শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এক মুসলিম কিশোরের গল্প

প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ এইচ. জামান
যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি অনেক আগে, মূলত দেশটির চমৎকার নির্বাচনী ব্যবস্থাই আমাকে প্রথম মুগ্ধ করেছিল। আমার জন্ম পাকিস্তানে, সেখানেই ১৯৮০’র দশকে বড় হয়েছি, সে সময়টা ছিল পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য এক অনিশ্চিৎ সময়। সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জিয়া উল-হকের নির্মম দমন-পীড়নমূলক শাসন পাকিস্তানি নাগরিকদের স্বপ্ন ও আশাগুলোকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল।
মনে পড়ে, আমি আমার স্কুল লাইব্রেরিতে টাইম ম্যাগাজিনের একটি পুরনো কপি খুঁজে পেয়েছিলাম। সেখানেই আমি প্রথম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারি এবং প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক সম্পর্কে জানতে পারি। যা তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে ছিল একেবারেই অকল্পনীয়। তখন আমাদের ওখানে একটি ‘বোর্ড গেইম’ প্রচলিত ছিল, যা ছিল আমারও প্রিয় একটি খেলা; এর আকর্ষণ ছিলÑএতে প্রত্যেক খেলোয়াড়েরই লক্ষ্য থাকত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া। আমিও তাই চাইতাম। যাইহোক, তখন থেকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে আমেরিকান নির্বাচনের খোঁজ-খবর রাখতাম। ১৯৮৮ সালের বুশ-ডুকাকিসের মধ্যকার নির্বাচনী দ্বৈরথ এবং এর চার বছর পরের ক্লিন্টন-বুশের মধ্যকার নির্বাচনী বিতর্কও আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। আমি সেখানে অনেক তারতম্য লক্ষ্য করেছি, তার পরেও আমেরিকান নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার পদ্ধতির প্রতি এক গভীর মুগ্ধতা অনুভব করেছি। বিশেষ করে জনগণের কল্যাণার্থে প্রার্থীদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং তার উপস্থাপনা দেখে। সব মিলিয়ে সেখানে স্বপ্ন দেখার একটি শক্তিশালী ভিত্তি ছিল, যেখানে দাঁড়িয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল।
আমার ১২ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়েও আমি সেভাবেই কল্পনা করতাম, ভাবতাম সেও একদিন একইভাবে আমেরিকায় রাজনীতি করবে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে; যে কিনা আমেরিকার মাটিতে জন্মগ্রহণ করা আমার পরিবারের প্রথম সদস্য। আমার এ ভাবনার পেছনে কারণও আছে; সে আমার কাছ থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ আমেরিকান রাজনীতির প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা। তাছাড়া, আমরা সার্বক্ষণিক ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুশীলনকারী মুসলিম, আর সেটা জানিয়েই আমার ছেলে চার বছর আগে সাবেক গভর্নর এবং ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মাইকেল ডুকাকিসকে এক পত্র লিখে তার কাছে জানতে চেয়েছিল, একজন মুসলিম বালকের পক্ষে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব কিনা? ওই চিঠি পড়ে রাজনীতিতে অভিজ্ঞ ডেমোক্র্যাট নেতা মি. ডুকাকিস আমার ছেলেকে তাঁর নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মি. ডুকাকিসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে তোলা একটি ছবি এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে আমার ছেলের কাছে রক্ষিত আছে। শুধু তাই নয়, বরং আমেরিকার রাজনীতি এবং উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের মধ্যকার কথোপোকথনের অডিও রেকর্ডও সংরক্ষিত আছে।   
মি. ডুকাকিস আমার ছেলের ওই টুকুন বয়সে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিভঙ্গি দেখে তাকে রাজনীতি করার জন্য উৎসাহ দেন। তাকে এব্যাপারেও আশ্বস্থ করেন যে, আমেরিকান উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন মুসলিমের পক্ষেও প্রেসিডেন্ট হওয়া অসম্ভব কিছু না। তার প্রেরণা থেকেই আমার ছেলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে তার ক্লাসের প্রতিনিধি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। প্রতিপক্ষকে ব্যাপক ব্যাবধানে পরাজিত করে তাতে সে জয় লাভ করতেও সক্ষম হয়। গত বছর সে বোস্টন এলাকার মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত ছাত্র পরিষদের নির্বাচনেও অংশ নেয়। সে নির্বাচনে সে অন্যান্য প্রার্থীদের পরামর্শদাতা হিসেবেও ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে নির্বাচনের দিন কী ধরনের পোশাক পরতে হবে সে ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তার সতীর্থরা তাকে ভোট দিয়ে ছাত্র পরিষদের সেক্রেটারি নির্বাচন করেছে। ইতোমধ্যে সে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ এবং প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের ইমেলের তালিকা সংগ্রহ করেছে। তার ইচ্ছা, সে আমেরিকার ফেডারেল অফিসে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতায় নামবে এবং একদিন সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে। কিন্তু সে দৌড়ে নামতে তথা প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটার হতে হলে তাকে আরও ১২ বছর অপেক্ষা করতে হবে, তাই সে এখন তার স্কুল অঙ্গনেই নির্বাচন করছে।
গত গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ অফিস এবং সেখানে যাওয়ার দৌড়ে যারা প্রতিযোগিতায় আছেন তাদের প্রতি আমাদের সহজাত শ্রদ্ধাবোধ এবং মর্যাদা অটুট ছিল। অন্তত আমাদের ছেলে এবং নয় বছর বয়সী মেয়েকে সে কথাই বলতে পারতাম। আমরা তাদের এটাই শিক্ষা দিতাম যে, এখানে আমাদের কারো অন্তরে ঘৃণার কোনো স্থান থাকতে পারে না, এমনকি কোনো প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রেও ঘৃণার কোনো স্থান নেই। আমরা তাদের এটাও বলেছি যে- কঠোর পরিশ্রম, স্বচ্ছ রাজনীতি এবং মৌলিক যোগ্যতা দিয়েই রাজনীতিবিদরা ভোটারদের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু গত কয়েক মাসে আমেরিকার চলমান নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে উগ্রতা দেখার পর আমাদের এই উপলব্ধি ঠিক রাখতে পারছি না। আমাদের সন্তানরা দেখছে যে, প্রাইমারিতে বিজয়ী রিপাবলিকান প্রার্থী এবং তার সমর্থকরা অভিবাসীদের ওপর আক্রমণ করছে, বিশেষ করে মুসলিমরাই তাদের টার্গেট হচ্ছে। এটা আমাদের শিশুদের মনে ক্ষত সৃষ্টি করছে, তাদের মূল্যবোধ গঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এ অবস্থা দেখে আমার মেয়ে প্রশ্ন করেছিল, রিপাবলিকান ওই প্রার্থী কেন সকল মুসলিমকে ঘৃণা করেন? আমরা তাকে বলেছিলাম, অধিকাংশ মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে অন্যকে মূল্যায়ন করে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমরা তার প্রচার শিবির থেকে এটা এখনও শুনতে পাইনি।
আমার ছেলেও এটা নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। নির্বাচনী প্রচার-প্রপাগান্ডার সীমা আসলে কতটুকু হওয়া উচিত? কিছু ভোট বেশি পাওয়ার জন্য কেন একটি ধর্মের সকল মানুষের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে হবে? নাকি শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করাই একমাত্র বিচার্য? ইদানীং দুঃখ হয় এই ভেবে যে, আমেরিকার যে আদর্শের প্রতিনিধিত্বের কথা এতদিন আমি তাকে বলে এসেছি, শিক্ষা দিয়েছি; সে ব্যাপারে এবারের নির্বাচনী বাস্তবতা তাকে সন্দিহান করে তুলবে। অথচ, আমি কোনোভাবেই প্রত্যাশা করতে পারি না যে, ১২ বছরের এই কিশোর তার জীবনের শুরুতেই পারস্পারিক সহমর্মিতার মনোভাব পরিত্যাগ করুক।
আমি প্রত্যাশা করি যে, আমার সন্তানরা সব সময় এটাই বিশ্বাস করবে যে, বিশ্বকে কেবল আরও ভালো করার দিকেই পরিবর্তন করা যায়, এছাড়া এটাও শিক্ষা দেই যে, কখনই নীতি, আদর্শ এবং মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না, কেননা এটা নিজেকে বিক্রি করে দেওয়ার শামিল। অথচ, এখন আমরা তাদেরকে এটা শিক্ষা দিতে বাধ্য হচ্ছি যে, স্কুলে অন্য কারো সঙ্গে ইসলামফোবিয়া এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিতর্কে জড়াবে না, আর এটা করতে হচ্ছে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ভয়ের কারণেই।  
গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে আমাদের মেয়ের জন্মদিন উদযাপনের জন্য বাড়ির কাছেই তার প্রিয় এক রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। সেখানে একজন মহিলা হঠাৎ করে এসেই আমাদের টেবিলটাকে তছনছ করে দিলেন এবং আমার স্ত্রীকে সরাসরি বললেন যে, তিনি আমার স্ত্রী এবং তার মাথায় বাঁধা স্কার্ফ দেখে ক্ষুব্ধ। অবস্থা দেখে আমাদের সন্তানরা আতঙ্কে গুটিয়ে গেল, আর আমরাও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। অথচ, আমেরিকায় অতিবাহিত করা গত ২০ বছর ধরে আমি এবং আমার স্ত্রী আমাদের কলিগ, প্রতিবেশী এমনকি অপরিচিতদের কাছ থেকেও আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় রীতি-নীতি পালনে কেবল সহমর্মিতা ও সর্বাত্মক সমর্থনই পেয়ে এসেছি।
ওই মহিলা চলে যাওয়ার পর রেস্তোরাঁর ওয়েট্রেসকে বললাম, এটা কী হলো? তিনি লজ্জিত হয়ে কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার মেয়ের জন্মদিনের কেকটা বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন। এর পর আমরা সেখান থেকে বের হয়ে এলাম, এ সময় জন্মদিনের উপহার স্বরূপ ১০ ডলারের একটি নোট তিনি আমার মেয়ের হাতে তুলে দিলেন। তারপর তিনি রেস্তোরাঁয় আসা অন্য এক গ্রাহকের প্রতি মনোযোগী হলেন। যাইহোক, আজকাল টেলিভিশনগুলোতে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা নিয়ে ঘটে যাওয়া হিংসাত্মক যা কিছু দেখানো হচ্ছে তার বদলে যদি আমরা আমাদের সন্তানদের যা কিছু শিক্ষা দিচ্ছি সেটাই আমেরিকার জন্য সত্য হতো তাহলেই কেবল তাদের মনে ভরসা জাগতে পারত।
তারপরেও আমি আশাবাদী, আমি এখনও আমার ছেলেকে উৎসাহিত করি, যাতে করে সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়াকেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যায়। আমি এখনও স্বপ্ন দেখি যে, আমার উভয় সন্তান এমন একটি দেশেই বেড়ে উঠবে, যেখানে তাদের বিচারের একমাত্র মাপকাঠি হবে তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, সার্বিক বিষয়ে তাদের ধারণার উৎকর্ষতা, তাদের যথার্থ মূল্যবোধ এবং সর্বোপরি তাদের কর্ম। কেননা, আমি আমার সেই বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করতে চাই না, যা আমি এই আমেরিকান সমাজব্যবস্থা থেকেই শিখেছি।

[গত ১১ জুন ২০১৬ দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত বোস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মোহাম্মদ এইচ. জামান-এর ড্রিমস অব মাই মুসলিম সান’স শীর্ষক প্রবন্ধটি ইংরেজি থেকে অনূদিত।]
য় অনুবাদক : সৈয়দ ইবনে রহমত, সাংবাদিক ও গবেষক  
ংধুবফরনহৎধযসধঃ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন