শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের মানুষই প্রকৃত বাঙালি

জহির চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:২২ এএম

সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন,‘ বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, বাংলার ঐতিহ্য রক্ষা করে চলছে একমাত্র বাংলাদেশি বাঙালিরা। বিশ্বে ৩০ কোটির বেশি বাঙালি থাকলেও বাংলাদেশের ১৬ কোটি বাঙালিই প্রকৃত বাঙালি। কলকাতার বাঙালিরা প্রকৃত বাঙালি নন, তারা বিশাল ভারত সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাদের দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব নয় । পৃথিবীর প্রকৃত বাঙালিরা বাংলাদেশেই বাস করে। অন্য বাঙালিরা আমাদের ভাই।’ পরিকল্পনা মন্ত্রীর কথাগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। বাংলা সাহিত্যের গর্ব কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘ঢাকা শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়, বাংলা ভাষারও রাজধানী’। শান্ত- মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে নৃত্যকলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে ২০০৯ সালে ঢাকা এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ নিবাসী বাংলাদেশের সন্তান উপমহাদেশের কিংবদন্তী নৃত্যগুরু অমলা শঙ্কর। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালী বলে যে গর্ববোধ করি সেই বাঙালী বাংলাদেশেই আছে। স্যরি, পশ্চিমবঙ্গ অনেক দূর চলে গেছে। সেখানে বাঙালীত্বের পরিচয় আজ আর তেমন একটা খুঁজে পাই না। বাঙালী সংস্কৃতির প্রতিফলন এখানে যেমনটা আছে তা পশ্চিম বঙ্গে নেই। যদিও আমি সেখানেই থাকি তবু এ কথাটা বলতেই হচ্ছে।’

বাংলাদেশই বাংলার ঠিকানা, বাংলাদেশিরাই প্রকৃত বাঙালি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাঙালির খোলসধারী মাত্র-এটা যুগে যুগে প্রমাণিত। আজকের পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ বাদে গোটা পশ্চিমবঙ্গ ছিল রাঢ় অঞ্চলভুক্ত। রাঢ় অঞ্চল ছিল বিশুদ্ধ সংস্কৃতের আওতাভুক্ত । পাটলীপুত্র ছিল সংস্কৃত সাহিত্যের পীঠস্থান। পাটলীপুত্রের অধীন রাঢ় অঞ্চল বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার আওতাভুক্ত থাকায় রাঢ় অঞ্চলে বাংলা ভাষা বিকাশের সুযোগই ছিল না। বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে যখন সাহিত্যেরমানে উন্নীত হয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যের যুগ সূচিত হয়েছে তখন আজকের পশ্চিমবঙ্গ তৎকালীন রাঢ় অঞ্চলে বাংলা ভাষার নামগন্ধ পর্যন্ত ছিল না । এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ তার গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ বাংলাদেশের কালচার’ -এ লিখেছেন, ‘পশ্চিম বাংলায় এই যুগে (বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ) কোনো বাংলা ভাষাই ছিল না, সাহিত্য তো দূরের কথা। আসলে ঐ যুগের পশ্চিমবঙ্গবাসী জাতিতে বাঙালী ছিল না। বিশাল গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অর্ন্তগত ও রাজধানী পাটলীপুত্রের নিকটতম দেশের অধিবাসী হিসাবে পশ্চিম বাঙগালীরা ঐ সময় ছিল জাতিতে ভারতীয় (পৃষ্ঠা-৭৫ )।’ আদি বাংলার অংশই যদি আজকের পশ্চিম বাংলা হতো তাহলে বাংলা সাহিত্যের আদি যুগে পশ্চিমবাংলায় বাংলা ভাষা ও বাঙালি কৃষ্টি লালন-ধারণ, চর্চা বাদ থাকার কথা নয়। বাস্তবতা এটাই যে, বাঙালির দেশ বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই বাংলা ভাষা, বাঙালি কৃষ্টির অঙ্কুরোদগম হয়েছে, বিকাশ, সমৃদ্ধ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গবাসীর ধমনীতে বাঙালিয়ানা নেই ; সংস্কৃত ভাষা, সংস্কৃত সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ভাবধারাতে গঠিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনন। হিন্দি ভাষা ও হিন্দি সংস্কৃতি, হিন্দি রীতি-নীতি-ভাবধারার মা সংস্কৃত ভাষা- সংস্কৃত সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ভাবধারা। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিন্দি ভাষা, হিন্দি সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়েছেন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায়। বাংলাদেশের মানুষকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মানুষই মনে করত না এক সময়। বিশ শতকের গোড়াতে পশ্চিমবঙ্গে একটি জনপ্রিয় বচন ছিল, ‘বাংগাল মনুষ্য নয় উড়ে এক জন্তু / লাফ দিয়া গাছে উঠে লেজ নাই কিন্তু’। এ বচন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ থেকে রচিত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কখনোই মনে করেনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এক দেহ, পশ্চিমবঙ্গ ওবাংলাদেশর মানুষ একই বঙ্গমাতার সন্তান। ইংরেজ শাসনামলে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা আজকের বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপনের শক্ত বিরোধীতা এসেছে পশ্চিম বাংলার অগ্রসর সমাজ থেকে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রচেষ্টা সফল হয়নি পশ্চিম বাংলার এলিট রাজনীতিবিদদের বিরোধীতার কারণে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রকৃত বাঙালি হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলাকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আগ্রহ দেখাত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রকৃত বাঙালি নন বলেই ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলাকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আগ্রহ না দেখিয়ে হিন্দি প্রভাবাধীন ভারত ইউনিয়নে যুক্ত থাকার আগ্রহ দেখিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মৌলিক বাঙালি নয় বলেই তাদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও আবহমান বাংলার কৃষ্টি আঁকড়ে ধরার গরজ নেই। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিয়ানার নাম নিশানা মুছে যাওয়ার আলামত দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। পশ্চিমবাঙ্গের মানুষের চলনে-বলনে, আচার-আচরণে, পোশাক-পরিচ্ছদে, সামাজিক রীতি-নীতিতে, ভাব-ভঙ্গিতে বাঙালিয়ানার যেটুকু অবশিষ্ট আছে তারও বিলোপ-বিলুপ্তির বার্তা পরিষ্কারভাবেই পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিম বাংলার গাড়ির নান্বার প্লেট, সাইনবোর্ড, চিকা, ব্যানার, পোস্টার থেকে বাংলা উধাওয়ের ধারা বহু আগেই সূচিত হয়েছে । কলকাতায় বাংলার চেয়ে হিন্দির দাপট-দৌরাত্ম্য বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন কাজে কলকাতা যাতায়তকারীমাত্রই জানেন। দৈনিক ইত্তেফাকের পরলোকগত সাংবাদিক শফিকুল কবীর জীবদ্দশায় কলকাতা ভ্রমণকালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মন্ত্রণালয় মহাকরণে (রাইটার্স বিল্ডিং) বাংলাভাষার দুরবস্থা দেখে ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘আপকা আতাপাতা লিখ দিজিয়ে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সে প্রতিবেদনে শফিকুল কবীর লিখেছেন, ‘সেন্ট্রাল কলকাতার ডালহৌসি স্ট্রীট, বেন্টিং স্ট্রীট, জিসি এভিনিউ, ধর্মতলা, লেলিন স্ট্রীট, নিউ মার্কেট, চৌরঙ্গী, পার্ক স্ট্রীট এবং আশেপাশের ৪২টি সিনেমা হলে কোনো বাংলা ছবি দেখানো হয় না। ৪টি হলে ইংরেজি আর সব কয়টিতে হিন্দীর জয়জয়কার। সেন্ট্রাল কলকাতার বুকস্টলগুলোতেও একই হাল, বাংলা পত্র-পত্রিকার চাইতে ১০ গুণ বেশি হিন্দি-ইংরেজি ম্যাগাজিনের দাপট। কলকাতা নগরীর অধিকাংশ স্থানে বাঙালীরা পরস্পরও বাংলায় কথা বলে না। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রণালয় মহাকরণ বা রাইটার্স বিল্ডিং এ প্রবেশ করতে গেলে অভ্যর্থনা কক্ষের ডিউটি অফিসার রেজিস্টার খাতা বাড়িয়ে দিয়ে হিন্দিতে বলেন, ‘আপকা আতাপাতা লিখ দিজিয়ে।’ বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠী মনে করে পশ্চিমবঙ্গ বাঙালির তীর্থস্থান, পশ্চিমবঙ্গ বাংলার আঁতুর ঘর। এ গোষ্ঠীর লোকজন পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের পদতলে বসে, শান্তি নিকেতনের ধুলো গায়ে মেখে নিজের বাঙালিত্ব নিখাদ করেন। এ গোষ্ঠী বাংলার দেশ বাংলাদেশের মর্যাদা ভুলন্ঠিত করছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের শিরায়-উপশিরায় হিন্দি ভাবধারা বহমান বলেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলা ভাষার চেয়ে হিন্দি ভাষায় কথা বলে অধিকতর স্বচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাংলা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আদি বা মাতৃভাষা হলে বাংলা ভাষার চেয়ে হিন্দি ভাষা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রিয় হতো না, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পারস্পরিক কথোপকথনে হিন্দি ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। এটাই ঐতিহাসিক সত্য, বাংলা ভাষার অঙ্কুরোদগম বাংলাদেশে, বাংলাদেশের মানুষের মনন গঠিত হয়েছে বাঙালিয়ানার ভাবধারায়। বাংলাদেশের মানুষের মননে বাঙালিয়ানা থাকার কারণেই বাংলাদেশের মানুষকে বিজাতীয় সংষ্কৃতি গিলানোর অপচেষ্টা কখনোই সফল হয়নি। যখনই বাংলাভাষা বা বাংলার হাজার হাজার বছরের লালিত কৃষ্টি বিনাশ-বিলোপের অপচেষ্টা হয়েছে তখনই বাংলা মায়ের সন্তান বাংলাদেশের বাঙালিরা রুখে দাঁড়িয়েছে। এর বহুপ্রমান রয়েছে অতীতে। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় আজকের বাংলাদেশে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস রুখতে বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রাজপথে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলা মায়ের দামাল সন্তানদের জীবনোৎসর্গের ঘটনা বাংলাদেশের বাঙ্গালিদের বাঙালিসত্তা রক্ষার দৃঢ়তা প্রমানের নিকট অতীতের জলজ্যান্ত উদাহরণ। পৃথিবীতে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করে ইতিহাস সৃষ্টি করা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বাঙালিরাই। বাংলাদেশ বাঙালির দেশ, বাংলাদেশের মানুষই প্রকৃত বাঙালি-এটাই শ্বাশত।
লেখক: কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন