শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পবিত্র আশুরা সংখ্যা

আশুরার তাৎপর্য

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৫ এএম

হিজরি সনের প্রথম মাস মুহররম। আর মুহররম মাসের ১০ তারিখ বা আশুরা হলো বহু ঐতিহাসিক ও ফজিলতপূর্ণ ঘটনার স্মারক এবং সাক্ষী। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন, ‘আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে গণনার, মাসগুলোর সংখ্যা ১২টি, যা আল্লাহর কিতাবে (লওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ রয়েছে। তার মধ্যে চারটি মাস (রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম) সম্মানের। এটা হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দিন। (সূরা তাওবাহ-৩৬)।

সম্মানিত এই চার মাস সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহপাক বলেছেন, এই সম্মানিত মাসগুলোতে তোমরা একে অপরের প্রতি জুলুম করো না। হযরত আব্বাস (রা.) এ বিষয়ে বলেছেন, আল্লাহতায়ালা সব মাসেই জুলুম করতে নিষেধ করেছেন। তবে বিশেষভাবে এই চার মাসে সব জুলুম ও পাপাচার থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আশুরার দিন ঘটনাবহুল। মানবেতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এইদিনে সংঘটিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এইদিনে আল্লাহপাক দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন এবং এইদিনেই রোজ কেয়ামত সংঘটিত হবে। এইদিনেই হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি এবং এইদিনেই তিনি দুনিয়াতে নেমে আসেন। হযরত নূহ (আ.)-এর কওমের ওপর আল্লাহর গজব হিসেবে মহাপ্লাবন সংঘটিত হয় এইদিনেই। এইদিনেই হযরত ইব্রাহিম (আ.) নমরূদের অগ্নিকাণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর মুক্তি লাভ করেন। হযরত আইয়ুব (আ.) এইদিনেই কঠিন পীড়া থেকে রেহাই পান। হযরত ইউসুফ (আ.) তার পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর সঙ্গে মিলিত হন এইদিনে। এইদিনে হযরত ইউনূস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেন। হযরত মুসা (আ.) এইদিনেই ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি লাভ করেন এবং ফেরাউন সদলবলে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে মারা যায়। হযরত ঈসা (আ.)কে এইদিনেই আল্লাহপাক আসমানে উঠিয়ে নেন। এ রকম আরো ঘটনা এইদিনে ঘটে। একটি দিনে এত গুরুত্ববহ ও তৎপর্যপূর্ণ ঘটনার ঘনঘটা বিস্ময়কর।

এই অবিস্মরণীয় দিনে এমন একটি ঘটনাও ঘটে, যা যুগপৎভাবে মর্মান্তিক ও শোকাবহ। ৬১ হিজরির, এইদিনে ইরাকের ফোরাত নদী তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে নবীশ্রেষ্ঠ হযরত মুহম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর পরিবারের সদস্য ও সঙ্গী-সাথীসহ শাহাদাতবরণ করেন। খলিফা নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অস্বীকার করে খলিফার পদ দখলকারী ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী এক অসম যুদ্ধে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ছাড়াও তাঁর পরিবারের ২১ জন সদস্য এবং অন্য ৫০ জন শহীদ হন। নেতা নির্বাচনের ইসলামী বিধান ও জনগণের অধিকার অস্বীকার করার বিষয়টি মেনে নিলে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর এরূপ করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো না। কিন্তু তিনি অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথানত করেননি। তাঁর এই নিরাপস ভূমিকা ও আত্মত্যাগ পরবর্তীকালের সকল অন্যায়, অসত্য, পীড়ন ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইতে অনিঃশেষ, অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। কবি অযথার্থই বলেছেন, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়, হর কারবালা কি বাদ। কারবালার জিহাদী প্রেরণা ও আত্মত্যাগ যুগে যুগে ইসলামের বিজয় ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে।

আশুরার দিনে বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হলেও কারবালার ঘটনাবলী সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে। আশুরার দিন রোজা রাখার নিয়ম আছে ইহুদিদের মধ্যে। হজরত মূসা (আ.)কে তাঁর অনুসারীদেরসহ উদ্ধার ও ফেরাউনকে পানিতে ডুবিয়ে মারার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তারা এ রোজা আমল করে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদীনায় হিজরতের পর এটা জানতে পেরে বলেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ। অতঃপর তিনি মুহররমের ৯ ও ১০ তারিখে অথবা ১০ ও ১১ তারিখে মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দান করেন, যাতে ইহুদীদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোজা ফরজ করা হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। রমজানের রোজার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্ব ও বরকতপূর্ণ। নবী করিম (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আশুরার দিনে রোজার ব্যাপারে আল্লাহপাকের কাছে আমি আশাবাদী, আল্লাহ এ রোজা পালনের ফলে এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (মুসনাদে আহমদ)।

তিনি আরো বলেছেন, রমজানের রোজার পর মুহররমের রোজা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। যেমন, ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সব চেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন। (মুসনাদে আহমদ)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, ভালো খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করবে, আল্লাহতায়ালা সারা বছরের জন্য তার প্রাচুর্য বাড়িয়ে দেবেন।

রাসুল (সা.)-এর নির্দেশনা অনুসারে, আশুরার দিন রোজা রাখা ও পরিবারের জন্য ভালো খাদ্য-খাবারের আয়োজন করা আমাদের সকলের জন্যই অতি বরকতময় কাজ হিসাবে গণ্য। এছাড়া নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি করা যায়। মুহররম বা আশুরাকেন্দ্রিক কিছু ধারণা ও কাজ সঠিক নয়। যেমনÑ মুহররম মাসে বিয়ে-শাদি না করা, কোনো শুভকাজে হাত না দেয়া, ভালো খাবার না খাওয়া, সাদা বা কালো কাপড় পরা এবং আশুরাদিবসে মাতম করা গরিবদের খাদ্য প্রদান, দান-সাদগাহ মিছিল করা, শরীরে আঘাত করে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি। এসব ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা এবং কাজ পরিহার করা উচিত।

কারবালায় ঘটনাবলীর শোক ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু শোক আর শোকগাঁথাই সব নয়। যে কারণে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) তার পরিবারের সদস্য ও সঙ্গী-সাথীসহ শাহাদাতবরণ করেছিলেন, সেই কারণ ও তার অন্তর্নিহিত ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে।

সত্য, ন্যায়, শান্তি ও কল্যাণের পথই ইসলামের পথ। ইসলামের পথ সহজ নয়। এ পথে চলতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন হতে পারে। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) অবলীলায় সেই ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন