“হে ঈমানদারগণ। তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববতী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাক্্ওয়া অর্জন করতে পার।” (সূরা আল বাকারাহ্্-১৮৩) একই সূরায় ১৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে পবিত্র রমজান মাসেই আল্্-কুরআন নাযিল করা হয়েছে। শুধু পবিত্র আল-কুরআনই নয়, এই রমজান মাসেই অন্যান্য আসমানী কিতাব ও সহীফা নাযিল করা হয়েছে। রমজান মাসের ১ম অথবা ৩য় দিনে নাযিল হয়েছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রতি তাঁর সহীফা। হযরত দাউদ (আঃ) এর প্রতি যবুর কিতাব নাযিল হয় এ মাসেই ১২ কিংবা ১৮ তারিখে। হযরত মূসা (আঃ) এর প্রতি তাওরাত কিতাব নাযিল হয় এ মাসের ৬ তারিখে এবং হযরত ঈসা (আঃ) এর প্রতি ইঞ্জিল কিতাব নাযিল হয় ১২ই কিংবা ১৩ই রমজান। পবিত্র কোরআনের উপরের আয়াতের সূত্র জানিয়ে দেয় সাওম বা রোযা পালনের ইতিহাস দীর্ঘ। মুসলমানেরা রোযা রাখলে তাকে বলা হয় সিয়াম। খ্রিষ্টানরা রোযা রাখলে তাকে বলে ফাস্টিং, হিন্দুরা বা বৌদ্ধরা রোযা রাখলে তাকে বলা হয় উপবাস। বিপ্লবীরা রোযা রাখলে তাকে বলা হয় অনশন। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে অর্থাৎ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষ সবকিছুকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোযা রাখলে তাকে বলা হয় অটোফেজি। অঁঃড়ঢ়যধমু শব্দটি গ্রিক শব্দ। “অঁঃড়” অর্থ নিজে নিজে এবং “ঢ়যধমু’’ অর্থ খাওয়া। সুতরাং অঁঃড়ঢ়যধমু মানে নিজে নিজেকে খাওয়া। চিকিৎসা বিজ্ঞান নিজের গোস্ত নিজেকে খেতে বলে না। মানব শরীরের কোষগুলো বাহির থেকে কোন খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে তখন মেডিকেল সায়েন্স এর ভাষায় তাকে অঁঃড়ঢ়যধমু বলা হয়। পাঠকদের সুবিধার্থে আরেকটু সহজভাবে বলা যায়, আমাদের ঘরে যেমন ডাস্টবিন বা ময়লা আবর্জনা ফেলার কোন ঝুঁড়ি থাকে আবার অন্যদিকে আমাদের কম্পিউটার গুলোতে রিসাইকেল বিন থাকে তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন বা ঝুঁড়ি থাকে।
সারাবছর শরীরের কোষগুলো খুব সুস্থ থাকার কারণে ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে কোষগুলোতে অনেক ময়লা ও আবর্জনা জমে যায়। শরীরের কোষ গুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরের বিভিন্ন প্রকার রোগের উৎপন্ন করে। ডায়াবেটিস বা ক্যান্সারের মতো অনেক বড় বড় রোগের জন্ম হয় এখান থেকে। মানুষ যখন খালি পেটে থাকে তখন মানব শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর আমাদের মতো অলস হয়ে বসে থাকে না। তখন প্রতিটি কোষ তার ভিতরের ময়লা ও আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে। আমাদের মতো কোষগুলোর আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে। বিস্তারিত ভাবে মেডিক্যাল সাইন্স এর পদ্ধতিকেই বলা হয় অঁঃড়ঢ়যধমু। খুব বেশিদিন হয়নি চিকিৎসা বিজ্ঞান অঁঃড়ঢ়যধমু র সাথে পরিচিত হয়েছে ২০১৬ সালে। এই অঁঃড়ঢ়যধমু র আবিষ্কারের জন্য জাপানের ডাক্তার ওশিনরি ওসুমি ২০১৬ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান। এরপর থেকেই আধুনিক সব মানুষ রোযা রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যারা প্রতিদিন স্বাস্থ্যের কথা ভেবে রোযা রাখতেন না এখন তারাই সু-স্বাস্থ্যের কথা ভেবে রোযা রাখতে চান। রোযার আসল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। একই সাথে আমাদের শরীর ও মনের জন্য এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা রোযা রাখার কারণে কমে আসে। নির্দিষ্ট সময়ে রোযা রাখার কারণে আমাদের শরীরের চর্বি ইঁৎহ হয়। কিন্তু এই উপবাস যদি দীর্ঘসময় ধরে করা হয় তাহলে মাংসপেশীর শর্করা ভেঙ্গে যায় যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। রাসুল (সাঃ) আমাদের সেহেরি খেতে এবং ইফতারে দেরি না করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। নিয়মিত রোযা রাখলে হৃদরোগের ঝুঁকি ৫৮% কমে যায়। রোযা রাখার কারণে ক্ষতিকর কলেস্টেরল খউখ বা ইধফ ঈযড়ষবংঃবৎড়ষ কমে সুগারের গবঃধনড়ষরংস এর উন্নতি হয়। এটা ওজন বৃদ্ধি পাওয়া এবং ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি কমায় অর্থাৎ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
রোযা রাখলে ৩০-৪০% কলেস্টেরল বা ঐউখ বৃদ্ধি পায় এবং ঞএ কলেস্টেরল শরীরের ওজন ইগও কমে যায়। এক কথায় বলা যায় রোযা হচ্ছে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর ঔষূধবিহীন অন্যতম একটি মাধ্যম। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “রোযা রাখ ও সুস্থ থাকো।” হযরত মুসা (আঃ) ৪০ দিন রোযা পালন করে আল্লাহর ওহী পেয়েছিলেন। ঈসা (আঃ) ও তাই। তাঁরা তাঁদের অনুসারীদের ঐ ৪০ দিন রোযা রাখার নির্দেশ দেন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও তাদের নিজ নিজ ধর্মের সিয়াম সাধনা ঐ সব রোযা বা উপবাসের সাথে তুলনীয় নয়। পূর্ববর্তীদের রোযার নিয়ম ছিল এশার পর ঘুমিয়ে পরলে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার এবং কামাচার হারাম হয়ে যেতো। ইসলামের শরীয়াহ সুবাহ সাদিক থেকে সুর্যাস্ত সময় পর্যন্ত কিছু খাওয়া বা পান করা এবং যৌন তৃপ্তিকর কোন কিছু করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুর্যাস্তের পর থেকে সুবাহ সাদিকের আগ পর্যন্ত যে কোন আহার বিহারে সংযম সাধনা নষ্ট হয় না। রোযাদারের জন্য মিথ্যা, পরনিন্দা, পরের অকল্যাণ চিন্তা ও মন্দকর্ম শুধু নিষিদ্ধই নয় অনৈতিক ভাবেও এর চর্চা বা পরিচর্চা করলে প্রকৃত রোযা হবে না।
বর্তমানে এক মাস রোযার পরেও যদি কেউ সাওয়ালের রোযা, মহরমের রোযা, আরাফাতের দিনে রোযা, সপ্তাহে দুইদিন বা মাসে তিনদিন রোযা রাখেন তাহলে তাঁদের স্বাস্থ্যের উপকারিতা অন্যদের চেয়ে বেশি হবে যা রাসুল (সাঃ) করেছেন। রোযার মাসে সিয়াম সাধনার পর তারাবীহর নামাযসহ অন্যান্য ইবাদাত বিশেষ করে যাকাত (স্বচ্ছল ব্যক্তিদের) ও ফিতরা প্রদান, লাইলাতুল কদর, ইতিকাফ পালনের মাধ্যমে মোমেন নিজেকে শুধু পরিশুদ্ধই করে না, দোয়া কবুলের সুযোগ গ্রহণ করে আখিরাতের নাযাতের পথ খুজে নেয়। সাওম, সিয়াম বা রোযার আসল উদ্দেশ্য মানুষের জাগতিক ও মনোদৈহিক উৎকর্ষ সাধন রোযাদের মনে আধ্যাত্মিক চৈতন্য জাগ্রত হয়। রোযার অনুশীলনে রোযাদারকে আত্মসংযমী, আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে ধৈর্য্য ও সহানুভুতির অনুভুতি জাগায়। ফলে রোযা রিপুগুলোকে কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে উঠতে জাগায়। সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ আসমানী কিতাব আল-কুরআনে রোযার আবেদন অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে। মুসলমানের জীবনে সাওম, সিয়াম বা রোযা শুধু উপবাস নয়, রোযায় উপবাস আছে, কিন্তু উপবাসে রোযা বা সাওম নেই। ফলে উপবাসের সাথে সাওম বা রোযার গুণগত তফাতটাও গৌণ নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন