শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

পলাশী ট্র্যাজেডি এবং আজকের বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাহমুদ ইউসুফ
ক্রুসেডের পতাকাবাহী লর্ড ক্লাইভ গংরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের পরাজিত করে পলাশীর প্রান্তরে। জাতীয় কবির ভাষায় : ‘কা-ারি, তব সম্মুখে ওই পলাশীর প্রান্তর/বাঙালির খুনে লাল হলো যেথা ক্লাইভের খঞ্জর/ওই গংগায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর/উদিবে সে রবি আমাদের খুনে রাংগিয়া পুনর্বার’। সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের সাথে সেদিন মিতালি গড়ে ওঠে জগৎশেঠ মাড়োয়ারিদের। বাংলার বর্ণহিন্দু নেতৃত্ব আর্থিক, কূটনীতি এবং কলাকৌশলগত পূর্ণ সমর্থন দেয় উদীয়মান ইংরেজি জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে। প্রতিমা পূজার ধারক বাহক মুশরিক পৌত্তলিক আর বাইবেলের খ্রিস্টান কুশীলবরা মিলে ভারতবর্ষ থেকে মুসলিম শাসন ও মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে একই প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হয় সেদিন। ধর্মনিরপেক্ষবাদী হিন্দুদের ৫০০ বছরের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পলাশী বিপর্যয়ে দেশপ্রেমিকদের পরাজয় সম্পর্কে কৃষ্ণচন্দ্রের জীবন কাহিনী রচয়িতা রাজীব লোচন বলেছেন, হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজদৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন (কে কে দত্ত : আলীবর্দী অ্যান্ড হিজ টাইম, পৃ. ১১৮; উদ্ধৃতি : আর কোনো পলাশি নয়, পলাশি ট্র্যাজেডির ২৪০তম বার্ষিকী স্মারক ১৯৯৭, পৃ. ৭৬)।
ভারতীয় ঐতিহাসিক তপন মোহন চট্টপাধ্যায় লিখেছেন, ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদেরই ষড়যন্ত্র। পশ্চিমবঙ্গ তখন বারভূম ছাড়া আর সব বড় বড় জায়গাতেই হিন্দু জমিদার। প্রকাশ্য না হলেও ভেতরে ভেতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। প্রধানত হিন্দুদের চক্রান্ত হলেও বড়গোছের মুসলমান তো অন্তত একজন চাই। নইলে সিরাজদৌলার জায়গায় বাংলার নবাব হবেন কে? ক্লাইভ মনে মনে মিরজাফরকেই বাংলার ভাবি নবাব পদের জন্য মনোনীত করে রেখেছিলেন (তপন মোহন চট্টপাধ্যায় : পলাশির যুদ্ধ, কলকাতা, প্রথম মুদ্রণ ১৯৫৩, পৃ. ১৫৮-১৫৯; আর কোনো পলাশি নয়, পলাশি ট্র্যাজেডির ২৪০তম বার্ষিকী স্মারক ১৯৯৭, উদ্ধৃতি : পৃ. ৪৭)। ‘‘মুসলিম নির্মূলে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিম শাসনের অবসান কামনা করছিল। অনেকের বক্তব্যÑ হিন্দু, জৈন সওদাগর ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং মহাজন শ্রেণি কর্তৃক সংঘটিত হয় পলাশী বিপ্লব। (সুশীল চৌধুরী : পলাশির অজানা ইতিহাস, আনন্দ, কলকাতা, ৫ম মুদ্রণ, নভেম্বর ২০১৩, পৃ. ৬০)
পলাশী ট্র্যাজেডি বাঙালি তথা পাক-ভারতের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বেদনাপূর্ণ ঘটনা। কোম্পানির ফিরিঙ্গিদের বিরুদ্ধে এবং বিদেশি শাসন প্রতিষ্ঠার যে প্রবল প্রতিবাদ করেছিলেন তার ফলস্বরূপ চক্রান্তের শিকার হয়ে সিরাজ-উদ-দৌলাকে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হয়। সেদিন নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছিল মুর্শিদাবাদের জনম-লি। নবাবের পতনের অর্থ হলো বাঙালি মুসলমানদের আত্ম অধিকার নিঃশেষিত হওয়া। জাতীয় অধ্যাপক মরহুম সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পেছনে প্রধান কারণ ছিল কুসিদজীবী মহাজন শ্রেণির হিন্দুদের ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ইংরেজদের কূটকৌশল। সিরাজদৌলার পরাজয় বাঙালি মুসলমানদের জন্য আশাভঙ্গের কারণ হয়েছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বছর হচ্ছে ১৭৯৩ সাল। ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হিস্টিংস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেন। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির খাজনা এবং রাজস্ব আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। এই বিশেষ পদ্ধতির ফলে মুসলমানদের ভূস্বামীগত অধিকার কৌশলে বিলুপ্ত করা হয় এবং মুসলমান জমিদারদের হিন্দু আমলা ও গোমস্তরা এসব জমিদারি আত্মসাৎ করেন এবং প্রতিপত্তি জমিদারে পরিণত হয়। অর্থাৎ সর্বোতভাবে মুসলমানদের স্বত্বহীন অসহায় মানবগোষ্ঠীতে পরিণত হয় (এমআর আখতার মুকুল : কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, সৈয়দ আলী আহসানের ভূমিকা, সাগর পাবলিশার্স, ঢাকা, প্রকাশ ১৯৮৭, পৃ. ১৩)।
পলাশীতে সিরাজের পরাজয় এবং তাঁর শাহাদাতবরণের মধ্যে পলাশী ট্র্যাজেডি সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো কথা ছিল না। পরবর্তী ১৯০ বছরের ঘটনা প্রবাহে আমরা দেখতে পাই পলাশীর আ¤্রকাননে মঞ্চায়িত নাটকের উদ্দেশ্য ছিল তাওহিদ রিসালাতের উত্তরাধিকারী জাতিকে ম্যাসাকার করা। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ ও হিন্দু সখ্যতা তাই প্রমাণ করে। সমৃদ্ধশালী ও সুসভ্য মুসলিম জাতি নিষ্পেষিত হয় দুই দলের পদতলে পিষ্ট হয়ে। প্রথমেই অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া হয় বাঙালি মুসলমানদের। ইংরেজ সিভিলিয়ান ও লেখক উইলিয়াম হান্টার আমাদের পূর্বপুরুষদের করুণ অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন, একশ’ সত্তর বছর আগে বাংলার কোনো সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানের দরিদ্র হয়ে পড়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু বর্তমানে তার পক্ষে ধনী হওয়াটাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে (ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার : দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, অনুবাদ : এম আনিসুজ্জামান, খোশরোজ কিতাব মহল, বাংলাবাজার ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ ২০০০, পৃ. ১৩৭)।
মুসলিমরা তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে। অন্যদিকে কোম্পানি ও নেটিভ সম্প্রদায় এক হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুসলিমদের মুক্তিযুদ্ধ স্তব্ধ করে দেয়। ইংরেজ খ্রিস্টশক্তি তখন সরকারে আর বর্ণহিন্দুরা তাদের সহায়ক শক্তি। দুই শক্তি মুসলিমদের সম্পদ দখলে ও লুটপাটের নগ্ন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজরোষের সকল অর্থ এবং দখলিকৃত সম্পদ জাহাজ বোঝাই করে ইংল্যান্ডে পাঠায়। ঐতিহাসিকদের মতে ডান্ডি, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম প্রভৃতি বাণিজ্য প্রধান শহরগুলোর দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে এদেশের অর্থে। মোটকথা ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটে বাংলাদেশের টাকা এবং কাঁচামালের সাহায্যে।
ইতিহাসে নজিরবিহীন শোষণ ও লুণ্ঠনে লিপ্ত হয় কোম্পানির কর্মচারীরা। লর্ড ক্লাইভ ‘যুদ্ধ জয়ের’ বখশিস হিসেবে মিরজাফরের কাছ থেকে ২ লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে রাতারাতি ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ ধনিতে পরিণত হয়। মিরজাফর কোম্পানির ছয় কর্মচারীকে দেড় লাখ পাউন্ড এবং কলকাতা কাউন্সিলের প্রত্যেক সদস্যকে ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করে। কোম্পানির ও কলকাতার অধিনায়কদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এবং সৈন্য ও নৌবহরের খরচ বাবদ কোম্পানি আদায় করে ২৫ লাখ ৩১ হাজার পাউন্ড। মিরজাফর ইংরেজ প্রধানদের খুশি করতে দেয় ৬ লাখ ৬০ হাজার ৩৭৫ পাউন্ড। বিভিন্ন ইংরেজ কর্মচারী পুতুল নবাবের কাছ থেকে চব্বিশ পরগনা জেলার জমি ছাড়াও ৩০ লাখ পাউন্ড ইনাম গ্রহণ করে। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভকে ৩৪ হাজার ৫৬৭ পাউন্ড বার্ষিক আয়ের দক্ষিণ কলকাতার জায়গির প্রদান করা হয়। মির কাসিম মসনদের বিনিময়ে ২ লাখ পাউন্ড দিয়েছিলেন। মিরজাফরের পুত্র নাজমুদ্দৌলাহ পিতার মৃত্যুর পরে মসনদ লাভের জন্য কোম্পানির কর্মচারীদের ঘুষ দেয় ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। রেজা খান ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা উৎকোচের বিনিময়ে নবাব নাজিম নিযুক্ত হয়। উৎকোচ নামক দুর্নীতি ব্যাপকভাবে আমদানি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০ বছরে ৬০ লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করে ইংরেজরা। একথা সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায় (পি. রবার্টস : হিস্টরি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ. ৩৮, ব্রিজেন কে গুপ্ত : সিরাজদৌলাহ অ্যান্ড দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পৃ. ৪১, ড. এম-এর রহিম : বাংলার ইতিহাস, পৃ. ১৯, ব্রিটিশ চতুর্থ পার্লামেন্টারি রিপোর্ট ১৭৭৩, পৃ. ৫৩৫, সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃ. ৯; উদ্বৃতি: আর কোনো পলাশি নয়, পলাশি ট্র্যাজেডির ২৪০তম বার্ষিকী স্মারক ১৯৯৭, পৃ. ৯৯-২০০)। অধ্যাপক চার্লস স্টুয়ার্ট লিখেছেন, ১৮১১ সালের অক্টোবর মাসে বাঙলা থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়া হয় এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কাছে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৭ স্টালিং পাউন্ডে বিক্রি করা হয় (চার্লস স্টুয়ার্ট : বাঙলার ইতিহাস, আবু জাফর অনূদিত, হাক্কানী পাবলিশাস, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫,পৃ. ১৮)। আধুনিক সা¤্রাজ্যবাদী ইন্ডিয়াও এভাবে বাংলাদেশের অর্জিত মুদ্রার সিংহভাগ নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্নভাবে।
পলাশী ট্র্যাজেডির পরে মিরজাফর নবাব হলেও ক্ষমতার চাবিকাঠি চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তাই ক্লাইভের হুকুমের তাঁবেদারি করে মিরজাফর সরকার। শুরু হয় প্রশাসন, রাজস্ব, সেনাবাহিনী থেকে মুসলিম বিতারণের ছাঁটাই প্রক্রিয়া। একই সাথে নতুন নিয়োগে মুসলিমদের বাদ দিয়ে শুধুই নেটিভদের নিয়োগ দেয়া হয়। এ সম্পর্কে ব্রিটিশ সিভিলিয়ান ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার ১৮৭২ সালে সরকারের কাছে প্রদত্ত রিপোর্টে বলেন, একশ’ বছর পূর্বে রাষ্ট্রীয় চাকরির সকল পদ মুসলমানদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। এদেশের শাসন কর্তৃত্ব যখন আমাদের হাতে আসে তখন মুসলমানরাই ছিল উচ্চতর জাতি; এবং শুধু মনোবলে ও বাহুবলের বেলাতেই উচ্চতর নয়। এমনকি রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনায় দক্ষতা এবং সরকার পরিচালনায় বাস্তব জ্ঞানের দিক থেকেও তারা ছিল উন্নততর জাতি। এ সত্ত্বেও মুসলমানদের জন্য এখন সরকারি চাকরি এবং বেসরকারি কর্মক্ষেত্র এই উভয় ক্ষেত্রেই প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে (ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার: দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, অনুবাদ : এম আনিসুজ্জামান, খোশরোজ কিতাব মহল, বাংলাবাজার ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ ২০০০, পৃ. ১৪৯)।
উপমহাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক এবং আওয়ামী লীগের প্রথম মহাসচিব আবুল মনসুর আহমদ ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বাংলার জমিদার হিন্দু প্রজা মুসলমান; বাংলার মহাজন হিন্দু খাতক মুসলমান; উকিল হিন্দু মক্কেল মুসলমান; ডাক্তার হিন্দু রোগী মুসলমান; হাকিম হিন্দু আসামি মুসলমান; খেলোয়াড় হিন্দু দর্শক মুসলমান; জেইলার হিন্দু কয়েদি মুসলমান ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলার হিন্দুদের ঘরে যত টাকা আছে সব টাকা মুসলমানের। মুসলমান চাষি মজুরের মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া রোজগার করা টাকায় হিন্দুরা সিন্দুক ভরিয়াছে, দালান-ইমারত গড়িয়াছে; গাড়ি-ঘোড়া দৌড়াইতেছে (আবুল মনসুর আহমদ : আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ আগস্ট ১৯৭৫, পৃ. ১৬৪)।
বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভিন্নতর নয়। সেকুলার কবি সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে কোরআন প্রেমিকদের বিরুদ্ধে। তাদের কাজ শুধু দিল্লি-কলকাতার গুণগান আর ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধাচরণ। প্রশাসন, পুলিশ, সিভিল তথা সকল গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর কুক্ষিগত করেছে নেটিভরা। শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি হিন্দুকরণ সম্পন্ন। স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে মুসলিম কৃষ্টি, তাহযিব তামাদ্দুনের বিলোপ ঘটানো হয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কোরআন হাদিস তাড়িয়ে বাবু কালচার, রাধা কৃষ্ণ সংস্কৃতি সংযুক্ত হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের চাকরি প্রদান সঙ্কুচিত করা হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দূরবীণ দিয়ে খোঁজা হয় কোনো মুমিন বা ইমানদার নাগরিক চাকরিতে প্রবেশ করল কিনা। বড় বড় চাকরির ক্ষেত্রে পূর্বেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন মারফত জানা হয়, কোনো মুমিন মুসলিম নিয়োগের তালিকায় আছে কিনা। মিডিয়া তো পুরোপুরি ইসলামের বিরুদ্ধে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়া মুসলিম জাতিকে মানবতাবাদ, উদারতা, শান্তি ও সভ্যতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তারা প্রতিবেশী দেশের স্বার্থে সংবাদ পরিবেশন করেন। দেশি টিভি পত্রিকা বন্ধ থাকবে, আর বিদেশি টিভির অবাধ প্রবাহ; ইসলামি টিভি চলতে পারবে না কিন্তু হিন্দি টিভি চলতে কোনো বাধা নেই। এই হলো বাংলাদেশে মিডিয়ার স্বাধীনতা। লর্ড ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কোম্পানি পলাশী যুদ্ধের পর যখন মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে তখন জনগণ দাঁড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যদি তারা লাঠিসোঁটা নিয়েও আক্রমণ করত তাহলেও ইংরেজদের কোনো অস্তিত্ব থাকত না, তারা নিঃশেষ হয়ে যেত।’ পরবর্তী দুশ বছর জনগণকে এই ভুলের কাফফারা দিতে হয়েছে। দেশের বর্তমান জনগোষ্ঠীর নীরবতাও ভবিষ্যতে হয়তো তাদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিবে। সিরিয়া, ইরাক, কাশ্মির, আফগানিস্তান যেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
বাংলাদেশের মুসলিমদের মতো দুর্ভাগ্য দুনিয়ার আর কোনো মুসলিম রাষ্ট্র নেই। চারপাশেই বৈরী শক্তি। অক্টোপাসের মতো ঘিরে রেখেছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও বাঙালি মুসলিমদের। সীমান্ত হত্যা, গুপ্তহত্যা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অশ্লীলতা, ধর্ষণসহ সকল পাপাচার উপহার দিয়েছে তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্র ইন্ডিয়া। পলাশী ট্র্যাজেডির পর যারা মসনদে আরোহণ করেন, বর্তমানে তাদের উত্তরসূরিদেরই দেখা যাচ্ছে জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে। তাওহীদী আদর্শের অনুসারীরা সর্বত্র হেনস্থার শিকার।
এই দুর্বিষহ, হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চাই ইমানদারদের ইস্পাত দৃঢ়ঐক্য। এই একতা গড়ে তুলতে পারে আল কোরআন। কোরআন হাদিসের জ্ঞানে প্রজ্ঞাবান হওয়া এবং সে আলোকে জীবনকে সাজালে অবশ্যই ইহুদি ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি পরাস্ত হতে বাধ্য। কবি আল্লামা ইকবাল যথার্থই বলেছেন, যতদিন মুসলিম মিল্লাতের হৃদয়ে কোরআন ছিল, যতদিন তারা কোরআন গবেষণায় নিয়োজিত ছিল ততদিন বিশে^র সকল অমুসলিম শক্তি পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ত, আর যখনই কোরআন ছেড়ে দিয়েছে তখনই ক্ষমতাও তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। আজও যদি মুসলিমরা কোরআন নিয়ে বসে, কোরআনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল কর্মকা-ের উৎস যদি কোরআনকেন্দ্রিক হয় তাহলে দুনিয়ার সকল শক্তি তাদের কাছে আত্মসমপর্ণ করবে।
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন