‘দিল্লি এগ্রিমেন্ট’ কাগজে কলমে কাশ্মীরকে স্বায়ত্তশাসন দিলেও কাশ্মীরের প্রতি দিল্লির মনোভাব কখনোই বিশ্বস্ত হয়নি। শেখ আবদুল্লাহ-ই কাশ্মীরকে নেহরুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নেহরুর বিশ্বস্ত । কিন্তু, সেই বিশ্বাস বারবারই ভেঙেছে। দিল্লি এগ্রিমেন্টের আগে শেখ আবদুল্লাহ বিভিন্ন সময় দেশি-বিদেশি পক্ষের কাছে স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। স্বাধীন জম্মু-কাশ্মীর প্রতিষ্ঠা তার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হিসেবে ছিল। বিধানসভার প্রথম বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, আমাদের (কাশ্মীরকে) প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিকল্প চিন্তা করতে হবে। উভয় (ভারত ও পাকিস্তান) দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। বর্তমানের অচলাবস্থায় এমন কৌশল পথপ্রদর্শক হতে পারে। এই পন্থা আকর্ষণীয় ও মনে হতে পারে। একটা পর্যটনভিত্তিক রাজ্য হিসেবে আমাদের জন্য, এটা আরও কিছু সুবিধা দিতে পারে। কিন্তু, স্বাধীনতার কথা ভাবতে গিয়ে আমাদের বাস্তবতা বিস্মৃত হলে চলবে না। প্রথমত, আমাদের রাজ্যের সুদীর্ঘ ও জটিল সীমান্ত এলাকা রয়েছে অনেক দেশের সঙ্গে, যা পাহারা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত শক্তি আমাদের নেই। ফলে স্বাধীনতা রক্ষা করা এতটা সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, আমরা ওই সব প্রতিবেশীর মধ্যে কোনো শক্তিশালী পক্ষ দেখি না যে আমাদের স্বাধীন থাকার নিশ্চয়তা দেবে।
অর্থাৎ শেখ আবদুল্লাহ স্বাধীনতার আশা রাখলেও দুটি কারণে তা কঠিন বলে মানতেন। তথা: প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী গ্যারান্টারের অভাব। এই দুই নিশ্চয়তা তার ছিল না বলেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা বিকল্প বেছে নেয়ার পক্ষে ছিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি ভারতকে বাছাই করেছেন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার আশায়। কিন্তু, ভারতে যোগদানের পরও তিনি ‘শক্তিশালী’ গ্যারান্টার খোঁজার চেষ্টায়রত ছিলেন। ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে তিনি ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাকে তিনি বলেন, শুধু তিনি নিজে নন। রাজ্যের অধিকাংশ জনগণ স্বাধীনতা চায়। এমনকি আজাদ কাশ্মীরও স্বাধীন কাশ্মীরে যোগ দেবে। ১৯৫২ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনারের সঙ্গেও দেখা করেন।
আবদুল্লাহর এই স্বাধীনতার প্রত্যাশা এবং তৎপরতার খবর দিল্লির জানা ছিল। ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে দিল্লি এগ্রিমেন্টের পর ভারত মনে করেছিল সেই স্বাধীনতার প্রত্যাশার মুখে স্থায়ীভাবে কুলুপ আঁটা হয়েছে। কারণ, তখন আইনিভাবে ৩৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে রাজ্যটিকে। কিন্তু, বছর যেতে না যেতেই আবদুল্লাহ ফের স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। ১৯৫৩ সালের মে মাসে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আদলাই স্টিভেনশনের সঙ্গে সাক্ষাতে সেকথা বলেন। ভারতের জন্য এটা একটা মাথাব্যথার কারণ হয়।
অপরদিকে, দিল্লি এগ্রিমেন্টে স্বায়ত্তশাসনের সীমারেখা অনেকক্ষেত্রেই লঙ্ঘন করেছিল ভারত।(২) অর্থাৎ, ‘দিল্লি এগ্রিমেন্ট’ এর শর্ত কোনো পক্ষই মেনে চলেনি। এটাই ধীরে ধীরে আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে নেহরু ও আবদুল্লাহর মধ্যে। এরই মধ্যে জম্মুতে কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ‘প্রজা পরিষদ’সহ বিভিন্ন ব্যানারে আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীরকে সম্পূর্ণভাবে ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির দাবি শুরু করে। এই দাবির পক্ষে শক্ত সমর্থন দেয় ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘জনসংঘ’ (প্রতিষ্ঠা ১৯৫১)। ১৯৫২ সালে প্রজা পরিষদের দুই নেতাকে আটক করে শেখ আবদুল্লাহর সরকার। ১৯৫৩ সালের ৮ মে জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে গেলে তাকেও আটক করা হয়। ওই হিন্দু নেতা, কারাগারে মারা যান। এই ঘটনাগুলো স্বায়ত্তশাসন (আর্টিকেল ৩৭০) বিরোধী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতা হলো, ১৯৫৩ সালের অগাস্টে শেখ আবদুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া এবং কারাগারে পাঠানো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন