শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

দেশটা আসলে কীভাবে চলছে

প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হারুন-আর-রশিদ
একজন পর্যটক বিশ্বের ৯৯টি দেশে ভ্রমণ করে শততম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করতে এসেছেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সফর শেষ করে যাওয়ার মুহূর্তে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসারকে কিছু কথা বলেছেন তা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি বলেছিলেন, এতদিন আমি নাস্তিক ছিলাম। বাংলাদেশে এসে এখন আস্তিক হয়েছি। চমৎকার দেশ বাংলাদেশ, এসেই হারালাম মূল পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আমার লাগেজ। পরে এক দালালের মাধ্যমে পেলাম। বাংলাদেশ সফরে এসে বুঝলাম এখানে নেই কোনো সিস্টেম কিন্তু দেশটা চলছে। ৯৯টি দেশের প্রতিটি দেশই কোনো না কোনো পদ্ধতিতে চলছে। একমাত্র বাংলাদেশকে দেখলাম এর ব্যতিক্রম। অথচ দেশটা চলছে। আমার ভাবনার জগতে প্রচ- ঝাঁকুনি ছিল। সেটা হলো ¯্রষ্টা যদি নাই থাকেন তবে দেশটা চালাচ্ছে কে? দেশটা ঘুরে আমার মনে হয়েছে, নিশ্চয়ই সুপ্রিম পাওয়ার বলে কিছু একটা আছে। সেই পাওয়ারই দেশটা চালাচ্ছে। এখন আমি ¯্রষ্টাকে বিশ্বাস না করে পারি না। বাংলাদেশকে ধন্যবাদ সে আমাকে আস্তিক বানিয়েছে (সূত্র : নয়া দিগন্ত, ৩১ মার্চ ২০০৫)।
বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে এবার একটু পেছনের দিকে তাকানো যাকÑ ১৯৭৩ সালে বিচারপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথম সুনাম অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বর্তমান সিইসি রকিবউদ্দীনও চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। গত ৪৫ বছরে আমরা যে ১২টি নির্বাচন কমিশন পেয়েছি তার মধ্যে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। তবে বিগত সময়ে যতগুলো নির্বাচন কমিশনার পেয়েছিলাম তার মধ্যে বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশন ব্যর্থতার দিক থেকে সবার সেরা। তাকে ব্যর্থতার জন্য একটি উপহার আমাদের দেওয়া উচিত।  ব্যর্থ এই নির্বাচন কমিশনারের কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্র লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ জন্য মরহুম এবিএম মূসা তার এক নিবন্ধে প্রথম আলো (২ ডিসেম্বর ২০১৩) পত্রিকায় লিখেছিলেন, নির্বাচন না হলেও ফলাফল পাওয়া যাবে। উৎকণ্ঠার কোনো কারণ নেই।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার রচিত বিএনপির সময়-অসময় গ্রন্থে লিখেছেনÑ ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে জিয়ার নেতৃত্বে অষ্টম বেঙ্গলের বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করলেন। এর আগে জিয়া সবার কাছে আনুগত্য চেয়েছিলেন। মেজর শওকতকে জিয়া ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলেন। কিন্তু আজকের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক জিয়াকে যথেষ্ট সম্মান দেয়নি। আমরা বীরের সম্মান দিতে জানি না। কলকাতা ফোর্ড উইলিয়ামে বাংলাদেশের একজন মাত্র মুক্তিযোদ্ধার ছবি আছে বুকের ওপর দু-হাত আড়াআড়ি করে দাঁড়ানো। তিনি জিয়াউর রহমান। জিয়া শেখ মুজিবকে নেতা মানতেন এবং সবসময় তার সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলতেন। দুঃখজনক যে, বাংলাদেশ বিভাজনের রাজনীতির নেতিবাচক শিকার হয়েছেন যে কয়েকজন, জিয়াউর রহমান তাদের একজন।
১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডি এক ভোজসভায় বলেছিলেন জিয়াকে উদ্দেশ করে-Your Position is already assured is the annals of the history of your country as a brave freedom fighter, who was the first to declare the independence of Bangladesh.
সম্প্রতি (এপ্রিল-২০১৬) ভারতে সফরে গিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলির ওজন একটু বেড়েছে। কলকাতা মিউজিয়ামে (১১ এপ্রিল ’১৬) গিয়ে পশ্চিমবাংলার একজন সত্যানুসন্ধানী বাঙালির সাথে কথা হয়। তিনি বললেন, দাদা আপনারা কি বাঙালি? বললাম, বাংলাদেশের বাঙালি। তিনি খুশি হলেন। বললেন, আমরা বাঙালিরা এক হতে পারলে বৃহত্তর বেঙ্গল নামে একটি রাষ্ট্র হতো। বাঙালিরা বিশ্বের একটি বৃহৎ জাতি হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরতে পারত। কিন্তু সেটা হতে দেয়নি তিন ট্যাবলেট। বললাম, বুঝলাম না আপনার কথা। দাদা, ওই তিন ট্যাবলেট হলো- জওহরলাল নেহরু, গান্ধীজী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই তিন ব্যক্তি।
লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দিয়ে বঙ্গমাতার অঙ্গ ছেদ করেছে। তারা নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসু এবং নবাব সিরাজদৌল্লা যিনি ফাস্ট ফ্রিডম ফাইটার এগেইনেস্ট ব্রিটিশ রিজিম (First freedom fighter against British regime)- দুজনেই ছিলেন গ্রেটার বেঙ্গলের পক্ষে। আমি তাকে বললাম, একটু আস্তে কথা বলুন। লোকে শুনলে ক্ষতি হতে পারে। তিনি বললেন, গণতন্ত্র ভারতকে এই কথা বলার সুযোগ দিয়েছে। তিনি আরো বললেন, মানুষ দেবতাতুল্য নয়। ওই তিন ব্যক্তি কি দেবতা নাকি মানুষ, যদি মানুষ হয় তাহলে তারা ধোয়া তুলসী পাতা নয়। মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। আমি বললাম, জিন্নাহ সাহেবও তো ভুল করেছেন। তিনি বললেন, জিন্নাহ ধর্মনিরপেক্ষবাদী ছিলেন। আমি বললাম, ‘টু ন্যাশন থিউরি’ এটা তো জিন্নাহ আবিষ্কার করেছেন। ভদ্রলোক বললেন, এই বাক্যটি জিন্নাহর ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভারতকে দ্বিখ-িত করল মাউন্ট ব্যাটন; নেহেরু এবং বল্লব ভাই প্যাটল (হোম মিনিস্টার) এরাই অখ- ভারতকে দ্বিখ-িত করেছেন। শুধু ভারত বর্ষেই এখন ৮টি দেশ। ভবিষ্যতে এর সংখ্যা ৫৮ হবে না, তাও তো বলা যায় না। আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা এবং পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা নিয়ে একটি বৃহৎ রাষ্ট্র কি হতে পারত না। বঙ্গভঙ্গ যারা করেছিলেন তাদের নেপথ্যে ছিলেন ওই তিন ব্যক্তি। আজ বাঙালি জাতি শোষণের হাতিয়ার। গ্রেটার বেঙ্গল যদি হতো তাহলে আমরা হতাম উপমহাদেশে সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতের চানক্য নীতি আমাদের পেছনে ফেলে দিয়েছে। তিনি আরো বললেন, পশ্চিম বাংলায় বাংলা নেই, আছে হিন্দি। আমি নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালন করলাম। বিষয়গুলো আমি জানতাম। নতুন করে আজ আবার শুনলাম সনাতন ধর্মে বিশ্বাষী একজন বাঙালির মুখ থেকে।
আমরা স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল পেয়েছি। ফলাফলে দেখা গেছে ৩৯৬৫টির মধ্যে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ জিতেছে ২৬৭২টিতে, বিএনপি জিতেছে ৩৭২টিতে। জাতীয় পার্টি ৫৭টি, অন্যান্য দল ২১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছে ৮৮০টি পদ। ২২ মার্চ শুরু হয়ে ছয় ধাপে চার হাজারের বেশি ইউপিতে নির্বাচন শেষ হয়েছে ৪ জুন ২০১৬। ষষ্ঠ ধাপ শেষে ১৩৫টি লাশ দেখেছে দেশবাসী। এর পরও নির্বাচন কমিশনার ও সরকার প্রধান বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। আজ যদি বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকত আর আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে থাকত দেশে একটি ইস্যু নিয়েই বিএনপি জোটকে জনতার মঞ্চ বানিয়ে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালেই ক্ষমতার স্বাদ কেমন তা বুঝিয়ে দিত। অথচ, অদ্যাবধি আওয়ামী লীগ বিএনপিকে শতাধিক ইস্যু দিয়েছে আন্দোলন করার জন্য। কিন্তু তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে কৌশলী রাজনীতি না জানার কারণে।
বাংলাদেশে বড় সমস্যা হলো জনসংখ্যা। বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে ৬ কোটি মানুষের বাস। দক্ষিণ এশিয়ার মোট আয়তন ৪৪ লাখ ৯১ হাজার ৩৫২ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতের আয়তনই ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ৫৯১ বর্গকিলোমিটার। দেশটি স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, শ্রীলঙ্কার আয়তন ৬৫ হাজার ৬১০ বর্গকিলোমিটার, ভুটানের আয়তন ৪৬ হাজার ৬২০ বর্গকিলোমিটার, বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। পাকিস্তানের ভৌগোলিক পরিসীমা ৭ লাখ ৯৬ হাজার ১০১ বর্গকিলোমিটার। মালদ্বীপ ৩০০ বর্গকিলোমিটার, নেপালের ভৌগোলিক পরিসীমা ১ লাখ ৪৭ হাজার ১৭৯ বর্গকিলোমিটার। ৭টি দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার তুলনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করছে বাংলাদেশে। আগামী ২০২১ সালে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় বিশ কোটি। কিন্তু এক ছটাক ভূমিও বাড়বে না। তাহলে এত অল্পপরিসরে ২০ কোটি মানুষ কীভাবে জীবন ধারণ করবে? সেটা শাসক দলগুলো কোনোকালেই চিন্তা করেনি।
ওই সময় জগণের ভোগান্তিটা কী পরিমাণ বাড়বে তা চিন্তা করলে গা শিউরে ওঠে। আমাদের দুঃসময়ের ভাবনাগুলো এখন থেকেই ভাবতে হবে। ১৬ কোটির মধ্যেই জনসংখ্যাকে আটকে রাখতে হবে। একটি পরিচ্ছন্ন দূষণমুক্ত সবুজে ঘেরা জন নিরাপদ স্মার্ট ও আলোকিত মানবিক রাষ্ট্রের জন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করে দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষ বাড়লে বর্জ্য আর্বজনা বাড়বে। শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ সব কিছুই বেড়ে যাবে। দেশটা এখন এক স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্ন অনুযায়ী চলছে। এ কারণে যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ সেটা পারেনি। মিথ্যা এখন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যে যত মিথ্যা কথা বলতে পারবে সেই বিজয় অর্জনে সক্ষম। গণতন্ত্র এবং সভ্যতার মাপকাঠি কি তা আমরা ভুলতে বসেছি। দুর্নীতিই এখন নীতি। সত্য কথা বললেই বিপদ। জাতিসংঘের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ঊঝঈঅচ) বলেছে, রাষ্ট্রে সুশাসনের ৮টি বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো (১) জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসন (Participatory), (২) ঐকমত্যভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা (Consensus oriented), (৩) জবাবদিহিতামূলক (Accountable) জনপ্রতিনিধি, (৪) স্বচ্ছতা অবলম্বন (Transparent), (৫) দায়িত্ব বোধসম্পন্ন (Responsibility), (৬) কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসন (Effective and efficient), (৭) ক্ষমতাভিত্তিক ও ন্যায়সঙ্গত (Equitable) এবং (৮) আইনের শাসনমূলক ব্যবস্থা (Subjected to rule of law)। উল্লিখিত ৮টি বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় আছে কিনা সেটা এখন এক বড় প্রশ্ন।
গত ১৩ জুন ২০১৬ সোমবার প্রথম আলো পত্রিকায় লিড নিউজ ছাপিয়েছে দুই দিনে গ্রেফতার সাড়ে ৫ হাজার। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গি মাত্র ৮৫ জন, তাহলে কি ধরে নিতে হয় বাকি সব ব্যক্তি হলো বিরোধী দলের। অনেকেই বলছেন, এটা গ্রেফতার বাণিজ্য। অন্যদিকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক শক্তিকে খর্ব করার শামিল। মূলত দেশে চলমান গুপ্তহত্যা রুখতে হলে সব দলের মধ্যে ঐক্য বজায় রেখে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। এককভাবে শাসক দল এ কাজটি করতে পারবে না বলে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের মতামত পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। ১৩ জুন ২০১৬ একজন পাঠক অনলাইনে তার মতামত ব্যক্ত করেছে এভাবে- জঙ্গিই যদি ধরা না পড়ল তবে এ অভিযানে কী লাভ। রাস্তায় যাকে পাওয়া যায়, তাকে ধরে নিলে তো অপরাধ কমবে না। ঢাকঢোল পিটিয়ে যে অভিযান হয় তাতে কোনো অপরাধীর চেয়ে সাধারণ মানুষই ধরা পড়ে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। তদন্তে যাদের নাম এসেছে বা যাদের নামে নাশকতার অভিযোগ আছে, তাদের জন্য এমন আয়োজন করে অভিযানের দরকার আছে কী? এসব চোখে ধুলা দেওয়া। কাদের মাথা থেকে এসব বুদ্ধি যে আসে। এভাবে একটি দেশ কীভাবে চলবে সেটাই ভাবনার বিষয়।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন