প্রযুক্তির যুগে মমতা, ভালোবাসা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। একটা সময় চিঠিই ছিল দূরের মানুষের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। প্রিয় মানুষের লেখা চিঠি মানুষ একবার পড়তো না, বারবার পড়তো। কখনো চুমু খেতো। চিঠির ভেতর খুঁজে পেত যেন সেই মানুষের ছায়া, ছোঁয়া। চিঠি নিয়ে কবি, সাহিত্যিক লিখেছেন, কবিতা, গান, গল্প। কোন কোন চিঠি হয়ে গেছে ইতিহাস অথবা চিঠি লিখে কেউ হয়েছেন ইতিহাস। সময়ের বিবর্তনে আজ চিঠি বিলুপ্ত প্রায়। প্রিয় কবি নজরুলের লেখা একটা চিঠি পড়ে বোঝা যায়, চিঠি কতো আবেগময়, জীবন্ত হতে পারে। কবি কে তার প্রথম স্ত্রী নার্গিস একটি পত্র লিখেছিলেন। কুমিল্লা থেকে কবি চলে যাওয়ার কিছুদিন দিন পর। বিয়ের পর পরই চরম আপন ভাবা ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে কেউ যায়? কবি নজরুল যে- বাধন হারা। শিকল ছেড়া বিদ্রোহী। সেই চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন পনের বছর! চিঠির শুরু এভাবে-
‹› কল্যানীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে । মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল । পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারি ধারায় প্লাবন নেমেছিল– তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গ লোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দেই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা ।
তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। ‹›
কী অদ্ভুত শব্দচয়ণ। মনেহয় যেন বুকের ভেতর থেকে কথা গুলো টেনে টেনে বের করে কবি গাথছেন চিঠি নামের এক ফুলমালা। কবি চলে আসার কারণ লিখতে অন্তর্যামী কে নিয়ে আসেন। তিনিই যে কবির ভেতর টা দেখেন।
‹› আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি আসীম বেদনা ! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি—তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি । ‹›
কবি তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা কে প্রজ্জ্বলিত ব্যাথার আগুনের সাথে তুলনা করেছেন। দীর্ঘ পনের বছর কবি সে আগুনে নিজে পুড়ছেন। নার্গিস কে পোড়াতে চাননি। আগুন তার হৃদয় পুড়িয়ে তাকে নিখাদ সোনা বানিয়েছে। সাফল্য এনে দিয়েছে। নজরুল নির্দ্বিধায় সে সত্যকে স্বীকার করে লিখেছেন, ‹›তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার আঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি । ‹›
পরের অংশে কবি যেন কবিদের জাত চিনিয়ে দিলেন,
‹› তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি—আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই । ‹›
মানুষ স্বার্থপর, লোভী। ক্ষনে ক্ষনে বদলায়। হয়তো অবুঝ কিশোরীর কাছেই কেবল পাওয়া যায় লোভহীন, নিঃস্বার্থপরতার উপমা। কবি সেই সুন্দর কে শ্রদ্ধা আর অসুন্দর কে ঘৃণা জানিয়ে লিখেছেন, ‹› তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা। আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম,অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা। পাষান দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ ৃজীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা,ব্যর্থ ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব,অধিকতর বেদনা পাব,--তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি। ‹›
শ্বাশত, চিরায়ত সুন্দর প্রেমের গুনগান করেছেন এভাবে,
‹› দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান,দগদ্ধ,হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি। ‹›
দীর্ঘ পনের বছর আগের স্মৃতিচারণ বর্ণনাতে কবি লেখেন,
‹› হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনর বছর আগের কথা । তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিলো জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেননা। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারা দিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না। ‹›
এতো ভালোবাসার পরেও কবি তার আপন পথের, গন্তব্যের দিকে ছুটবেন সবকিছু মাড়িয়ে। অনুরোধ, প্রার্থনা ও কৈফিয়ৎ দিলেন,
্র যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করোনা। তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখি হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই –এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ । ‹›
চিঠি নিয়ে যদি গবেষণা হয় তো কবি নজরুলের এই চিঠি কে আমি জীবন্ত, প্রেমময়ী, অদ্ভুত এক চিঠি ই বলবো। এমন চিঠি নজরুল ছাড়া আর কে লিখবে? কবি। হয়তো আর চিঠি লেখার দিন ফিরবে না তবে কালে কালে এমন অনেক চিঠি মানুষের বুকে দাগ কেটে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন