৬১ হিজরির ১০ মুহররম ইরাকের ফোরাত নদী-তীরবর্তী কারবালার মরুপ্রান্তরে মহানবী হযরত মুহম্মদ সা.-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন রা. তাঁর পরিবারের সদস্য ও সঙ্গী-সাথীসহ শাহাদতবরণ করেন। খলিফা নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অস্বীকার করে খলিফার পদ দখলকারী ইয়াজিদের সৈন্য বাহিনী এক অসম যুদ্ধে তাদের নির্মমভাবে শহীদ করে। হযরত ইমাম হোসাইন ছাড়াও তাঁর পরিবারের ২১ জন সদস্য এবং অন্যান্য ৫০ জনকে তারা অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা এবং হত্যার পর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার মতো বর্বরতা প্রদর্শন করে। হযরত ইমাম হোসাইন রা. সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে, জানা সত্তে¡ও তিনি অসত্য ও অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করেননি। কারবালার এই হত্যাকান্ড বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মন্তুদ ও নজিরবিহীন হত্যাকান্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আবার ইসলাম, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত হিসাবেও তা স্মরণীয় হয়ে আছে। হযরত ইমাম হোসাইন রা. সহ কারবালার শহীদগণ যে অসম সাহস, অবিচল দৃঢ়তা এবং আল্লাহপাক ও তাঁর রাসূল সা.-এর প্রতি আনুগত্য, সমর্পিতচিত্ততার পরিচয় দিয়েছেন, তা যুগ যুগ ধরে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাকামী মানুষের অনুপ্রেরণার আশ্রয়স্থল হয়ে আছে।
ইসলামী খেলাফতের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান রা. শাহদতবরণ করলে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সাধারণ মানুষের ইচ্ছানুযায়ী ও তাদেরই মনোনয়নে চতুর্থ খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত আলী রা.। সিরিয়ার গভর্নর হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর হয়তোবা এটা পছন্দনীয় ছিল না। এর মধ্যেই খলিফা হযরত আলী রা. তাঁর স্থলে সাহল ইবনে হানিফকে গভর্নর নিযুক্ত করেন। খলিফার এ সিদ্ধান্ত হযরত মুয়াবিয়া রা. প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তাদের মধ্যে পরস্পর বিরোধের উদ্ভব হয়। সিফফিনের মর্মান্তিক ও অনাকাক্সিক্ষত যুদ্ধ এরই পরিণতি। হযরত আলী রা. ও হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর মধ্যকার বিরোধ মুসলিম উম্মতকে দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়, যার জের এখনও বহমান। যা হোক, ৪০ হিজরিতে খলিফা হযরত আলী রা. শাহাদতবরণ করলে হযরত মুয়াবিয়া রা. নিজেকে খেলাফতের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। খেলাফত পরিণত হয় আমরাত বা রাজতন্ত্রে। এদিকে হযরত আলী রা.-এর শাহাদতবরণের পর তার পুত্র হযরত হাসান রা.কে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা খলিফা হতে অনুরোধ করেন। অনিচ্ছা সত্তে¡ও তিনি সে অনুরোধ গ্রহণ করেন। খলিফা হওয়ার পর পরই তিনি উম্মাহর বিরোধ ও সংঘাত বন্ধের উদ্যোগ নেন। ৬ মাসের মধ্যে তিনি হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর সঙ্গে এক সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়ে তাকেই খলিফা হিসেবে মেনে নেন। সন্ধির শর্তের মধ্যে ছিল: ১. হযরত মুয়াবিয়া রা. খেলাফত কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক খোলাফায়ে রাশেদার মতো পরিচালনা করবেন। ২. হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর পর হযরত হাসান রা. খলিফা হবেন। ৩. হযরত মুয়াবিয়া কোনো উত্তরাধিকার নির্বাচন করতে পারবেন না। ৪. জনগণকে অযথা কোনো কষ্ট দিতে পারবেন না। হযরত আলী রা.-এর বংশধর কিংবা অত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে পারবেন না। তাদের সঙ্গে সব সময় সদ্ভাব রক্ষা করে চলবেন। ৫. হযরত হাসান রা.-এর যাবতীয় ঋণ হযরত মুয়াবিয়া রা. পরিশোধ করে দেবেন। হাদিয়া ও তোহফার ওপর আওলাদে রাসূল ও হাশেমী বংশের প্রাধান্য থাকবে। আহওয়ান এলাকার সমুদয় রাজস্ব হযরত হাসান রা. পাবেন এবং হযরত হোসাইন রা.কে বার্ষিক ২০ লাখ দেরহাম ভাতা দিতে হবে। ৬. সন্ধিপত্রে বর্ণিত শর্তসমূহ হযরত মুয়াবিয়া রা. অমান্য করলে জনসাধারণ ভোটের মাধ্যমে তাদের খলিফা নিযুক্ত করতে পারবে।
৪৯ হিজরিতে হযরত হাসান রা. ইন্তেকাল করেন। মনে করা হয়, তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়। কে বিষ প্রয়োগ করে, তা জানা না গেলেও বর্ণিত সন্ধি অনুযায়ী, হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর পরবর্তী খলিফার দাবিদার বিদায় নিয়ে যান। অতঃপর হযরত মুয়াবিয়া রা. খেলাফতের এক ক্রান্তিকালে পরামর্শকদের পরামর্শ অনুযায়ী পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী করতে মনস্থির করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ইয়াজিদের অনুকূলে বাইয়াত নেয়ার জন্য সিরিয়া, কুফা, ইরাক, বসরার গভর্নরদের নির্দেশ পাঠান এবং তারা বাইয়াত নিতে শুরু করেন। একমাত্র হেজাজের মুসলমানরা বায়াত নিতে ইতস্ততা প্রদর্শন করে। এরপর হযরত মুয়াবিয়া রা. ইন্তেকাল করলে ইয়াজিদ নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন।
উপর্যুক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার পটভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হলো। ইসলামে রাজতন্ত্রের কোনো সংস্থান নেই। খোলাফায়ে রাশেদীনের চার খলিফাই বিশিষ্ট ব্যক্তি ও গণসমর্থনে খলিফা হয়েছেন। এর ব্যক্তিক্রম করেছেন হযরত মুয়াবিয়া রা.। তিনি নিজে যেমন নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন, তেমনি তার পুত্রকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তার পক্ষে বাইয়াত নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি খেলাফতকে বংশপরম্পরা রাজত্বে পরিণত করেছেন। দ্বিতীয়ত, তার শাসনামলেই ইসলামের অনুসরণ ও অনুশাসনের ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়। সমাজে নানা অনাচার, অপকর্ম ও দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে। যে ইয়াজিদকে তিনি তার পরের খলিফা ঘোষণা করেন সেই ইয়াজিদ একজন নিষ্ঠুর, মদ্যপ ও ধর্মে অবিশ্বাসী হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, হিজরি প্রথম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মুসলিম সমাজ নৈতিক অধঃপতনের অতল গহবরে নিপতিত হয়। শাসনযন্ত্রের শীর্ষ পদসমূহে যারা নিয়োজিত ছিলেন তাদের অধিকাংশ ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদিতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মের অনুশাসন থেকে তারা নিজেদের সরিয়ে নেন। সমাজে ব্যাভিচার, জুয়া, মদ্যপান ও নানা রকম অনাচার বিস্তারলাভ করে। এ অবস্থায় ধর্মপ্রাণ, সজ্জন ও বিবেকবান মুসলমানেরা উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে পড়েন। দুঃশাসন, অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবেশ পর্যন্ত উধাও হয়ে যায়। দমন, পীড়ন ও জুলুমের ভয়ে মানুষ নিশ্চুপ থাকাকেই শ্রেয়জ্ঞান করে। দেশের ও দেশের মানুষের এই শোচনীয় অবস্থা, বিশেষ করে সর্বক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিবিধান অমান্য করার প্রবণতা হযরত ইমাম হোসাইন রা.কে যারপরনাই ব্যাথিত করে। খোলাফায়ে রাশেদীনের সুশাসন ও ন্যায়বিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যারা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন তাদের মধ্যে হযরত ইমাম হোসইন রা. ছিলেন অন্যতম। দেশ ও সমাজে তার প্রভাব এবং তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার কথা হযরত মুয়াবিয়া রা. ও ইয়াজিদের অজানা ছিল না। তারা নানা রকম চাপ ও কৌশল প্রয়োগ করে হযরত ইমাম হোসাইন রা.-এর আনুগত্য আদায় করার চেষ্টা করেন। সঙ্গতকারণেই ইয়াজিদের মতো ইসলামবিমুখ, অনাচারী ও দুর্বৃত্ত প্রকৃতির মানুষকে খলিফা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি এমনকি ইয়াজিদের দুর্বিনীত স্বভাব ও আচরণে, অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে ইরাক থেকে মক্কায় চলে যান। এহেন অবস্থার প্রেক্ষাপটে কুফার অধিবাসীরা শত শত চিঠি ও দূতের মাধ্যমে হযরত ইমাম হোসাইন রা.কে কুফায় যেতে অনুরোধ করে। তারা বলে, তাদের কোনো ইমাম নেই। তারা হযরত ইমাম হোসাইন রা.কেই ইমাম হিসেবে বরণ করে নিতে চায়। তারা ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে দেখতে চায় না, খলিফা হিসেবে দেখতে চায় তাঁকে। কুফাবাসীর এই পুনঃ পুনঃ ডাক ও স্বনির্বদ্ধ অনুরোধে সাড়া দিতে মনস্থির করেন তিনি। এনিয়ে তাঁর শুভাকাক্সক্ষীদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন। তারা অধিকাংশই তাঁকে বারণ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। কুফায় যাওয়ার আগে সেখানকার পরিস্থিতি জানার জন্য তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে সেখানে পাঠান। মুসলিম ইবনে আকিল কুফায় গিয়ে অনুকূল অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন এবং হযরত ইমাম হোসাইন রা.কে আসার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখেন। চিঠি লেখার পর পরই অবস্থা অন্যরকম হয়ে যায়। তাঁর আগমনে কুফায় বিদ্রোহ দেখা দেয়ায় ইয়াজিদ বসরার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার দায়িত্বও অর্পণ করেন। ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ দ্রুত কুফায় এসে দেখেন, তার প্রাসাদ মুসলিম ইবনে আকিল ও তার অনুসারীরা ঘেরাও করে আছেন। তিনি সৈন্য দিয়ে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যার হুমকি দেন। এতেই কাজ হয়। সবাই দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে। একজনকেও মুসলিম ইবনে আকিল তার পাশে দেখতে পান না। অতঃপর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তাকে গ্রেফতার করে নির্মমভাবে হত্যা করেন। হত্যার আগে তিনি ইমাম হযরত হোসাইন রা.কে আরেকটি চিঠি দিয়ে কুফায় আসতে নিষেধ করেন।
এই চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছার আগেই জিলহজ মাসের ৮ তারিখে হযরত ইমাম হোসাইন রা. মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কুফা থেকে দুই মঞ্জিল দূরে তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। এক হাজার সৈন্যের এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হুর ইবনে ইয়াজিদ। তিনি হযরত ইমাম হোসাইন রা.-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিপ্রবণ ছিলেন। তবে নির্দেশিত দায়িত্ব পালনেও ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। হযরত ইমাম হোসাইন রা. তার কাছে কুফাবাসীর চিঠি ও দূত মারফত তাকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলেন। হুর ইবনে ইয়াজিদ এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন। এক পর্যায়ে হযরত ইমাম হোসাইন রা. তাঁকে সামনে যাওয়ার অথবা ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিতে অনুরোধ জানান। হুর ইবনে ইয়াজিদ তার অপারগতা প্রকাশ করেন। বরং ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের নির্দেশ মোতাবেক এমন একটা জায়গায় হযরত ইমাম হোসাইন রা.-এর কাফেলাকে ঠেলে নিয়ে যান, যেখানে কাফেলা অধিকতর অনিরাপদ হয়ে পড়ে। হুর ইবনে ইয়াজিদ কাফেলাকে কারবালা প্রান্তরে নিয়ে যান। হযরত ইমাম হোসাইন রা. স্থানটির নাম জানতে চাইলে তাঁকে জানানো হয়, জায়গাটির নাম কারবালা। শুনে হযরত ইমাম হোসাইন রা. বলেন: এটা দুঃখ ও বালামুসিবতের জায়গা। এখানেই আমাদের অবতরণের, রক্ত ঝরানোর ও কবরের স্থান। ওদিকে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ওমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্যের একটি দল প্রেরণ করেন হযরত ইমাম হোসাইন রা.-এর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। পরবর্তীতে আরো সৈন্য পাঠানো হয় এবং ঐতিহাসিকদের মতে, মোট সৈন্য সংখ্যা অন্তত ২০ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। অথচ, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধের এই বিশাল আয়োজন, তাঁর কাফেলায় মোট লোকসংখ্যা একশ’র বেশি নয়। যাদের মধ্যে কিছু নারী ও শিশুও ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, হযরত ইমাম হোসাইন রা. যুদ্ধ করার জন্য আসেননি। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানি তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি শান্তি, নিরাপত্তা, ভ্রাতৃত্ব, পারস্পারিক সহাবস্থান দৃঢ় করার পক্ষে আন্তরিক ছিলেন। যখন কারবালা প্রান্তরে তিনি, তাঁর পরিবার ও সঙ্গী-সাথীরা ইয়াজিদের সৈন্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পতিত, ফোরাতের পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, খাবার নেই, তখনো তিনি ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তে অটল এবং আত্মসমর্পণে একেবারেই নারাজ। তিনি বরং যুদ্ধ ও রক্তপাত এড়ানোর জন্য সচেষ্ট। তিনি ওমর ইবনে সাদের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব দেন: ১. আমাকে সেখানেই যেতে দাও, যেখান থেকে আমি এসেছি। ২. আমাকে স্বয়ং ইয়াজিদের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দাও। ৩. আমাকে কোনো মুসলিম দেশের সীমান্তে পাঠিয়ে দাও। সে দেশের জনগণের যে অবস্থা হয় আমিও তা গ্রহণ করবো।
প্রস্তাব ৩টি ওমর ইবনে সাদের পছন্দ হয়। তিনি তা ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠান। প্রস্তাব ৩টি ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদেরও মনোপূত হয়। কিন্তু বাধা আসে সিমারের কাছ থেকে। তার প্ররোচনায় ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ওমর ইবনে সাদকে লেখেন: ইমাম হোসাইন যদি তার সঙ্গী-সাথীরাসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে তবে যুদ্ধ করবে না। তাদের আমার কাছে নিয়ে আসবে। আর যদি তারা আত্মসমর্পণ না করে তবে যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই।
ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের প্রস্তাব গ্রহণ করা বা মেনে নেয়া হযরত ইমাম হোসাইন রা.-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। যার নানা রাহমাতুল্লিল আলামিন, আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা ও শ্রেষ্ঠতম রাসুল হযরত মুহাম্মদ সা., যার পিতা শেরে খোদা হযরত আলী রা. এবং যার মাতা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা রা., তিনি করবেন আত্মসমর্পণ! অসম্ভব। অতএব যুদ্ধ। অসম এই যুদ্ধে একে একে হযরত ইমাম হোসাইন রা.-এর পক্ষের সবাই সাধ্যমত যুদ্ধ করে, প্রতিপক্ষ নিধন করে শাহাদত বরণ করেন। হযরত ইমাম হোসাইন রা.ও শহীদ হন। যুদ্ধ শেষে শহীদদের শিরোচ্ছেদ করে ইয়াজিদের বেরহম সৈনিকরা। শহীদদের লাশ বিকৃত করা হয় এবং ঘোড়া দিয়ে পাড়ানো হয়। হযরত ইমাম হোসাইন রা.-এর পরিবারের শিবিরের তাবুতে লুটপাট করা হয়। তাদের হত্যা বা পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও হয়। ছিন্ন মস্তকসমূহ ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠানো হয়। হযরত ইমাম হোসইন রা.-এর পরিবারকে বন্দি করা হয়।
হযরত ইমাম হোসাইন রা. যদি খলিফা হিসেবে ইয়াজিদকে মেনে নিতেন, তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতেন কিংবা ইয়াজিদের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতেন, তাহলে কারবালার লোমহর্ষক, মর্মবিদারি, নিষ্ঠুর, নির্মম হত্যাকান্ড ঘটতো না। ইয়াজিদ তাকে মাথায় তুলে নিতেন, বিপুল উপঢৌকন, অর্থ-বিত্ত, সম্মানে বিভূষিত করতেন। তিনি আরাম-আয়াসে, শান্তি-নিরাপত্তা, সুখ-সাচ্ছন্দে জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি পার্থিব সুখ-সম্ভোগের প্রতি কিছু মাত্র আগ্রহ দেখাননি। ধর্ম, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে তিনি অবস্থান নিয়েছেন। খেলাফত বা জনগণের শাসন নিশ্চিত করার জন্য, ন্যায়বিচার ও সুশাসন কায়েমের জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। গণসংগ্রাম, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে হযরত ইমাম হোসইন রা. ও তার সঙ্গী শহীদরা অনিঃশেষ প্রেরণার উৎসহ হয়ে আছেন, থাকবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন