আগেই বলেছি, শেখ আবদুল্লাহর জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। ভারতকেই নিজের দেশ মেনেছিলেন শেখ। পাঠানদের আক্রমণ ঠেকাতে শেখের অনুসারী কাশ্মীরিরাই প্রতিরোধ শুরু করেছিল প্রথম। প্রশ্ন হলো- তাহলে এই পাকিস্তানপ্রীতির জন্ম হলো কিভাবে। হঠাৎ করেই মানুষ পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়েনি। মনস্তাত্তিকভাবে কাশ্মীরিদের পাকিস্তানাইজেশন হয়েছে ধাপে ধাপে। ‘মুসলমানরা ভাই-ভাই’-এই শ্লোগান হলো পাকিস্তানাইজেশনের প্রথম ধাপ। ১৯৩৯ সালে যখন শেখ আবদুল্লাহ মহারাজার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ‘সার্বজনীন’ করার জন্য মুসলিম কনফারেন্সের নাম বদলে ন্যাশনাল কনফারেন্স করেন তখন দলের সেক্রেটারি ছিলেন চৌধুরী গোলাম আব্বাস। তিনি ছিলেন জম্মুর মুসলমানদের প্রতিনিধি। মনে রাখতে হবে, মুসলমানরা কাশ্মীরে সংখ্যায় বেশি, জস্মুতে তারা কম। সংখ্যালঘু হিসেবে জম্মুর উত্তর দিকের জেলাগুলোর মুসলমানরা ছিল সবদিক থেকে সবসময় অবহেলিত। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে চৌধুরী আব্বাস ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে সরে যান। তিনি কাশ্মীরি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন না। ফলে, তার এই রাজনৈতিক অবস্থান কাশ্মীরের জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তিনি জস্মুর মুসলমানদের কাছেই মূল্যায়ণ পেয়েছেন। বিপরীতক্রমে, শেখ আবদুল্লাহর অসাধারণ বাগ্মিতা এবং কাশ্মীরের বিভিন্ন খানকায় ইসলামী বক্তৃতা ও তেলাওয়াত তাকে অপ্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রশ্নে জনগণ শেখ আবদুল্লাহর কথা অন্ধভাবে মেনেছে। আর যেহেতু রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল কাশ্মীর সেহেতু আবদুল্লাহর ভারতে যোগদানে কাশ্মীরিরা নিমরাজি হয়েছে। জম্মুর মুসলমানদের মতামত সেখানে খুব একটা কাজে লাগেনি। তবে, লাহোর প্রস্তাবের পর চৌধুরী আব্বাসের উদ্যেঅগে মুসলিম কনফারেন্স পুনরায় উজ্জীবিত হয়। তারা দ্বিজাতিতত্তের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচারণায় যুক্ত হয়। কাশ্মীরেও মীরওয়াইজ (কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও ঈদগাহের ঐতিহ্যবাহী ইমাম) পরিবার সেই মতের সমর্থক ছিলেন। ব্যাপক জনপ্রিয় না হলেও মৌলিকভাবে মুসলিম জনসংখ্যার কাছে মীরওয়াইজ পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আবদুল্লাহ তখন ৮-১০ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারী হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা নেতা। আবদুল্লাহর এই নেতা হয়ে ওঠা মীরওয়াইজ’ পরিবারের সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় নেতৃত্বের অবস্থানকে দুর্বল করেছিল। এসব কারণে এখনও মীরওয়াইজ পরিবার কাশ্মীরের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এবং তা ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিরোধী। মোদ্দাকথা, নেহরু-গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনের যেমন প্রতিনিধি ছিল এনসি, তেমনি মুসলিম লীগেরও উপস্থিতি খানিকটা ছিল এমসির মাধ্যমে। ফলে, কাশ্মীর যখন ভারতে যোগ দেয়, যাতে শেখ আবদুল্লাহ সমর্থন দেন, তখন খোদ এনসি’র অনেক নেতা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিলেন। শেখ আবদুল্লাহকে তারা বোঝাতে চেয়েছেন বিপরীত ভাবনার জন্য। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নে উপমহাদেশব্যাপী যে দ্বিধা ছিল তা কাশ্মীরকেও স্পর্শ করেছিল। কিন্তু, আবদুল্লাহর তেজস্বী নেতৃত্বের কারণে সেই দ্বিধা বিস্ফোরণ আকারে দেখা যায়নি। তবে, সেই দ্বিধাই পাকিস্তানাইজেশনের বীজ হিসেবে রয়ে গিয়েছিল। সেটিইক্রমে বিকাশ লাভ করে নানাভাবে। দ্বিতীয় কারণটি হলো ভৌগোলিক। ভারতীয় আইনজীবী এ জে নূরানী লিখেছেন, সকল মৌসুমে শ্রীনগরের সঙ্গে বাকি বিশ্বের যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা ছিল পুরাতন রাওয়ালপিন্ডি রোড। কাশ্মীরের নদীগুলো বয়েগেছে পাকিস্তানে। সকল ভৌগোলিক ব্যবস্থায় কাশ্মীর পাকিস্তানের সঙ্গে মেলে’। কাশ্মীর থেকে বর্তমান রাস্তায় ভারতের মুম্বই সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ৩৩০০ কিলোমিটার। আর করাচি বন্দরের দূরত্ব ছিল ১২০০ কি.মি.। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যও পাকিস্তানের রাস্তাই কাশ্মীরিদের জন্য ছিল সুবিধাজনক। এই রাজনৈতিক অর্থনীতিও কাশ্মীরিদের পাকিস্তানাইজেশনের অন্যতম কারণ। তৃতীয়ত, জম্মুর সংখ্যালঘু মুসলমানরা অনেকেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানী অংশে চলে গেছেন। জস্মুতে চৌধুরীর আব্বাসের কন্যাও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। চৌধুরী আব্বাস পরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হন। পাকিস্তানের অধিকৃত এলাকায় শেখ আবদুল্লাহর ব্যক্তিগত প্রভাবও ছিল কম। মোটকথা, ওই এলাকায় পাকিস্তানাইজেশন সহজ হয়েছে। বিপরীতক্রমে, ভারতীয় অংশে ‘ইন্ডিয়ানাইজেশন’ প্রক্রিয়া বারবার নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছে। পরম বিশ্বস্ত শেক আবদুল্লাহকেই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে যখন জেলে পাটানো হয়েছে তখন কাশ্মীরিরা আর ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারেনি। ইন্ডিয়ানাইজেশনের ব্যর্থতা পাকিস্তানাইজেশনে গতি এনেছে। আর জম্মুর হিন্দু নাগরিকেরা আরও জোরে আওয়াজ তুলেছেন কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে। ফলে, জম্মু আর কাশ্মীরের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব মাত্র একটি পাহাড় হলেও বাস্তবিক দূরত্ব হয়েছে অসীম।
এতকিছুর পরও প্রশ্ন হচ্ছে, কী পরিমাণ কাশ্মীরি পাকিস্তানের পক্ষে? স্পষ্টতই, ভারতীয় গণমাধ্যমের একাট্টা প্রচারণা হলো, সব কাশ্মরীই পাকিস্তানপন্থী। এই প্রচারের মাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকশনের বৈধতা দেওয়া যায়। এমনকি শেখ আবদুল্লাহকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগে। বিপরীতদিকে, পাকিস্তানি গণমাধ্যমও দাবি করে, সব কাশ্মীরিই তাদের। এই দ্বিধার মধ্যে, ২০১০ সালে লন্ডনভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উভয় পাশে চালানো জরিপ বলছে, ‘৪৩ শতাংশ কাশ্মীরি স্বাধীনতা চায়। ১৫ শতাংশ পাকিস্তান, ২১ শতাংশ ভারত এবং ৭ শতাংশ লোক চায় বর্তমান অবস্থা।’ আর, গণভোটের ব্যালটে স্বাধীনতার সুযোগ না থাকলে স্বাধীনতার প্রত্যাশীরা পাকিস্তানের পক্ষে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন