শ্ব মুসলিম মিল্লাতের বছরের প্রথম মাস আল মুহাররম। এই শব্দটি আসলে গুণবাচক বিশেষণ, নাম বাচক বিশেষ্য নয়। ইসলামের আগমনের বহু পূর্ব হতে প্রাচীন আরব মক্কার বছরের প্রথম দুই মাস ছিল প্রথম সাফার ও দ্বিতীয় সাফার। আল মুহাররম ও সাফারের পরিবর্তে আল সাফারাইসি এই দ্বিপাক্ষিক রূপের ব্যবহার দেখে তা সহজেই অনুভব করা যায়।
আরবের বর্ষপুঞ্জির ইতিহাস গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করলে দেখা যায় যে, প্রাচীন আরবে বছরের প্রথম অর্ধাংশে তিনটি মাস ছিল। যথা সাফার রবি ও জুমাদা। এই তিনটি মাসের প্রত্যেকটিতে দুটি করে মাস ছিল। যেমন প্রথম সাফার, দ্বিতীয় সাফার, প্রথম রবি, দ্বিতীয় রবি, প্রথম জুমাদা, দ্বিতীয় জুমাদা। যেহেতু দুই সাফারের পরে দুই রবি ও দুই জুমাদা ছিল এবং দুই সাফারের প্রথমটি অলক্ষণীয় পবিত্র মাসগুলোর (আশহুরুল হুরুম) অন্যতম মাস ছিল বলে এর গুনবাচক অ্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল ‘আল মুহাররাম’। যুগ ও কালের ক্রমধারায় আল মুহাররম আখ্যাটিই প্রথম সাফারের পরিবর্তে ধীরে ধীরে বছরের প্রথম মাসের নাম হয়ে গেছে। আর সাফারের সানী মাসটি সাফার নামে আখ্যায়িত হয়েছে। তবে বছরের শেষ অর্ধাংশের মাসগুলোর নাম পূর্ববৎই রয়ে গেছে। যথা: রাজাব, শাবার, রামাদান, শাওয়াল, জুলকাদা, জুলহিজ্জা। আর জুলহিজ্জা মাসও অলক্ষণীয় পবিত্র মাসগুলোর (আশহুরুল হুরুম) অন্যতম হওয়ায় অর্থ বছর ছাড়া অন্যান্য বছরে চারটি অলক্ষণীয় পবিত্র মাসের তিনটি একাধিক্রমে আসত। যেমন- জুলকাদা, জুলহিজ্জা ও মুহাররম। আর রজব মাসটি পৃথকভাবে আসত। যা অদ্যবধি একই রকম আছে।
মহান রাব্বুল আলামীন, চন্দ্রকেই সময়ের পরিমাপক রূপে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ ইহা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এই সকল নিদর্শন বিষদভাবে বিবৃত করেন। (সুরা ইউনুস: আয়াত-৫)।
এই আয়াতে কারিমায় চাঁদের জন্য মানাযিল শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। মানাযিল শব্দটি মানাযিল শব্দের বহুবচন। আরবী জ্যোতির্বিজ্ঞানে চান্দ্র মাসকে ২৮টি মানাযিল এ ভাগ করা হয়েছে। চান্দ্র মাসের এই মানাযিলকে বাংলা ভাষায় তিথি বলা হয়।
তবে চান্দ্র বছরকে সৌর বছরের সাথে একই পর্যায়ে আনায়ন করার জন্য অধি বছর সূত্রে একটি মাসকে বর্ধিত করা হত। বর্ধিত এই মাসটিকে জুলহিজ্জার পরে সংযুক্ত করার নিয়ম ছিল। কিন্তু এই বর্ধিত মাসটি অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস হত না। এর ফলে মুসলিম জ্ঞানী চিন্তাবিদগণ এরূপ গর্হিত মাস বৃদ্ধি করাকে সংশ্লিষ্ট মুহাররম (অলঙ্ঘনীয় পবিত্র) মাসের নতুন করে সাফার নাম দেওয়ার শামিল বলে উল্লেখ করেন। এর দ্বারা আল মুহাররম (অলঙ্ঘনীয়, পবিত্র মাসকে) লঙ্ঘনীয় মাসে পরিণত করা হয়। এটা আল্লাহপাকের প্রদত্ত বছর গণনার নির্দেশের পরিপন্থী। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে: আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস (যুলকাদা, যুলহিজ্জা, মুহাররম ও রাজাব) এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে। যেমন তারা তোমাদের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ করে থাকে এবং জেনে রেখ, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। এই যে মাসকে পিছিয়ে দেয়া কেবল কুফুরীকে বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফিরদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়। তারা একে কোনো বছর বৈধ করে এবং কোনো বছর অবৈধ করে যাতে তারা আল্লাহ যেগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন, সে গুলোর গণনা পূর্ণ করতে পারে। তাদের মন্দ কাজগুলো তাদের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে। আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। (সুরা তাওবা : আয়াত ৩৬-৩৭)। এই আয়াতে কারীমার দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, বছর গণনায় বর্ধিত মাসের কোনো স্থান নেই।
এতো কিছুর পরও প্রাথমিক যুগে বর্ধিত মাস প্রবর্তন করে চান্দ্র বছরকে সৌর বছরের সমপর্যায়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অপচেষ্টা আদৌও ফলবতী হয়নি। কারণ এই যে, প্রাচীন আরবে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত অভাব ছিল প্রচুর সে যুগে শীতকালীন অর্ধ বছর আরম্ভ হত আল মুহাররম মাস দ্বারা। প্রথম ছয় মাসের নাম দেখলে তা সহজেই বোঝা যায়। ইয়াহুদী বছরের ন্যায় আরব বছরও শরৎকালে আরম্ভ হত।
আল কোরআনের ৯নং সূরা তাওবাহ-এর সাইত্রিশ নং আয়াতে বর্ধিত মাস যুক্ত করার রীতি চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর মুসলিম বছরের সমস্ত ঋতুতেই ঘুরে ফিরে আসে। কারণ বারটি চান্দ্রমাসে সর্বদাই তিনশত চুয়ান্ন বা তিনশত পঞ্চান্ন দিন পাওয়া যায়। যেমন বর্তমানে পাওয়া যায় এবং ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু যারা রাত বারটা এক মিনিট হতে দিনের বারটা পর্যন্ত সময়কে দিন বলেন এবং দিনের বারটা মিনিট হতে রাত বারটা পর্যন্ত সময়কে রাত বলেন তারা আল কোরআনে বর্ণিত দিন ও রাতকে অস্বীকার করছেন। সুতরাং আল কোরআন অস্বীকার কারীদের দিন, রাত, মাস এবং বছরের হিসাব সঠিক তো নয়ই বরং গোঁজামিল ছাড়া কিছুই নয়।
আল মুহাররম মাসের দশম দিবসকে আশুরা বলা হয়। হাদীস শরীফে উক্ত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) মদীনায় হিজরত করার পর ইহুদিদের নিকট হতে জানতে পারলেন যে, এই আশুরার দিন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম জালিম কাফের ফেরাউনের বন্দিদশা হতে ইসরাঈলী-বংশধরদের উদ্ধার করেছিলেন এবং ফেরাউন সসৈন্যে সাগরে ডুবে মরে ছিল এ কারণে আল্লাহর শোকারিয়া আদায় স্বরূপ হযরত মূসা (আ:) এই দিনে রোজা পালন করেছিলেন এবং একই কারণে ইহুদিরাও আশুরার দিন রোজা রাখে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা হযরত মূসার সাথে আমাদের সম্পর্ক অগ্রাধিকারমূলক এবং নিকটতম। তখন হতে রাসূলুল্লাহ (সা:) নিজে আশুরার রোজা রাখলেন এবং এইদিনে উম্মাতগণকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। হাদীস শরীফে এতদসংক্রান্ত আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা: (ক) রাসূলুল্লাহ (সা:) সাহাবা কেরামকে আশুরার রোজা পালনের আদেশ দান করেছেন এবং তাদেরকে উৎসাহিত করেছেন। (খ) কতিপয় সাহাবী-রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট আরজ করলেন, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আশুরাকে বড় মনে করে। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন : আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকলে আমি আল মুহাররমের নবম দিনও রোজা রাখব। (গ) পরবর্তীতে রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর হতে রাসূলুল্লাহ (সা:) সাহাবীগণকে আর আশুরার রোজার আদেশ করতেন না, নিষেধও করতেন না। (ঘ) অবশ্য তিনি নিজে রমজানের রোজার অনুরূপ গুরুত্বাকারে বরাবর আশুরার রোজা পালন করতেন। (ঙ) তিনি বলেছেন: রমজানের রোজার পর সর্বাপেক্ষা আফজল মুহাররমের এই রোজা। বস্তুত: আশুরার উল্লেখ দশই মুহাররম অর্থে সুপ্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। যার আবহ এখানো পর্যন্ত একইভাবে অব্যাহত রয়েছে। কতকগুলো- ইসলামী অনুষ্ঠানও রীতি প্রাচীন আরবদের বিশেষত: হযরত ইব্রাহিম (আ:)-এর বংশধরদের মধ্যে তারই নির্দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। যার ফলে আশুরার মর্যাদা বহুগুনে বর্ধিত হয়েছিল। তবে, এই দিনে শুহাদায়ে কারবালা-এর রূহের মাগফেরাত ও মানজেলাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে মুসলিম মিল্লাত দোয়া ও মোনাজাত করে থাকেন। এটা বড়ই বরকতময় কাজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন