মঙ্গলবার ০৮ অক্টােবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ০৪ রবিউস সানী ১৪৪৬ হজিরী

পবিত্র আশুরা সংখ্যা

অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন রা. এর সাহসী লড়াই

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

৬৫৬ সালে ৮২ বছর বয়সে, ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.) বিদ্রোহী আততায়ীদের হাতে শহীদ হওয়ার পর হজরত আলী (রা.) তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফার দায়িত্ব নিতে, প্রথমে বিনীতভাবে অস্বীকার করলেও, কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবির অনুরোধে পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেননি। তাদের মধ্যে ঐরূপ তিনজনের নাম উল্লেখযোগ্য: এক. মিসরের তৎকালীন শাসনকর্তা আবদুল্লাহ বিন সা’দ বিন সবুর, দুই. সিরিয়ার তৎকালীন শাসনকর্তা ও বিশিষ্ট সাহাবি হজরত মু’আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং তিন. তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.)-এর মন্ত্রণা সচিব ও হজরত মু’আবিয়ার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই মারওয়ান বিন হাকাম। হজরত আলী (রা.) ৬৫৬ সালের ২৪ জুন তথা ৩৫তম হিজরি বছরের জিলহজ মাসের ২৫ তারিখে মদিনার মসজিদে উপস্থিত মুসলমানদের আনুগত্য গ্রহণকরে খলিফার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই একটি বিদ্রোহ বা যুদ্ধ তাঁকে মোকাবেলা করতে হয় ইতিহাসে যাকে বলা হয় উটের যুদ্ধ। অতঃপর তিনি চেলদিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহ দমন করেন। এগুলো শেষ হতে না হতেই সিরিয়ার শাসনকর্তা হজরত মু’আবিয়া বিদ্রোহ শুরু করেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে তিনি প্রশাসনিক রাজধানী মদিনা থেকে ইরাকের কুফা নামক স্থানে স্থানান্তর করেন। মু’আবিয়া কর্তৃক উসকিয়ে দেয়া যুদ্ধের একপর্যায়ে, একটি সন্ধি হয় মু’আবিয়ার পক্ষের সাথে। ৬৬১ সাল তথা ৪০তম হিজরি বছরের ১৭ রমজান রাজধানী শহর কুফায় হজরত আলী (রা.) আততায়ীর আক্রমণে শাহাদত বরণ করেন। কুফা শহরের পাশ দিয়ে ফোরাত নদী বহমান ছিল। ওই নদীর প্লাবন থেকে কুফা শহরকে বাঁচানোর জন্য একটি শহর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই বাঁধের পাশেই হজরত আলী (রা.)কে দাফন করা হয়। পরবর্তী সময়ে, ক্রমান্বয়ে ওই স্থানে ‘নাজাফ’ শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে নাজাফ মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশের নিকট অতি পবিত্র স্থান।

হজরত আলী (রা.) শাহাদত বরণের পর, তাঁর বড় ছেলে হজরত হাসান (রা.) অর্থাৎ হোসাইন (রা.)-এর বড় ভাই, ৩৬ বছর বয়সে ৪০ হিজরিতে ইরাক প্রদেশে খলিফা নির্বাচিত হন এবং সেখান থেকেই হিজাজ ও খোরাসান প্রদেশও শাসন করতেন। তাঁর শাসনকালের চার মাসের মাথায়, তৎকালীন অপর শাসনকর্তা মু’আবিয়া কর্তৃক পুনরায় যুদ্ধ উসকিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি হলো। সন্ধির অন্যতম শর্ত মোতাবেক, হজরত হাসান (রা.) মু’আবিয়ার অনুকূলে খেলাফত ত্যাগ করে, ক্ষমতা পরিত্যাগ করে, মদিনায় চলে যান। সন্ধির অপর শর্ত ছিল, মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হজরত হাসান (রা.)-এর ছোট ভাই ইমাম হোসাইন (রা.) খলিফা নির্বাচিত হবেন। ৬৮০ সালে মু’আবিয়ার মৃত্যু হলে, তাঁর পুত্র ইয়াজিদ পিতা কর্তৃক সম্পাদিত চুক্তি মান্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মতে, উম্মাহর ধর্মীয় নেতা ও ইসলামী রাজ্যের শাসনকর্তা তথা খলিফা হওয়ার কোনো প্রকার চারিত্রিক, নৈতিক, শিক্ষাগত যোগ্যতাই ইয়াজিদের ছিল না। এই কারণে, হজরত আলী (রা.) এবং ইমাম হাসান (রা.)-এর ইরাকি সমর্থকরা ইয়াজিদ বে-আইনি ও অনিয়মিত বা প্রথাবহির্ভূত পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আরোহণ করায়, ইয়াজিদের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।

এরূপ ঘটনার সময় ইমাম হোসাইন (রা.) অস্থায়ীভাবে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করছিলেন। সঙ্কটপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কুফাবাসীর উপর্যুপরি নিমন্ত্রণ ও আনুগত্যের আশ্বাসে ইমাম হোসাইন (রা.) মুসলমানদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হন। ওই সময়, কোনো কর্মপন্থা সুনিশ্চিতভাবে অবলম্বন করার আগে ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর একজন জ্ঞাতি ভাইকে (মুসলিম ইবনে আকিল) পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য কুফা নগরীতে পাঠান। সেখানে হাজার হাজার মুসলমান, মুসলিম ইবনে আকিলকে সাক্ষী রেখে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। সেই হাজার হাজার মুসলমানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই, জ্ঞাতি ভাই মুসলিম ইমাম হোসাইন (রা.)কে পত্রে লেখেন, তিনি যেন মক্কা ত্যাগ করে ইরাক চলে আসেন। ইতোমধ্যে ইয়াজিদের খ্রিস্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শ মোতাবেক, ইয়াজিদ জনৈক ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে কুফার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। দায়িত্ব নিয়েই, ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিম ইবনে আকিলকে বন্দি ও হত্যা করে। এই বিষয়টি ইমাম হোসাইন (রা.) জানতে পারেননি। কুফাবাসীর আমন্ত্রণেই খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার লক্ষ্যে, ইমাম হোসাইন (রা.) রাজধানী কুফা শহরের উদ্দেশ্যে, ৬০ হিজরি সালের জিলহজ মাসের ৩ তারিখে মক্কা ত্যাগ করে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, উমাইয়াদের স্বেচ্ছাচারী শাসনের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য যেসব মুসলমান ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তাদের সাহায্য করা তিনি কর্তব্য বলে মনে করলেন। কুফার উদ্দেশে অগ্রসরমান, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দলটি ছিল ক্ষুদ্র, তথা পরিবার-পরিজন ও পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দল। কোনো অবস্থাতেই, কোনো যুদ্ধ-দল বা যুদ্ধের কন্টিনজেন্ট নয়।

কুফা আসার পথেই এই দলটি ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের অশ্বারোহী বাহিনীর নজরদারিতে পড়ে। এই অশ্বারোহী বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দলকে অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে আহ্বান জানায়। তারা ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে দাবি জানায়। কিন্তু ইমাম হোসাইন (রা.) এই দাবি মানতে অস্বীকার করেন। কারণ, এই দাবি মেনে নেয়ার অর্থই ছিল অন্যায় ও অসত্যের সাথে, স্বেচ্ছাচারিতার সাথে আপস করা তথা নতিস্বীকার করা। শেষ পর্যন্ত ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে হোসাইন (রা.)-এর দল অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই ফোরাত নদীর তীরে তখনকার আমলের কারবালা প্রান্তর ছিল ধু-ধু মরুভূমি। এখানে শত্রুপক্ষ ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দলকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার নিমিত্তে, ফোরাত নদীর পানি ব্যবহার করার সব পথ বন্ধ করে দেয়।

পরবর্তী কয়েকটি দিন ছিল শ্বাসরুদ্ধকর এবং একতরফা শক্তি প্রদর্শনের চূড়ান্ত নমুনা। অবরুদ্ধ অবস্থায় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দল, কুফা থেকে সাহায্যকারী বা সমমনা দল আশা করেছিলেন। কিন্তু কুফা থেকে অনুগত মুসলমান বাহিনীও বিভিন্ন কারণে তথা কুফার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, ইমাম হোসাইন (রা.)কে সাহায্য করার জন্য কারবালার উদ্দেশে রওনা হতে পারেনি। এরূপ পরিস্থিতিতেই, ১০ মহররম ৬১ হিজরি সকালে, জনৈক উমার ইবনে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ৪০০০ উমাইয়া সৈন্যের সেনাপতি হিসেবে, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মাত্র ৭০ বা ৭২ সদস্যসংবলিত দলের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হয়। আত্মসমর্পণে আবারো অস্বীকৃতি জানানোর পর, উমাইয়া বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ক্ষুদ্র দলকে আক্রমণ করে। ইমাম হোসাইন (রা.) বাহিনীর সবাই শাহাদত বরণ করেন।

কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইতিবাচক যেই প্রসঙ্গ সবার আগে বলতে হবে সেটি হলো, বেদনার পাশাপাশি একটি মহিমান্বিত আঙ্গিক আছে। কারণ, সত্য ও ন্যায়, সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.) যেভাবে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ত্যাগ চিরকাল দেশে দেশে যুগে যুগে এ ধরনের সঙ্কট ও সমস্যা উত্তরণের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। কারবালার ময়দানের ঘটনার পরই, ইয়াজিদের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মুসলিম জাতি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। মুসলমানরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এ ঘটনা মুসলিম জাতিকে তাদের ভেতরের শত্রু কারা, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সাহায্য করে। পরবর্তীতেও ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানরা যখনই শত্রু আর মিত্র চিনতে ভুল করেছে, তখনই তারা বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। কারবালার ঘটনাটির বড় প্রভাব হলো, খেলাফতের পর গত প্রায় সাড়ে তেরোশো বছরের মুসলিম উম্মাহর ভেতর, দ্বীন ইসলাম রক্ষার যে চেতনা ও শৌর্য-বীর্য আপন মহিমায় ভাস্বর রয়েছে, তার পেছনে ইসলামের ইতিহাসের যে ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সক্রিয় হয়েছে, কারবালার ঘটনা তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
শ্রী মনোতোষ কুমার ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১:১৫ এএম says : 0
ফলাফল কি?
Total Reply(0)
Sarder Abdul Alim ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১:২১ এএম says : 0
ইমাম রা মধ্যে প্রাচোর দেশে একনায়ক শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে পারে নাই
Total Reply(0)
Yousof Masud ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১:২১ এএম says : 0
Thanks you for the Daily inqilab
Total Reply(0)
তাসফিয়া আসিফা ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১:২১ এএম says : 0
অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে কখনও আপোষ করা যাবে না।
Total Reply(0)
Farid ৩০ আগস্ট, ২০২০, ৬:১০ এএম says : 0
আল্লাহ যেন মুসলিম উম্মাহকে আবার ঐক্য বদ্ধ করে।
Total Reply(0)
Farid ৩০ আগস্ট, ২০২০, ৬:১০ এএম says : 0
আল্লাহ যেন মুসলিম উম্মাহকে আবার ঐক্য বদ্ধ করেন।
Total Reply(0)
Monjur Rashed ৩১ আগস্ট, ২০২০, ১২:২৫ পিএম says : 0
Curse on the Munafiqs ( fake Muslims) who showed hypocrisy & cruelty to Hazrat Ali ( R) & Ahle Bait E Rasul ( sm). Special thanks to the author for his courageous writing.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন