শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

তাকওয়া : সুরভিত জীবনের পাথেয়

আব্দুল্লাহ আলমামুন আশরাফী | প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:১০ এএম

হযরত আবু যর গিফারী রা.। পুরো নাম আবু যর জুনদুব ইবনে জুনাদাহ আল কিন্দী আল গিফারী । একজন খ্যাতিমান সাহাবী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন সঙ্গীদের অন্যতম। নবীজী (সা.) এর প্রাণোৎসর্গী শিষ্য। ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে তিনি মুসলমান হন। তিনি ইসলাম গ্রহনের ধারাবাহিকতায় চতুর্থ বা পঞ্চম ব্যক্তি। সুদৃঢ়ভাবে কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনা মনে চলার ক্ষেত্রে তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অত্যন্ত স্নেহভাজন প্রিয় এই সাহাবী একদিন নবীজির কাছে কিছু নসীহতের আবদার করেন। জীবন পথের পাথেয়স্বরূপ কিছু উপদেশ কামনা করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খুবই উপকারী কয়েকটি উপদেশ প্রদান করেন। একেকটি উপদেশ স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত। যেগুলো গভীর মর্মসমৃদ্ধ, আলোকিত জীবন গঠনের মৌলিক পাথেয়। কী সেই অসাধারণ উপদেশমালা?
১. তাকওয়া অবলম্বন কর। মনে রেখো, তাকওয়া তোমার জীবনের প্রতিটি কাজে অপার সৌন্দর্য বয়ে আনবে। ২. কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর যিকিরে সবিশেষ মনোযোগ দাও। মনে রেখো, এ দুটো কাজ তোমাকে আকাশে আলোচনার বস্তু বানাবে এবং তোমার জন্যে পৃথিবীতে আলো বয়ে আনবে। ৩. দীর্ঘ সময় চুপ থাকার অভ্যাস করে নাও। শয়তানকে তোমার কাছ থেকে দূরে রাখতে এটা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে এবং তোমার দ্বীনী কাজে এটা ভীষণ সহায়ক হবে। ৪. অধিক পরিমাণে হাসাহাসি করা থেকে বিরত থেক। কেননা, অধিক হাসি অন্তরকে নির্জীব করে দেয় এবং এতে করে চেহারার ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে যায়।
৫. সব সময় সত্য কথা বলবে এবং সত্যের পথে অটল অবিচল থাকবে। যদিও এটি অত্যন্ত তিক্ত ও সুকঠিন কাজ। ৬. আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কারো সমালোচনাকে ভয় করবে না। ৭. নিজের দোষত্রুটি সম্পর্কে অবগতি যেন তোমাকে অন্যের দোষত্রুটি অনুসন্ধানে বাধা দেয়।
দীর্ঘ এই উপদেশপূর্ণ হাদিসটি ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনুল হুসাইন আল বায়হাকী রহ. তার কিতাবে বর্ণনা করেছেন। যিনি ৩৮৪ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করে ৪৫৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। কী অসাধারণ একেকটি উপদেশ! কত সারগর্ভ প্রতিটি নসীহত। আলোকিত সফল জীবন গঠনে কতটা কার্যকরী প্রতিটি বাণী। গুরুত্বপূর্ণ এই সাতটি উপদেশের মধ্য থেকে আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় প্রথম উপদেশটি। তাকওয়া।
তাকওয়া মানে কী? তাকওয়া শব্দের শাব্দিক অর্থ বেঁচে থাকা। হাফেজ ইমাদুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে উমর ইবনে কাসির রহ. (জন্ম- ৭০০ হিজরী, মৃত্যু -৭৭৪ হিজরী) তাকওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, “তাকওয়া হচ্ছে, আল্লাহর ভয়ে শিরক থেকে বেঁচে থাকা এবং আল্লাহর পরিপূর্ণ আনুগত্য করা”। (তাফসীরুল কুরআনীল আযীম, ১/৫৪ দারুল হাদীস কায়রো মিসরের সংস্করণ)।
আল্লামা আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল কুরতুবী রহ. ( মৃত্যু - ৬৭১ হিজরী) তার তাফসীরে তাকওয়ার ব্যাখ্যায় বলেন : ‘একবার আমিরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব রা. হযরত উবাই ইবনে কাব রা.কে তাকওয়ার পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। উবাই রা. তখন পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন- আমিরুল মুমিনীন! আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড় দিয়ে পথ চলেছেন? উমর রা. বলেন- হ্যাঁ। উবাই রা. বলেন- তখন কিভাবে পথ চলেছেন? কাপড় টেনে খুব সতর্কতার সাথে চলেছি,যেন গায়ে কাঁটা না লাগে- উমর রা. এর জবাব। উবাই রা. বলেন- এটাই তাকওয়া। অর্থাৎ খুব সতর্কতার সাথে দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করা,যাতে কখনো আল্লাহর নাফরমানী না হয়ে যায়। আমার স্রষ্টা যেন সব সময় আমার উপর সন্তুষ্ট থাকেন’। (আল জামে লি আহকামিল কুরআন, ১/১৪৭)।
কুরআন মাজীদের পাতায় পাতায় রয়েছে তাকওয়ার নির্দেশনা। তাকওয়ার সুনির্মল আলোকরেখা ধরে জীবনপথে সামনে এগিয়ে যাওয়া পবিত্র কুরআনুল কারীমের মৌলিক শিক্ষাগুলোর অন্যতম। মুমিনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই তাকওয়া। যথার্থভাবে আল্লাহভীতি তথা তাকওয়াকে হৃদয়ের গভীরে স্থান দিবে- একজন মুমিনের কাছে এটা কুরআনের প্রাণের দাবি। ইরশাদ হয়েছে : হে মুমিনগণ! অন্তরে আল্লাহকে সেইভাবে ভয় কর, যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত। সাবধান অন্য কোনও অবস্থায় যেন তোমাদের মৃত্যু না আসে, বরং এই অবস্থায়ই যেন আসে যে, তোমরা মুসলিম। (সূরা আলে ইমরান ৩: ১০২)। আমাদের জীবনতরী অনিশ্চয়তা আর সংকটের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে অহর্নিশ। সংকট যেন আমাদের পিছু ছাড়ে না। একটা সংকট কাটল তো আরেকটা এসে হাজির। যাপিত জীবনে এভাবেই আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ছুটে চলছি। তো সংকটজর্জরিত জীবন থেকে মুক্তি পেতে, আধার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যেতে মানবতার মুক্তির মূলমন্ত্র ইসলাম কী বলে? মানবজাতির সফলতার পয়গাম নিয়ে পৃথিবীতে আসা ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনুল কারীমের নির্দেশনাই বা কী? চলুন দেখি কুরআনের ভাষায় সংকট মুক্তির কালজয়ী নির্দেশনার গল্প শুনে আসি :
‘যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করবে তথা তাকওয়া অবলম্বন করবে , আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোন পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। যে- কেউ আল্লাহর উপর নির্ভর করে আল্লাহই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, আল্লাহ তাঁর কাজ পূরণ করেই থাকেন। (অবশ্য) আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন । (সূরা তালাক ৬৫: ২-৩)। হাফেজ ইবনে কাসির রহ. উপরোক্ত আয়াতে কারিমার তাফসীরে লিখেন- ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. (মৃত্যু- ২৪১ হিজরী) তার মুসনাদে উল্লেখ করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আবু যর গিফারী রা. কে লক্ষ করে বলেন, আবু যর! যদি পৃথিবীর সকল মানুষ এই আয়াতের উপর আমল করত অর্থাৎ তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে তাদের সকল সংকট নিরসনকল্পে এটাই (তাকওয়া)যথেষ্ট হয়ে যেত। (তাফসীরুল কুরআনিল আজীম ৪/ ৪৫০)।
আয়াতের নির্দেশনা সুস্পষ্ট। তাকওয়াপূর্ণ যিন্দেগী অবলম্বন সকল সংকট নিরসনের মূলমন্ত্র। এই যে জীবন জীবিকার প্রশ্নে অস্থির প্রতিটি মানুষ দিকভ্রান্তের মত ছুটে ফিরছে সর্বত্র। একটুখানি সুখের প্রত্যাশায় দিনমান খেটে যাচ্ছে সবাই। তবুও কাঙ্ক্ষিত সুখপাখিটা যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে। কোথাও যেন সুখের ছিটেফোঁটারও যেন দেখা মিলছে না। কাক্সিক্ষত সুখের দেখা পেতে হলে চিরসুখের সুনির্মল ঠিকানা ইসলামের দিকে ফিরে আসার বিকল্প নেই। কুরআন মাজীদের মৌলিক নির্দেশনা তাকওয়ার মনকাড়া সৌরভে নিজেকে বিমোহিত করুন। সুখময় সুরভিত জীবন লাভে ধন্য হোন। তাকওয়ার সুরভিত প্রান্তরে আপনাকে স্বাগতম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন