শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

জঙ্গি দমনে গণগ্রেফতার কী সমাধান দেবে

প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ রেজাউর রহমান
পাবনার সদর উপজেলার হেমায়েতপুর গ্রামের শ্রীশ্রী অনুকূল চন্দ্র ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পা-েকে গত শুক্রবার (১০ জুন) নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আততায়ীরা অতি প্রত্যুষে পাবনার মানসিক হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী রাস্তায় নিত্যরঞ্জনের প্রাত্যহিক হাঁটার সময়ে তাকে আক্রমণ ও হত্যা করে। তিন দিন আগে ঝিনাইদহে নিহত হন পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি।
এসব হত্যাকা-ে যারা নিহত হচ্ছেন, তাদের সাথে হত্যাকারীদের কোনো শত্রুতা ছিল বলে মনে হয় না। সংখ্যালঘুদের ওপর এই জাতীয় আক্রমণ ও মন্দিরের পুরোহিত বা আশ্রমের সেবায়েত হত্যাকা-ের জন্য যারাই দায়ী হোন না কেন, তাদের উদ্দেশ্যই বা কি-তাও সঠিকভাবে জানা যাচ্ছে না। শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরোহিত বা সেবায়েতই নন, এর আগে আগেই চট্টগ্রামে কর্মব্যস্ত সড়কের মোড়ে একই কায়দায় হত্যা করা হয় পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে। রবিবার ৫ জুন স্কুলের বাসে ছেলেকে তুলে দেওয়ার সময়ে শহরের জিইসি মোড়ে নিহত হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম। একই দিনে (৫ জুন) নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া খ্রিস্টানপাড়ায় সুনীল গোমেজ নামক এক খ্রিস্টান ব্যবসায়ীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দায় স্বীকার করে টুইট বার্তায় আইএস বলেছে, তাদের সদস্যদের দ্বারাই হত্যাকা-টি ঘটেছে। এক মাস আগে বান্দরবানে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকেও হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস। সরকার বিভিন্ন সময়ে বলে এসেছে বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানমকে হত্যা করা হয়েছে যেসব অনুমিত কারণে তার একটি হলো পেশাগত জীবনে এসপি বাবুল আক্তার জঙ্গি দমনে কার্যকর ভূমিকা রেখে এসেছেনÑএ জন্য হয়তো তার স্ত্রীকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নেওয়া হয়েছে হত্যার জন্য। এ ছাড়া মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম, মুসলমান নামধারী মুক্তমনা ব্লগার, ব্লগারদের লেখা বইয়ের প্রকাশকসহ এরকম অনেক ব্যক্তিকে গত ১৮ মাসে হত্যা করা হয়েছে। কাজেই এ কথা বলার কোনো যুক্তিই নেই যে, বেছে বেছে শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনদেরকেই হত্যা করা হয়েছে। যারাই এসব হত্যাকা-ের জন্য দায়ী হোক না কেন, তারা কোন উদ্দেশ্যে কী কারণে এসব লোকদের হত্যা করে চলেছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। গণজাগরণ মঞ্চের রাজীব হায়দারকে হত্যার জন্য ধর্ম সম্বন্ধে তার কটূক্তি, ইসলাম সম্পর্কে তার অবমাননাজনক মন্তব্য ইত্যাদি দায়ী ছিল বলে অনুমান করা হয়। শুধু অনুমান নয়, এসব লেখালেখির প্রমাণ দিয়ে হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালে যেসব কর্মসূচি পালন করেছিল তার ফলে পাঁচজন ধর্ম অবমাননাকারী তথাকথিত নাস্তিক ব্লগারদের সরকার গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করা হয়েছিল।
পীর, মাজারের খাদেম, মুসলমান নামধারী ব্লগার ও তাদের লেখা বইয়ের প্রকাশকদের হত্যার পরে বৌদ্ধ ভিক্ষু, হিন্দু মন্দিরের পুরোহিত, খ্রিস্টান ধর্ম যাজক ও সর্বশেষে গ্রামের মুদি দোকানদার খ্রিস্টানদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে যারাই এসব হত্যাকা- চালাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে সাধারণ নাগরিকরা কিছুই জানেন না এবং এই প্রথম দেখা যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সাধারণ নাগরিকদের মতোই অন্ধকারে রয়েছেন। গত ১৮ মাসে ৪৫টি হামলা হয়েছে, নিহত হয়েছেন ৪৭ জন। সর্বশেষ দুই হিন্দু পুরোহিত ও সেবায়েত হত্যাকা-ের পরে দেখা গেছে যে, ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় হাইকমিশনের দুই কর্মকর্তা নিহতদের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন ও আত্মীয়স্বজন এবং স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলেছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো বলে বলা হয়েছে। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু ও মুসলমান যারাই গত ১৮ মাসে নিহত হয়েছেন, তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। ইতালীয় নাগরিক নিহত তাবেলা সিজার ও জাপানি নাগরিক নিহত হোসি কোনিও ছাড়া সবাই বাংলাদেশি। কোনো বাংলাদেশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক যদি অন্য কোনো কারণে- শত্রুতা, জমিজমা নিয়ে মতানৈক্য, ঝগড়াঝাঁটির ফলে নিহত হতেন, যেখানে হত্যার উদ্দেশ্য দৃশ্যমান, খুনিরাও শনাক্ত-তাহলেও কি ভারতীয় হাইকমিশন সেখানে সরেজমিন জানার জন্য কর্মকর্তা পাঠাবেন?
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের সদস্যরা কি ভারতীয় হাইকমিশনের জিম্মাদারিতে রয়েছে? ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তা যেভাবে ঝিনাইদহের মন্দিরের পুরোহিত ও পাবনার আশ্রমের সেবায়েত হত্যাকা-ের পরে ঘটনাস্থলে ছুটে গেছেন, বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা জানার অপেক্ষা না করে তাতে এটাই কি বোঝানো হয়নি যে, এদেশে কোনো হিন্দুর ওপর নিষিদ্ধ কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক হামলা অনভিপ্রেত ও অবাঞ্ছিত? সরকার সম্প্রতি যে গণগ্রেফতার কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, তার ফলাফলের জন্য আমাদেরকে কিছু দিন বা কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে কোনো ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যদি কোনো অন্য ধর্মের অনুসারীকে হত্যা করে, তাহলে সরকার নিশ্চয়ই নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকবে না। তাছাড়া এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, মহাশক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এরকম আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত হত্যা বন্ধ করতে সক্ষম নয়, তার সর্বশেষ প্রমাণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যান্ডো শহরে ১২ জুন সমকামীদের নাইটক্লাবে আফগান বংশোদ্ভূত একজন নাগরিক হঠাৎ হামলা করে গুলিবর্ষণে ৫০ জনকে হত্যা ও প্রায় একশরও বেশি জনকে আহত করেন। পরে অবশ্য পুলিশ সেখানে অভিযান চালায় ও তাকে হত্যা করে। এই আফগান বংশোদ্ভূত নাগরিক ওমর মতিন পুলিশি নজরদারিতে থাকা সত্ত্বেও অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মধ্যরাতে এই হামলা চালায়। অনুরূপ, বাংলাদেশেও গত ১৮ মাসে যেভাবে ৪৫টি হামলায় ৪৭ জনকে খুন করা হয়েছে, তার প্রতিটি হামলা ছিল অতি-আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। কোনো সরকারের পক্ষেই দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য নির্জন রাস্তা, বাজারের দোকান বা অফিস পাহারা দিয়ে গুপ্তহত্যা বন্ধ করা সম্ভব নয়।
এর মধ্যে অনেকেই বলেছেন, সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্র সঙ্কুচিত করা, ভিন্নমতাবলম্বীদের সভা-সমিতি করার বা কথা বলার অধিকার ক্ষুণœ করার জন্যই উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ইউলিয়াম বি মাইলামও সম্প্রতি দি নিউইয়র্ক টাইমস নামক বহুল প্রচারিত দৈনিকে এসব কথা বলেছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এ জন্য কিছুটা দায়ী এ কথা অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকও বলেছেন। চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম কোনো রাজনৈতিক দলের কেউ ছিলেন না, তাকে হত্যা করে তার স্বামীকে আঘাত করাই যদি হত্যাকারীদের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, তাহলে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিভিন্ন মাদকবিরোধী ও চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য ক্ষতিগ্রস্তরাও তো এই হত্যাকা- ঘটাতে পারে। কারণ হয়তো তারা মনে করেছে, হত্যাকা-ের দায় উগ্রধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ওপরও বর্তাতে পারে। আর এই প্রথমবারের মতো আলকায়েদার পক্ষ থেকে এই হত্যাকা-ের দায় অস্বীকার করা হয়েছে। গত ১৮ মাসে ৪৭ জনকে হত্যার জন্য দায়ী যে উগ্রবাদী একাধিক গোষ্ঠী তা সাধারণ বুদ্ধিতেও ধারণা করা যায়। কিন্তু সরকার তাদের কর্মস্থল বা আশ্রয়স্থলের সন্ধান না পেয়ে যে গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে, তাতে ১৪ জুন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে সাড়ে এগারো হাজার নাগরিক। এদের মধ্যে পুলিশের ভাষ্যমতেÑ যাদের বিরুদ্ধে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে নাশকতার মামলা রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি ছিল এবং সন্দেহভাজন যারা তারাই এই গণগ্রেফতারের শিকার। মুশকিল হচ্ছে এই যে, সাড়ে এগারো হাজার গ্রেফতার মানুষের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গির সংখ্যা খুবই নগণ্য। বিরোধী দলের বা বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরাই অধিক সংখ্যায় গ্রেফতার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে রাজনৈতিক কারণে যাদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা দেওয়া হয়েছিল তাদেরকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সর্বাপেক্ষা লক্ষণীয় এই যে, গ্রেফতার সাড়ে এগারো হাজারের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে মাত্র ১৪৫ জনকে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে, মাত্র ১৪৫ জন ছাড়াও হাজার হাজার নাগরিককে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষেই সরকার এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, সেখান থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে সনাক্ত করতে অপারগ হয়ে উঠছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে যেসব তরুণ নাগরিক ধর্মের অনুসারী কিন্তু জঙ্গি মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়, তারাও পুলিশের রোষদৃষ্টিতে পড়তে পারেন, এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সরকারের জনপ্রিয়তা অবশ্যই হ্রাস পাবে। তাছাড়া, প্রকৃত দোষী নয় এমন লোকদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করা হলে সংক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকবে।
এখানে স্মর্তব্য যে, গত ২৪ মে সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ তাদের রায়ে বলেছেন যে, পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না এবং রিমান্ডে নিয়ে কারো ওপর নির্যাতন চালানো যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ নং এবং ১৬৭ নং ধারা সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট ১৩ বছর আগে যে রায় দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সেগুলো বহাল রেখেছেন। আপিল বিভাগের ওই রায়ের পরে আইনজীবীরা মন্তব্য করেছিলেন যে, রায়ের পরে ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে। হাইকোর্টের দেওয়া যেসব নির্দেশনা সামান্য পরিবর্তন সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বহাল রেখেছেন-সেগুলোর মধ্যে ছিল গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে, ৫৪ ধারায় গ্রেফতার কোনো ব্যক্তিকে পরে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ দেয়া যাবে না, কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে, ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে অভিযুক্তের ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি তার পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন।
জঙ্গি দমনে যে পুলিশি অভিযান চলছে, তাতে গ্রেফতার করা ও রিমান্ডে নেওয়া এবং আইনি সহায়তার অধিকারের সুযোগ নেওয়ার ব্যবস্থা যথাযথভাবে অনুসরণ না হলে গ্রেফতার যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে তার স্বজনরা পুনরায় রিট আবেদন করতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষেই জঙ্গি দমন সরকারকে একটু বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। কীভাবে ও কোন কৌশলে প্রকৃতই যারা উগ্রবাদী তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায়, তা আসলেই কঠিন কাজ। সকল শ্রেণীর সকল ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাইকেই এ বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন