ্বিগুণ। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হলে ভারি শিল্প স্থাপন হবে না। তাই বিগত ৮ বছর ধরে দেশে কোনো ভারি শিল্প স্থাপিত হচ্ছে না।
অর্থমন্ত্রী বাজেটে বিদ্যুতের জন্য একটি রূপরেখা দিয়েছেন। কিন্তু গ্যাস সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো বক্তব্য আসেনি। তার অর্থ হচ্ছে গ্যাস উত্তোলন, সরবরাহ ধীর গতিতেই হবে। আগামী বছরগুলোতে গ্যাসের ও বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না হলে বিনিয়োগ হবে না। বাজেট প্রতি বছরের জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিচ্ছবি। আগামী বছরটি কেমন যাবে। কেমন যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তা নিয়ে বাজেট দেওয়া হয়ে থাকে। আগামী এক বছরে আমাদের উন্নতির মাত্রা কোন পর্যন্ত গিয়ে ঠেকবে তাই বাজেটে প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট : দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনে বাধ্য হয়ে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট কার্যকরের আদেশ বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বর্তমানে এক বিশেষ আদেশে এনবিআর নতুন করে সেই আদেশ বাতিল করে ভ্যাট কার্যকর করেছে। ফলে এখন থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের টিউশন ফি’র ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে এই অনৈতিক ও দ্বিমুখী আচরণ বন্ধ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রত্যাহার করা।
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিফলন নেই বাজেটে : প্রস্তাবিত বাজেটে ধর্মীয় বৈষম্য করা হয়েছে। শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য অতিরিক্ত ২শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করা হয়েছে। দেশের ৯৫ ভাগ জনগোষ্ঠী মুসলমান। দেশে পাঁচ লাখেরও বেশি মসজিদ রয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশই বাঁশের বেড়া বা টিনের তৈরি। ইসলামের দৃষ্টিতে সব মসজিদই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই শুধু বাইতুল মোকাররম মসজিদেই বরাদ্দ প্রদান করলে হবে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মসজিদ, এতিমখানা ও মক্তবের জন্যও বরাদ্দ থাকতে হবে। ইসলামী অনুষঙ্গের জন্য যা বরাদ্দ হয় আনুপাতিকহারে শতকরা ২ জনেরও কম হিন্দু তার চেয়ে অনেক বেশি বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। এবারের বাজেটে নগ্নভাবে হিন্দুদের বিশেষ তোষণ করা হয়েছে। যা ’৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতার খেলাপ। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে তা কুঠারঘাত করেছে।
তাই বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করে মুসলমান সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সাম্প্রদায়ের জন্য আনুপাতিক হারে বরাদ্দ দেওয়া উচিত। এদেশে অল্প হলেও বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও উপজাতি রয়েছে। বাংলাদেশ হিন্দু প্রধান দেশ নয়Ñএটা অর্থমন্ত্রীকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
লেখক : সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
ধয়যধরফবৎ@ুড়ঁঃযমৎড়ঁঢ়নফ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন