শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পবিত্র আশুরা সংখ্যা

ইমাম হোসাইন (রা.) এর শাহাদাত

অধ্যক্ষ শাহ্ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

জগতে মানবীয় মর্যাদা ও খ্যাতির সাথে সত্যের ভারসাম্য খুব অল্পই রক্ষিত হতে দেখা যায়। আশ্চার্যের বিষয় যে, যার ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা যতবেশি উন্নত, তাকে কেন্দ্র করে ততবেশি অলীক, কল্প-কাহিনীর সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এজন্যই ইতিহাস-বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনকারী ইবনে খালদুন বলেছেন যে, ‘যে ঘটনা দুনিয়াতে যতবেশি খ্যাত ও জনপ্রিয় হবে, কল্প-কাহিনীর অলীকতা ততবেশি তাকে আচ্ছন্ন করে তুলবে।’
ইসলামের ইতিহাসে ইমাম হোসাইন (রা.) এর অপরিসীম ব্যক্তিত্বের কথা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। খোলাফায়ে রাশেদীনের পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে তা হলো হোসাইন (রা.) এর শাহাদতের ঘটনা। কোনো প্রকার অত্যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ না করেই বলা যায় যে, দুনিয়ার আর কোনো দুর্ঘটনাই বোধ হয় দিনের পর দিন মানব সন্তানের এত অধিক অশ্রু বিসর্জন করাতে সমর্থ হয়নি। হোসাইন (রা.) এর পবিত্র দেহ হতে যে পরিমাণ রক্ত কারবালা প্রান্তরে প্রবাহিত হয়েছিল তার প্রত্যেকটি বিন্দুর পরিবর্তে প্রায় বিগত চৌদ্দশত বছর মহররমে দুনিয়ার মানুষ দুঃখ-বেদনা ও মাতম-অশ্রুর এক একটি সয়লাব প্রবাহিত করেছে। এতদসত্তে¡ও ভাবতে আশ্চার্যবোধ হয় যে, ইতিহাসের এ প্রসিদ্ধ ঘটনাকে ইতিহাসের চেয়ে গল্প-কল্প-কাহিনীর বেড়াজাল বেশি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আজ যদি কোনো সত্যসন্ধানী ইতিহাসের কষ্টি-পাথরে বিচার করে এ বিখ্যাত ঘটনাটি পাঠ করতে চায় তবে তাকে প্রায় নৈরাশ্য বরণ করতে হবে। বর্তমানে এ বিষয়ের উপর মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘মহররম’ ও ‘কারবালার প্রান্তরে’ কবিতার মতো যত প্রচলিত বই-পুস্তক দেখা যায় তার অধিকাংশই মাতম জারীর আবেগ হতে সৃষ্টি সাহিত্য রচনা; ইতিহাস নয়। আবার প্রাচ্যাত্য ঐতিহাসিক কর্তৃক রচিত ইসলামের ইতিহাসের বইগুলির অধিকাংশই মাতমের মজলিসী বিষয়বস্তুই ইতিহাসের রূপ ধারণ করেছে মাত্র। আজ দুনিয়াতে যে কোনো ভাষায় তালাশ করেও কারবালার ঘটনার উপর একটি সত্যিকারের ইসলামের ইতিহাসের বই খুঁজে বের করা কঠিন বলে মনে হয়। তবে আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, তারিখে ইবনে খালদুন, তারিখে ইবনে জারীর, তারিখে ইবনে হিশাম প্রভৃতি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে কারবালার সঠিকচিত্র অংকিত হয়েছে। এগুলোর বঙ্গানুবাদ কপি সংগ্রহ করা দুর্লভ নয়।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাসুল (সা.), হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.) এবং হযরত ওসমান (রা.) এর যুগে ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পবিত্র মদিনা মোনাওয়ারা। হযরত আলী (রা.) এর যুগে ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ইরাকের কুফায়। উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত আমিরে মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন সিরিয়ার দামেস্কে এবং আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন ইরাকের বাগদাদে।

হযরত ওসমান (রা.) এর শাহাদতকে কেন্দ্র করে ইতিহাস প্রসিদ্ধ সিফফিনের যুদ্ধে খোলাফায়ে রাশেদীনের খেলাফতের অবসান তরান্বিত করে এবং যার ধারাবাহিকতায় চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। আর আমিরে মুয়াবিয়া (রা.) উমাইয়া ইমারত প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী সিরিয়ার দামেস্কে স্থানান্তরিত করেন। অপর দিকে হযরত আলী (রা.) এর শাহাদাতের পর তাঁর বড় ছেলে হজরত হাসান (রা.) ইরাক প্রদেশে খলিফা নির্বাচিত হন এবং সেখান থেকেই হিজাজ ও খোরাসান প্রদেশও শাসন করতেন। কিন্তু খিলাফত নিয়ে মুয়াবিয়া (রা.) এবং হজরত ইমাম হাসান (রা.) এর মধ্যে দ্ব›েদ্বর আশঙ্কার মুখে এক সন্ধির মাধ্যমে হজরত হাসান (রা.) নিজের খিলাফত ত্যাগ করেন। সন্ধির অপর শর্ত ছিল মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হজরত হাসান (রা.)-এর ছোট ভাই ইমাম হোসাইন (রা.) খলিফা নির্বাচিত হবেন। ৬৮০ সালে মু’আবিয়ার মৃত্যু হলে, তাঁর পুত্র ইয়াজিদ পিতার সম্পাদিত চুক্তি মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। যদিও তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মতে, উম্মাহর ধর্মীয় নেতা ও ইসলামী রাজ্যের শাসনকর্তা তথা খলিফা হওয়ার কোনো প্রকার চারিত্রিক, নৈতিক, শিক্ষাগত যোগ্যতাই ইয়াজিদের ছিল না। এই সঙ্কটপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কুফাবাসীর উপর্যুপরি নিমন্ত্রণ ও আনুগত্যের আশ্বাসে ইমাম হোসাইন (রা.) মুসলমানদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হন। এর জন্য ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর একজন জ্ঞাতি ভাইকে (মুসলিম ইবনে আকিল) পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য কুফা নগরীতে পাঠান। সেখানে হাজার হাজার মুসলমান, মুসলিম ইবনে আকিলকে সাক্ষী রেখে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। এসব সংবাদ ও কুফাবাসীদের আমন্ত্রণে ইমাম হোসাইন (রা.) শেষ পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বাদ্ধবগণের পরামর্শ উপেক্ষা করেই কুফা অভিমুখে সপরিবারে রওয়ানা হন। ইতোমধ্যে কুফাস্থ ইয়াজিদের শাসনকর্তা উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ কর্তৃক মুসলিম বিন আকিলকে হত্যা করে, পথিমধ্যে থেকে সঙ্গীদের প্রত্যাবর্তন ও নানা বাধা উপেক্ষা করে কারবালা প্রান্তরে ১৮ জন আহলে বাইত ও ৬০ জন সঙ্গীসহ উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের সেনাপতি হোর বিন ইয়াযিদের এক সহস্ত্র সৈন্য দ্বারা অবরুদ্ধ হলেন। তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। বনি হাশেম ও আহলে বাইতের ১৮ জনসহ সঙ্গীদের শাহাদত বরণের পর ঘাতক শিমার বিন যিল জিশানের হাতে ইমাম হোসাইন (রা.) নির্মম-নির্দয়-নিষ্ঠুরভাবে শাহাদত বরণ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)।

হযরত যয়নব বিনতে আলী ও শিশু হযরত আলী বিন হোসাইন (রা.)সহ আহলে বাইতের মহিলা এবং শিশুরা নানা উৎপীড়নের পর পবিত্র মদিনা মোনাওয়ারায় পৌঁছেন। এ আলী বিন হোসাইন (রা.) পরবর্তিতে ইমাম জয়নুল আবেদীন নামে খ্যাতি লাভ করেন।

কারবালার এ ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে, অসত্যের নিকট আত্মসমর্পণ না করে সত্যকে সমুন্নত রাখতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার, হত্যা, মানবপাচার, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্য বদ্ধ হতে হবে। শুধু মাতম আর অশ্রু বিসর্জন দ্বারা প্রতিকার করা যাবে না।
লেখক: অধ্যক্ষ, ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, দেবিদ্বার, কুমিল্লা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন