শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পবিত্র আশুরা সংখ্যা

কারবালার শিক্ষা

অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

উপমহাদেশের স্বাধীনতার নকীব মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর লিখেছেন, কতলে হুসাইন আসলমে মার্গ ইয়াজিদ হ্যায়/ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারাবালাকি বাদ। অর্থাৎ ইমাম হুসাইনের কতল হওয়া আসলে ইয়াজিদের মৃত্যু এনেছে/ইসলাম জিন্দা হয় প্রতিটি কারবালার পরে। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) সত্য ন্যায় ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, কোনো কোরবানিই বৃথা যায় না। কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহররম অর্থাৎ আশুরার দিনে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই ঘটনাকে স্মরণ করে লিখেছিলেন, ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মুরসিয়া ক্রন্দন চাহিনা। কারবালার যুদ্ধ আশুরাকে মহিয়ান করে দিয়েছে।

সৃষ্টির আদিকাল থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন নবী-রাসূলের নানা ঘটনাকে ধারণ করে আছে। আল্লাহ তাআলা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নূর মোবারক সৃষ্টির মাধ্যমে যেদিন সৃষ্টি জগতের সূচনা করেন সেদিন ছিল আশুরা। পৃথিবীতে যেদিন প্রথম বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল সেদিন ছিল আশুরা। মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর দেহে প্রাণ সঞ্চারিত করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা, হজরত আদম (আ.)-এর তত্তবা যেদিন আল্লাহ কবুল করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। হজরত নূহ (আ.) মহা প্লাবনের সময় ৪০ দিন ভাসমান থাকা অবস্থায় কিস্তি থেকে যুদী পাহাড়ের চ‚ড়ায় সদলবলে যেদিন অবতরণ করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা, যেদিন হজরত ইবরাহীম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে আল্লাহর রহমতে মুক্ত হয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। আল্লাহ তায়ালা আগুনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের জন্য শান্তিপ্রদ শীতল হয়ে যাও। হজরত মূসা (আ.) যেদিন বনী ইসরাইলের কয়েক হাজার মানুষকে ফেরাউনের কারগার থেকে মুক্ত করে লৌহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা, হজরত আইয়ূব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগে ভোগার পর যেদিন আল্লাহর রহমতে রোগমুক্ত হয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। হজরত ইউনুস (আ.) চল্লিশ দিন মাছের পেটে থাকার পর আল্লাহর রহমতে যেদিন দজলা নদীর তীরে অবতরণ করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। এমনিতরো অসংখ্য ঘটনার সরব সাক্ষী আশুরা।

প্রিয় নবী (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা মোকাররমা থেকে হিজরত করে মদীনা মনোয়ারায় এসে জানতে পারলেন, মদীনার ইয়াহুদিরা আশুরাতে সিয়াম পালন করে। তিনি তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা আশুরাতে সিয়াম পালন করো কেন? তারা জানালেন তাদের নবী হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে হাজার হাজার বনি ইসরাইলকে উদ্ধার করে যেদিন লৌহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা, হজরত মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ এবং মুক্তির দিবস হিসাবে আশুরাকে সিয়াম পালন করতেন তারই অনুসরণে আমরাও আশুরায় সিয়াম পালন করি। প্রিয় নবী (সা.) তাদের এই কথা শুনে বললেন, মুসা (আ.)-এর ওপর তোমাদের যতটুকু অধিকার রয়েছে আমার তার চেয়ে বেশি অধিকার রয়েছে। এর প্রায় সাত মাস পর ১০ মহররমে তিনি আশুরার সিয়াম পালন করলেন, তার অনুসরণে সাহাবায়ে কেরামও এই সিয়াম পালন করলেন। এর কয়েক মাস পর আল্লাহ তায়ালা রমাদান মাসকে সিয়ামের জন্য নির্ধারণ করে দিয়ে সিয়ামের বিধান নাজিল করেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, রমাদান মাস, যা নাজিল হয়েছে মানুষের হেদায়েতের জন্য। সৎপথে সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী আল-কোরআন। অতত্রব, তোমরা যারা এই মাস পাবে তারা এই মাসে সিয়াম পালন করবে। রমাদান মাসে সিয়ামের বিধান নাজিল হওয়ার ফলে তা পালন করা ফরজ হয়ে গেল, আর আশুরার সিয়াম নফল সিয়াম হিসাবে পরিণত হলো। নফল সিয়ামের মধ্যে সবচেয়ে সর্যাদাপূর্ণ নফল সিয়াম হচ্ছে আশুরার সিয়াম।

কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.) সপরিবারে শাহাদাতের ঘটনা যেদিন ঘটেছিল সেদিন ছিল ১০ মহররম বা আশুরা। কারবালা সেদিন ছিল ধু ধু মরু প্রান্তর, বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক অত্যাধুনিক নগরী। প্রতিদিন হাজার হাজার জিয়ারতকারীর সমাবেশ ঘটে কারবালায়। তারা হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) মাজার শরীফ জিয়ারত করে শহীদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়।

হজরত হোসাইন (রা.) কারবালার যুদ্ধের সূচনাতে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমার নানা হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, হোসাইন আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনী তার সেই ভাষণের তোয়াক্কা না করে তাঁকে কতল করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ইয়াজিদের প্রেতাত্মা আজও রয়েছে। তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর রজ্জু সম্মিলিতভাবে মজবুত করে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করো না। আল্লাহর এই নির্দেশকে যারা অমান্য করে তারা আল্লাহর শত্রু এবং মানবতার শত্রু। আশুরার শিক্ষা হচ্ছে ঐক্য ও সংহতি।
লেখক: পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ ও সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন