সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

কেয়ামতনামা এবং বিস্ময়কর ঘটনা

প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কে এস সিদ্দিকী
(১০ জুন প্রকাশের পর)
জাহান্নামের সাত স্তর ও আজাবের বর্ণনা
জাহান্নামের সাতটি স্তর আছে এবং প্রতিটি স্তরে একটি করে ফটক বা দরজা আছে। প্রথম স্তরটি নির্ধারিত মুসলমান গুনাহগার ও সেসব কাফেরের জন্য, যারা শিরকে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও নবীগণকে স্বীকার করত। বাকি অন্য স্তরগুলো নির্ধারিত রয়েছে অগ্নি উপাসক (মজুমী), দাহরিয়া (নাস্তিক), ইহুদি, নাসারা (খ্রিস্টান) এবং মোনাফেক তথা কপট বিশ্বাসীদের জন্য। জাহান্নামের সাত স্তরের নামগুলো কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমনÑ (১) জাহীম (২) জাহান্নাম (৩) সাঈর (৪) সাকার (৫) লাজা (৬) হাভিয়া এবং (৭) হোতামা।
এসব স্তরের প্রত্যেক স্তরে অত্যন্ত প্রশস্ত নানা প্রকারের আজাবের শাস্তির জন্য রঙ-বেরঙের বহু ঘর রয়েছে। ‘ঘাই’ নামক একটি ঘর আছে, যার কঠোরতায় বাকি দোজখগুলোও প্রতিদিন চারশবার পানাহা (আশ্রয়) প্রার্থনা করে। আরও একটি ঘর আছে, যাতে মারাত্মক অশেষ ঠা-া বা শীত বিদ্যমান, যাকে বলা হয় জামহারীর। হোব্বুল হাজন বা দুঃখের কূপ নামক একটি ক্ষুধার আজাব এত কঠিন মারাত্মক হবে যে, তা হবে সমগ্র আজাবের সমান। অবশেষে অত্যন্ত অস্থির বিচলিত হয়ে খাদ্য তালাশ করবে। নির্দেশ হবে যে, জাহীম দোজখের একেবারে তল দেশে গজিয়ে ওঠা মারাত্মক তিক্ত কাঁটাদার খুবই শক্ত জাক্কুম ফল খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হোক। দোজখবাসী যখন ওটা খেতে আরম্ভ করবে তখন গলায় তা আটকা পড়বে এবং বলতে থাকবে দুনিয়াতে যখন আমাদের গলায় খাদ্য গ্রাস (লোকমা) আটক হয়ে যেত, তখন পানি দ্বারা তা গিলে ফেলতাম। তাই এবার পানি চাইবে। নির্দেশ হবে জাহীম দোজখ হতে পান করাও। পানি মুখে পৌঁছামাত্র ঠোঁট এমনভাবে শুকিয়ে যাবে যে, কপালও বক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, জিব বেঁকে দলা হয়ে যাবে এবং প্রতিটি শিরা-উপশিরা, ধমনি ও নাড়ি-ভুঁড়ি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে আজাব ভোগ করবে। যথা পুড়িয়ে দেওয়া, টুকরা টুকরা করে দেওয়া, সাপ বিচ্ছুর কামড়ানো, কাঁটা ঢুকে যাওয়া, চামড়া ছিলে যাওয়া, মৌমাছির কামড় ইত্যাদি। তীব্র দাহের কারণে আগুনের ছেঁকা লাগার সাথে সাথে দেহ জ্বলেপুড়ে  ছাই হয়ে নতুন দেহ ধারণ করবে এমন কি এক ঘণ্টার মধ্যে সাতশবার দেহ পরিবর্তন হতে থাকবে। কিন্তু স্মরণ থাকে যে, দেহের আসল অঙ্গগুলো অক্ষুণœ থাকবে, কেবল হাড়, মাংস জ্বলে গিয়ে পুনরায় সৃষ্টি হতে থাকবে এবং দুঃখ অনুতাপ, নিরাশা ও পেটব্যথা ইত্যাদি যন্ত্রণাগুলো দেহ অনুপাতে সহ্য করবে। কোনো কোনো কাফেরের চামড়া বিয়াল্লিশ (৪২) গজ পুরু মোটা হবে, দন্ত হবে পর্বতসম বসার জন্য তিন তিন মনজিল দূরত্বে স্থান প্রয়োজন হবে। দীর্ঘকাল পর বিভিন্ন আজাব ব্যতীত কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, নাড়ি-ভুঁড়ি ফেটে গিয়ে মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে যাবে এ অবস্থায় বিচলিত হয়ে জাহান্নামের দারোগার সামনে আহাজারি করে বলবে আমাদেরকে মেরে ফেল, যাতে আমরা এসব বিপদ হতে নাজাত পাই। এর হাজার বছর পর দারোগা জবাব দেবে যে, তোমরা সর্বদা এখানেই থাকবে। এর হাজার বছর পর তারা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করবে হে আল্লাহ! আমাদের প্রাণ নিয়ে নাও এবং তোমার রহমত করুণায় এ আজাব হতে মুক্তিদান কর। এর হাজার বছর পর আল্লাহর দরবার হতে জবাবে বলা হবে, সাবধান! চুপ থাক, আমার নিকট প্রার্থনা করবে না, এখান হতে বের হওয়া তোমাদের ভাগ্যে নেই। পরিশেষে তারা বাধ্য হয়ে বলবে ভ্রাতাগণ, ধৈর্য ধারণ কর কেননা ধর্যের পরিণাম ভালো হয়। এ কথা বলার পর তারা এক হাজার বছর পর্যন্ত আল্লাহর নিকট আহাজারি করবে। সবশেষে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে বলবে অস্থিরতা ও ধৈর্য আমাদের ব্যাপারে সমান, কোনো অবস্থাতেই মুক্তি দেখা যাচ্ছে না। অতঃপর এসব কাফেরকে মাথা নিচু ও পা ওপর করে দাঁড় করানো হবে, তাদের দেহ বিকৃত হয়ে কুকুর, গাধা, বাঘ, বানর, সাপ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর রূপ ধারণ করবে। দুনিয়াতে যেসব লোক অহংকার করত তাদেরকে হাশরের ময়দানে লুটিয়ে পদদলিত করা হবেÑ এটাই কাফেরদের অবস্থার বর্ণনা। এসব বিবরণ কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ আছে।
জাহান্নামিদের আজাবের জন্য ফেরেশতাদের ১৯টি দল নিয়োজিত রয়েছে বলেও কোরআনের সূরা মোদ্দাসসিবে বলা হয়েছে। যেমনÑ ‘আলাইয়া তিসআতা আশারা’। অর্থাৎ দোজখের ব্যবস্থাপনায় উনিশজন ফেরেশতা নিয়োজিত। (আয়াত : ৩০)। অর্থাৎ ১৯ জন অফিসার পর্যায়ের ফেরেশতার নেতৃত্বে ফেরেশতাদের বাহিনী জাহান্নামিদের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত রয়েছে। ১৯ জনের মধ্যে প্রধান দায়িত্বশীল ফেরেশতার নাম মালেক।
মোনাফেকের ঠিকানা
কোরআনে বলা হয়েছেÑ ‘ইন্নাল মোনাফিকীনা ফিদুদার কিল আসফালি মিনান্নার’। অর্থাৎ নিশ্চয় মোনাফেকদের ঠিকানা হবে দোজখের সর্ব নি¤œস্তর। (সূরা নিসা, আয়াত : ১৪৫)।
দোজখের সপ্তম স্তরের নাম হোতামা। বর্ণনা অনুযায়ী এটি হচ্ছে দোজখের সর্বনি¤œস্তর। প্রত্যেকটি স্তরে ভিন্ন ভিন্ন স্থান ও নানা প্রকারের আজাব শাস্তি রয়েছে। এরূপ স্থানগুলোর মধ্যে একটির নাম ছউদ। এ সম্পর্কে কোরআনের আয়াতটি হচ্ছে : সাওরাহিকুহু ছউদান। অর্থাৎ অতি সত্বর আমি তাকে ছউদ দোজখে নিক্ষেপ করব। (সূরা মোদ্দাস সির, আয়াত : ১৭)।
ছউদ জাহান্নামের একটি পর্বতের নাম। যার উচ্চতা সত্তর বছরের দূরত্বের সমান। যার ওপর থেকে কাফেরদেরকে দোজখের নি¤œস্তরে নিক্ষেপ করা হবে। এভাবে পর্বত চূড়ায় বার বার উঠানো হবে এবং নিক্ষেপ করা হবে এবং এ ধারা চলতেই থাকবে।
ছউদ দোজখের আজাবে লিপ্ত কাফেরদের কথা বলা হয়েছে সূরা মোদ্দাসসির-এর ১৭নং আয়াতে এবং সূরা নিসা-এর ১৪৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে মোনাফেকদের আজাবের কথা। অর্থাৎ দোজখের সর্বনি¤œ স্তরে হবে মোনাফেকদের ঠিকানা। প্রথমোক্ত আয়াতে বর্ণিত কাফেরদের কথা বলা হলেও মোনাফেকরাও তাদের অন্তর্ভুক্ত বিধায় তারাও একই শ্রেণীর আজাব ভোগ করবে এটা ধারণা করা যায়। কারণ মোনাফেকদের ঠিকানা দোজখের সর্বনি¤œ স্তরে বলে সূরা নিসার আয়াতে বলা হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, এক শ্রেণীর কাফেরের ন্যায় মোনাফেকদের ঠিকানাও হবে দোজখের সর্বনি¤œ স্তরে। তাদেরকেও পর্বত চূড়া হতে ধাক্কা দিয়ে দোজখের তলদেশে তথা সর্ব নি¤œস্তরে ফেলে দেওয়া অসম্ভব নয়। মোনাফেকদের ওপর আজাবের এটি এক শোচনীয় ও ভয়াবহ ছক।
সর্বাধিক কঠোর আজাব
কাফেরদের চেয়ে সর্বাধিক কঠোর ও ভয়াবহ আজাব মোনাফেকদের ওপর কেন হবে এরূপ প্রশ্ন নতুন নয়। অতীতেও এ ধরনের প্রশ্ন ছিল। বিখ্যাত তাফসিরে খাজেনে এরূপ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে ‘ইন্নাল মোনা ফিকা মিছ লাল কাফেরি ফিল কোফ রিওয়া জিয়াদাতন, ওয়া হুয়া আন্নাহু যাম্মা ইলা কোফরিহি নাওআন আখারা মিনাল কোফরি আখবাছু মিনহু ওয়া হুওয়াল ইস্তেহজউ বিল ইসলামি ওয়াল মুসালিকীন ওয়া ইফসাউ আসরারিল মুসলিমীন ওয়া নকলুহা ইলাল কোফফারি, ফালি হাজাস সাবাবি জাআলাল্লাহু আজাবাল মোনাফিকীনা আশাদু আজাবান মিনাল কোফফারি।’ মর্মানুবাদ কাফেরের ক্ষেত্রে মোনাফেক কাফেরের মতোই এবং অধিকতর হচ্ছে সে কাফেরের অপর একটি শ্রেণীকে কাফেরের সাথে জড়িয়ে ফেলে যা কোফক অপেক্ষাও জঘন্য কদর্য, আর তা হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের উপহাস করা এবং মুসলমানদের গোপনীয় বিষয়গুলো প্রকাশ করে দেওয়া এবং কাফেরদের নিকট বলে দেওয়া নকল করা। সুতরাং এসব কারণে কাফেরদের চেয়ে মোনাফেকদের ওপর আজাবের তীব্রতা ও কঠোরতা অধিক।
এ বর্ণনা হতে প্রতীয়মান হয় যে, মোনাফেকদের আচার-আচরণ ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে এতই বৈরী ও বিদ্বেষাত্মক যে, কাফেরদেরকেও হার মানায়। রাসূল (সা.) জীবনে মদিনায় মুসলমানদের সাথে মোনাফিকরা যেসব জঘন্য আচরণ প্রদর্শন করে এবং পরিণতি কী ঘটেছিল তার কিছুটা আভাস পূর্বে প্রদত্ত হয়েছে।
কোরআনে মোনাফেক প্রসঙ্গ
কোরআনের অসংখ্য আয়াতে মোনাফেকদের জঘন্য আচরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং মুসলমানদেরকে তাদের থেকে সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে, তাদের দ্বিমুখী নীতি এবং মুসলমানদের সাথে তাদের শঠতা ও বিশ্বাস ঘাতকতার কথা বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। তাই তাদের করুণ পরিণতি হচ্ছে দোজখের সর্বনি¤œ স্তর, সে কথাও কোরআনেরই ঘোষণা। সূরাতুল ‘কাফেরুন’ নামক একটি ক্ষুদ্র সূরা যেমন কোরআনে রয়েছে তেমনি সূরাতুল মোনাফিকুন নামক একটি বড় সূরাও বিদ্যমান। ৬৩ নং এ সূরাটি ২৮ পাড়ায় রয়েছে। এতে বলা হয়েছেÑ
যখন মোনাফেকরা আপনার নিকট আসে তারা বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি নিশ্চয়ই তার রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মোনাফেকগণ অবশ্যই মিথ্যাবাদী। (আয়াত : ১)
এ সূরার শানে নুজুল সম্পর্কে একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়ে থাকে, যার সাথে ইহুদি মোনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই-এর ভূমিকা ছিল প্রধান। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, মদিনায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পূর্বে ইহুদি মোনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে ওবাহ-এর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের পড়ে আবদুল্লাহর নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব বিলীন হয়ে যায় এবং এ জন্য সে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মোহাজেরদের শত্রুতা আরম্ভ করে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তথাকথিত মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই-এর ভূমিকাটি লক্ষ্য করার মতো।
বোখারি ও মুসলিম প্রভৃতির বর্ণনা অনুযায়ী। সাহাবি জায়দ ইবনে আরকাম (রা) বলেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে একটি সফরে বের হই এবং সেখানে লোকেরা (দুর্ভিক্ষজনিত কারণে) ক্ষুধা পিয়াসের কষ্ট ভোগ করছিল। এ ঘটনাও বর্ণিত আছে যে, জনৈক মোহাজের কোনো ব্যাপারে ক্ষিপ্ত হয়ে একজন আনসারীকে থাপ্পড় মেরে ছিলেন। আনসারী তার সাহায্যের জন্য আনসারদেরকে ডাকে এবং মোহাজেরও তার মদদ করার জন্য মোহাজেরগণকে আহ্বান জানান। তখন মোহাজেরদের সংখ্যা ছিল গণ্য এবং আনসারদের বিপুল। রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘটনার খবর শুনে বললেন, খুবই খারাপ ব্যাপার, ঘটনার এভাবে সমাপ্তি ঘটে যায়।
উল্লিখিত আবুল্লাহ ইবনে ওবাই ঘটনার খবর শুনে উত্তেজিত হয়ে বলল মোহাজের এরূপ ঘটনা ঘটিয়েছে কী? ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিরুদ্ধে প্রচারণার একটা সুযোগ সে পেয়ে গেল। সে উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত হয়ে বলল আমাদের খাদ্য খেয়ে এসব লোকের মোহাজেরদের দিন ফিরেছে, সাহস বেড়ে গেছে। আল্লাহর শপথ মদিনায় পৌঁছার পর আমরা শহরের গণ্যমান্য নেতৃবর্গ নিকৃষ্ট পরদেশীদেরকে বের করে দেব এবং সে লোকদেরকে সাবধান করে দেয় যে, এ নবীর নিকট অবস্থানকারী অর্থাৎ মোহাজেরদের সাথে তোমাদের কেউ যেন কোনো প্রকারের লেনদেন না করে, যাতে তারা দুঃখ-কষ্টে এবং খাদ্যাভাবে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। জায়দ বলেন, আবদুল্লাহর এসব বকাবকি আমি নিজ কানে শুনেছি এবং আমার চাচা-সাদ ইবনে উব্বাদা, যিনি খজরজ গোত্রেরও নেতা, এর নিকট ব্যক্ত ব্যক্ত করি। তিনি গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন। তিনি আমাকে ডেকে জানতে চান জায়দ বলেন, আমি আবদুল্লাহর সব কথা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সামনে সুস্পষ্টভাবে বলে দিই। অতঃপর তিনি আবদুল্লাহকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন। এ  মোনাফেক নেতা অস্বীকার করে শপথ করতে থাকে এবং তার আন্তরিকতার ঢোল পিটাতে থাকে। জায়দ বলেন, লোকেরা আমাকে মিথ্যাবাদী মনে করে আমার তিরস্কার ও নিন্দা করতে থাকে, এমন কি লজ্জিত হয়ে আমি ঘরে বসে থাকি। কিন্তু আল্লাহর নিকট আশাবাদী ছিলাম যে, কোরআনে আমার ব্যাপারে কোনো কথা নিশ্চয় নাজিল হবে। অতঃপর যখন আয়াত নাজিল হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে ডেকে বললেন আল্লাহতায়ালা তোমাকে সত্যবাদী সাব্যস্ত করেছেন। এ পটভূমিকায় সূরা ‘আল-মোনাফিকুন’ নাজিল হয়।
মোনাফেকের অভ্যাস
বিভিন্ন হাদিসে মোনাফেকের অভ্যাস ও লক্ষণসমূহের কথা বলা হয়েছে। মুসলিম শরিফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণিত হাদিসে হুজুর (সা.) বলেছেন, মোনাফেকের চারটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। এ চারটি খাসলত বা অভ্যাস হচ্ছে : (১) যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে (২) যখন চুক্তি করে তা ভঙ্গ করে (৩) যখন ওয়াদা বা অঙ্গীকার করে, তা পূরণ করে না এবং (৪) যখন ঝগড়া করে বেহুদা (ফালতু) বকে।
হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, মোনাফেকের আলামত তিনটিÑ যদিও সে রোজা রাখে এবং নামাজ পড়ে এবং সে নিজেকে মুসলমান বলে মনে করে যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মদনী জীবনে মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই-এর ভূমিকা ছিল খলনায়কের, সূরা আল-মোনাফিকুনে যার বর্ণনা রয়েছে। তার এবং তার বিভ্রান্ত দলের মোনাফেকদের ইসলাম ও মুসলমানবিরোধী আরো ধ্বংসাত্মক নানা ভূমিকার বিবরণ কোরআনের বহু স্থানে রয়েছে, যেসব কাহিনীর কথা আপাতত থাক, তবে এ প্রসঙ্গে হজরত মূসা (আ.)-এর যুগের একজন বিখ্যাত মোনাফেকের নাম স্মরণ করতে হয়, যার মতো মোনাফেকরা তাদের স্থায়ী ঠিকানা জাহান্নামের সর্ব নি¤œস্তর নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে তার নাম সামেরী।
ইবনে কামীরের বর্ণনা অনুযায়ী ইসরাইলি গ্রন্থাবলিতে সামেরীর নাম হারুন উল্লিখিত হয়েছে। তবে তার নাম সম্পর্কে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে, তার নাম ছিল মূসা। সে ইসরাইলি অথবা কিবতী ছিল বলেও মত রয়েছে। তবে সর্বসম্মত মত হচ্ছে, সামেরী হযরত মূসা (আ.)-এর যুগের একজন পাক্কা মোনাফেক ছিল এবং মোনাফেকদের ন্যায় প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির মাধ্যমে মুসলমানদেরকে গোমরাহ ও বিভ্রান্ত করার চিন্তায় ব্যস্ত থাকত। এ মোনাফেক সামেরী হযরত মূসা (আ.)-এর অনুপস্থিতিতে গোবাছুর  প্রস্তুত করে বনি ইসরাইলকে তার পূজা করার প্রথা চালু করে, যার বিস্তারিত বিবরণ সূরা আরাফে বিদ্যমান।
একজন আরব কবি মোনাফেক সামেরীর নাম মূসা বলে উল্লেখ করে এক চমৎকার ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কবির ভাষায়Ñ “ফা মুসাল্লাজি রাব্বাহু জিব্রিলু কাফেরান ওয়া মুসাল্লাজি রাব্বাহু ফিরআনু মুসলিমান অর্থাৎ হজরত জিব্রিল ফেরেশতা যে মুসার লালন-পালন করেন সে ছিল (যামেরী) কাফের। আর অত্যাচারী ফেরাউন যে মূসাকে (হযরত মূসা) লালন-পালন করেন তিনি ছিলেন মুসলমান। সামেরী (মূসার)-এর গোবাছুর প্রস্তুত করার কাহিনী যেমন কোরআনে বর্ণিত হয়েছে তেমনি ফেরাউনের গৃহে হযরত মূসা (আ.)-এর প্রতিপালিত হওয়ার বিবরণও রয়েছে। সেকালের এ মোনাফেক সামেরীর মানসপুত্রদের বিচরণ আজও সর্বত্র বিদ্যমান। (সমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন