বায়ান্ন-একাত্তরসহ বিভিন্ন আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখা দেশের বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আজ ছাত্রসমাজের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। গেল কয়েক বছর ধরে হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপকর্মের শিরোনাম হতে হয়েছে ছাত্রলীগকে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, মাদক, মারামারি, ভর্তি-বাণিজ্য, শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক-পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন সময় নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও গ্রুপিং, দলীয় কোন্দল, সংঘর্ষ যেন নিত্যনৈমিত্তক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের ক্ষমতাসীন দলের এ ছাত্র সংগঠনটির।
গত দুই দিন আগে রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের পর চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে ১২ থেকে ১৫ ফুট গভীর পুকুরের পানিতে ফেলে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। গতকালও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে শিক্ষক, সাংবাদিক, ছাত্রীসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন।
গেল কয়েক বছরে নানা অপকর্মে আলোচনায় এলেও ন্যায্য দাবি আদায়ে ছাত্রসমাজের পাশে দেখা যায়নি এই ছাত্র সংগঠনটিকে। বরং কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে ছাত্রসমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা গেছে ছাত্রলীগকে। পরিসংখ্যান বলছে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ অর্ধশতাধিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে ২০০৯ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ ওরফে রাজীবকে হত্যা করে লাশ বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেয়া হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নিজ সংগঠনের কর্মীরাই মারধর করে বহুতল ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেন। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক। একই বছর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ।
২০১২ সালে ছাত্রলীগ নেতাদের চাপাতির কোপে প্রাণ হারান পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাস। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর গ্রামের তরুণ বিশ্বজিৎ পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে একটি দর্জি দোকানে কাজ করতেন। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের সময় অবরোধবিরোধী ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে দিন-দুপুরে কুপিয়ে ও পিটিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার খবর ও ছবি সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। ২০১৬ সিলেটের এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে এসে সরকারি মহিলা কলেজে খাদিজা নামে এক ছাত্রীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করেছে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের ন্যয্য দাবি কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের নৃশংস হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক কর্মীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া হয়। হেলমেট পরে গুলি চালিয়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনরত খুদে শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলার ঘটনাতেও জড়িত ছাত্রলীগ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ও ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূরের ওপর অসংখ্যবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। নূরের দাবি তার ওপর আটবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এমনকি ভিপি হওয়ার পরও তার ওপর হামলা করা হয়েছে।
সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্যের সূত্র ধরে শিবির সন্দেহে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। ঘটনায় বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলসহ ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
এ ঘটনার পর উঠে এসেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে টর্চারশেল তৈরি করে ছাত্র শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনার চিত্র। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেকোনো সময় যেকোনো হল থেকে সাধারণ ছাত্রদের জোরপূর্বক হল থেকে বিতাড়িত করার অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হলে হলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের এহেন কর্মকান্ডে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে অবশেষে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
গত শনিবার রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের পর চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে ১২ থেকে ১৫ ফুট গভীর পুকুরের পানিতে ফেলে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ না দেয়ায় সপ্তম পর্বের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা কামাল হোসেন সৌরভ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এ ঘটনা ঘটায়। অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, ক্লাসে উপস্থিতি কম থাকায় দুইজন ছাত্রের ফরম পূরণ হয়নি। সেই দুই ছাত্রের ফরম পূরণ করানোর জন্য সকালে কয়েকজন আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু আমি তাদের বিভাগীয় প্রধানের কাছে যেতে বলি। এ সময় তারা আমাকে নিয়ে আমার সামনেই অশালীন মন্তব্য করে। দুপুরে নামাজ পড়ে অফিসে যাওয়ার সময় তারা আমার পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলে, স্যার কথা আছে। একটু পুকুরের দিকে আসেন। আমি যেতে না চাইলে তারা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়।
গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এই হামলায় শিক্ষক, সাংবাদিকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ভিসির বাসভবনের সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করে অবস্থানরতদের তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। এসময় কয়েকজন শিক্ষক মারধরের শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এত কিছু ঘটনার পরও শুধু দায় এড়িয়েই চলছে ক্ষমতাসীন দলের এই ছাত্র সংগঠনটি। কোনো ঘটনা ঘটলে শুধু বহিষ্কার করেই তাদের কাজ শেষ। আবরার হত্যাকান্ডের ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ছাত্রলীগ অনেক বড় সংগঠন। কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় পুরো ছাত্র সংগঠন নিতে পারে না। তিনি আরো বলেন, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়ার পরও কুচক্রী মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দেশবিরোধী চুক্তির ধুয়া তুলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা তারা করছে।
ছাত্রলীগের এসব কর্মকান্ডে প্রায় সময় ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গেল বছর মে মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলনে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে নতুন কমিটি গঠন করে দেশের বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাঁদা কেলেঙ্কারির অভিযোগে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সভাপতি ও সেক্রেটারিকে অপসারণ করে নতুন করে নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
সম্প্রতি ছাত্রলীগের একের পর এক অপকর্মের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের রাইয়ান নামের এক শিক্ষার্থী ইনকিলাবকে বলেন, আমার পরিবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। এক সময় ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ¦ল ভূমিকা ছিল। কিন্তু এখন এ কেমন ছাত্রলীগ! এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা ছাত্রলীগ করছে না। নাদিয়া নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, যে সংগঠন সরাসরি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে জড়িত, সেটা কোনো ছাত্র সংগঠন হতে পারে না।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই ছাত্র সংগঠনগুলো অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আদর্শ ও নৈতিকতা থেকে সরে আসার কারণে ছাত্রলীগের আজ এই অধঃপতন। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আ.লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে পারে ছাত্রলীগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী ইনকিলাবকে বলেন, ছাত্রলীগ সংগঠনগুলো তাদের নৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হওয়ার কারণে আজকে এ অবস্থা হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা ছিল সেটাকে তারা ভুলে যাচ্ছে। দলের শৃঙ্খলাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের পদ-পদবী ধরে রাখা ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ মহূর্তে লাগাম টেনে না ধরলে আরো ভয়াবহ হতে পারে ছাত্রলীগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নূর বলেন, এক সময় ছাত্রলীগের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রলীগের অবদান অপরিসীম। কিন্তু এখনকার ছাত্রলীগ সেই ছাত্রলীগ না। এখন এমন কোনো অপরাধ নেই যেটা ছাত্রলীগ করছে না। তারা আমার ওপরও আটবার হামলা চালিয়েছে। যার একটিরও সঠিক বিচার হয়নি। এভাবে বিচারহীনতার কারণে ছাত্রলীগের আজ এই অবস্থা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন