বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

ডিজিটাল বাংলাদেশে টিকিটের জন্য যুদ্ধ কেন

প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মীর আব্দুল আলীম

ঈদে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি চলছে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ২০ জুন থেকে আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। শুরু না হতেই কাক্সিক্ষত টিকিট উধাও; ভাড়াও বেশি এমন সংবাদই ২১ জুনের পত্রিকায় ছেপেছে। প্রতি বছরই ঈদে বাস বা রেলের টিকিট নিয়ে হাহাকার আর এক রকম যুদ্ধাবস্থা যেন শেষ হয় না। ঈদে বাড়ি ফেরার টিকিট নিয়ে ভোগান্তি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও সেই একই চিত্র, একই সমস্যা। তবে এবার ঈদের বেশ আগেই সরকারি ছুটি শুরু হওয়ায় টিকিট ক্রয়ে সহজ হবে বলে আশা করেছিলেন টিকিট প্রত্যাশীরা। কিন্তু দৃশ্য ভিন্ন। সাহরি খেয়ে লাইনে দাঁড়িয়েও কাক্সিক্ষত ৩০ জুন ও ৪ জুলাইয়ের টিকিট পাচ্ছেন না তারা। রাজধানী থেকে ঘরমুখো মানষের মধ্যে টিকিট নিয়ে চলছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। টিকিট যেন হয়ে উঠেছে আকাশের চাঁদ; যার নাগাল পাওয়া ভার। এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের মাঝে চলছে হা-পিত্যেশ। কেউ কেউ অফিস ছুটি নিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাচ্ছেন না। শত কষ্টের পর হতাশ মনে বিনা টিকিটে বাড়ি ফিরছেন অনেকেই। টিকিটের কৃত্রিম সংকট ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ ছিল টিকিট বিক্রির প্রথম দিনেই। ছিল না অনিয়ম প্রতিরোধে বিআরটিএ-সহ কোনো সংস্থা বা সংগঠনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ। অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য ঈদের আগে টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মানুষকে উচ্চমূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য করে দুর্নীতিবাজরা। টিকিট বিড়ম্বনার মাঝে পরিবহন চাঁদাবাজিও বেশ দৃশ্যমান। সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক পুলিশও যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সার্বিক বিষয়গুলোর প্রতি সরকার নজর না দিলে ঘরমুখো মানুষের বিড়ম্বনার আর সীমা থাকবে না।
টিকিট নিয়ে ভোগান্তি এ যেন নিয়তি। তবে সরকার চাইলেই ঘরমুখো মানুষের টিকিট নিয়ে এ বিড়ম্বনা লাঘব করতে পারে। ডিজিটাল সরকার টিকিট বিক্রিতে কেন ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করতে পারছেন না? কেবলমাত্র ইমারজেন্সি টিকিট ছাড়া রেল কাউন্টারে টিকিট বিক্রি পদ্ধতি বন্ধ হওয়া দরকার। টিকিট মিলবে বিকাশের মতো পাড়া-মহল্লার দোকানে দোকানে। যেখানে মানুষ এখন টাকা লেনদেন করছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। যেখানে দেশের একপ্রান্ত থেকে গ্রামেগঞ্জে টাকা পৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে সেখানে ২/৩শ’ টাকার রেলের কিংবা বাসের টিকিটের জন্য ভোর থেকে রাত পর্যন্ত লাইনে দাঁড়াতে হবে কেন? লাইনে দাঁড়িয়েওতো টিকিট মিলে না। এ ভোগান্তি সরকারের চরম ব্যর্থতা। তা অবশ্যই সরকারকে দূর করতে হবে। এর আগে কোনো কোনো দেশের ভিসা পেতেও এমন দীর্ঘ লাইন আর বিড়ম্বনার কথা শুনেছি। সেসব দেশের ভিসার জন্য এখন আর ভোর থেকে লাইনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। অনলাইনেই ভিসার আবেদন করা যায়। পরে তারিখ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় ভিসার জন্য গেলেই সহজে ভিসা মেলে। পাশের দেশ ভারতের বিমান কিংবা রেলের টিকিটও মিলছে অনলাইনে। পাড়ায় মহল্লায়ই তা পাওয়া যায়। দেশজুড়ে বিকাশের মাধ্যমে মুহূর্তে লাখ লাখ টাকা ছড়িয়ে দেয়া গেলে সামান্য টিকিট কেন সরকার জনগণের হাতে পৌঁছাতে পারবে না। জনগণের এমন দুর্ভোগ লাঘবে সরকারকে এ জাতীয় পদ্ধতি অবশ্য চালু করতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি ব্যাংক বিশেষ করে বিকাশে সফল ব্র্যাক ব্যাংক কিংবা ডাচ্বাংলা মোবাইল ব্যাংকিংকে এ দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।    আমাদের দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো অলিতে গলিতে অনলাইনে টিকিট বিক্রির পদ্ধতি অনায়াসেই চালু করা যায় এবং তা এখন সময়ের দাবিও। এ দাবি পূরণ না হলে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিশ্চিত ভেস্তে যাবে বৈকি।
ঈদের সময়টাতে প্রিয়জনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চাইবেন অনেকেই। কিন্তু এ আনন্দে বাদ সাধে টিকিট ও যাত্রাপথের বিড়ম্বনা। আগেই টিকিট চলে যায় কালোবাজারিদের হাতে। পরিবহন কোম্পানিগুলোর এক শ্রেণীর অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে কালোবাজারিরা ঈদের টিকিট কিনে নেয়। একটি টিকিটের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় মানুষকে। ঈদের সময় এলেই দেখা যায় রেল এবং পরিবহন কোম্পানিগুলোর ঈদের টিকিট আগে থেকেই ফুরিয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এবারও ঈদের টিকিট আগেই ফুরিয়ে গেছে। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে যাঁরা প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান, তাঁরা টিকিটের জন্য ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু ঈদের টিকিট এখন সোনার হরিণ। একটি ঘটনা পাঠককে না জানালেই নয়। একদিন আগাম টিকিট বিক্রির বিড়ম্বনা দেখব বলে বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতেই কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছি। আমার গ্রামের বাড়ি রাজধানীর কোল ঘেঁষা পূর্বাচল এলাকায়। যানজট থাকলে অনেকটা হেঁটেই পাড়ি দিতে পারি তাই আমার টিকিটের বিড়ম্বনা নেই। পত্রিকা আর টিভিতে টিকিট নিয়ে নানা খবরের পর আমার সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে। স্টেশনে এসেই আমার অফিসের এক কর্মকর্তাকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আগে সেখানে গেলাম। তিনি অনেকটা গলদঘর্ম; ইনকরা শার্ট-প্যান্ট থেকে অর্ধেকটা বেরিয়ে এসেছে। বোধ করি ধস্তÍাধস্তিতে বেচারার এমন দশা হয়েছে। তিনি আমাকে দেখেতো ভয়ে কাতর। কারণ দাস্ত (পাতলা পায়খানা) হয়েছে এমন অজুহাতে তিনি সেদিন অফিস কামাই করেছেন। কী আর করবেন বেচারা? ঈদে যখন বাড়ি যেতেই হবে তখন টিকিটতো চাই চাই। টিকিট যুদ্ধে সামিল হতেই তাকে অফিস ফাঁকি দিয়ে রেলস্টেশনে আসতে হয়েছে। তাঁর মতো অনেককেই এভাবে টিকিটের জন্য রেলস্টেশনে ছুটতে হয়। সেদিন আমি সরেজমিন গিয়ে জানতে পারি, কমলাপুর রেলস্টেশনে আগের রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকেই টিকিট পাননি। অন্যদিকে সেদিনই রাজধানীর গাবতলী, টেকনিক্যাল, শ্যামলী ও কল্যাণপুরের অধিকাংশ কাউন্টারেই উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গগামী বাসের ৭০ শতাংশ অগ্রিম টিকিট বিক্রি শেষ হয়েছে বলে জানতে পারি। গত ২০ জুন সকাল ৮টা থেকে ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষের জন্য অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। টিকিট বিক্রির দুদিন পরই তৃতীয় দিন সকালে কাউন্টারগুলোয় সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ টিকিট বিক্রি শেষ। অনেকে বিড়ম্বনা কমাতে আগেভাগেই টিকিট কিনে রাখতে চান। কিন্তু অগ্রিম টিকিট কিনতে গিয়ে তারা দেখছেন সব টিকিট শেষ হয়ে গেছে। অথচ কালোবাজারিদের কাছে দেড় গুণ থেকে দ্বিগুণ দামে টিকিট মিলছে ঠিকই। কাউন্টারে টিকিট না পাওয়ার প্রকৃত কারণ এটাই। এদিকে পবিত্র ঈদ সামনে রেখে বাস ও লঞ্চ মালিকরা একদিকে টিকিটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে কালোবাজারিদের কাছ থেকে তা আরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এই অনিয়ম চলে আসছে বছরের পর বছর। যাত্রী নিরাপত্তা, সেবা এবং সুগম যাতায়াত যদি নিশ্চিতই না থাকবে, তা হলে মানুষ নির্ভরতার আস্থা কোথায় খুঁজবে? এর কি কোন প্রতিকার নেই?
ঈদ সবাই প্রিয়জনের সঙ্গে কাটাতে চান। তাই ঈদ এলেই বাড়ি যাওয়ার ধুম পড়ে। মানুষ তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে ঈদের। ঈদে লম্ব^া ছুটি পাওয়া যাবে, সেই ছুটির মুহূর্তগুলো প্রিয় সান্নিধ্যে কাটবে। তাই ঈদ এলে ফিরতে চায় আপন আলয়ে, যেখানে সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকে প্রিয় মুখগুলো, যাদের ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে রাজধানীতে কঠিন সময় পার করতে হয়। ঈদে ঘরে ফিরতে তাই বাড়ি যাওয়ার অগ্রিম টিকিট শুরুতেই কিনতে চায় মানুষ। তাই ঈদে বাস, ট্রেন ও লঞ্চের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হলেই লাইন দিয়ে মানুষ টিকিট সংগ্রহ করতে নামে। কিন্তু সেই টিকিট ঘরমুখো মানুষের জন্য হয়ে ওঠে সোনার হরিণ। মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এ সময় বাস, লঞ্চে যেমন নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করা হয়, তেমনি ট্রেনের টিকিটও চলে যায় কালোবাজারে। টিকিট কাউন্টারে দেখা মেলে না টিকিটের। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া দিলে পেছন দরজা দিয়ে মিলে যায় টিকিট। এবারো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ঈদুল আজহা এবং শারদীয় দুর্গাপূজা পাশাপাশি সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় দুই সম্প্রদায়ের মানুষই প্রায় একসঙ্গে রাজধানী ছাড়ছে। ফলে এবার মানুষের মধ্যে আশঙ্কা আরো বেশি। ইতোমধ্যে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির খবর গণমাধ্যমে উঠে আসছে তা মোকাবিলার জন্য সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপের বিকল্প নেই। জনদুর্ভোগ লাঘব করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রির দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট না পেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। অভিযোগ উঠেছে, কালোবাজারি ও স্বজনপ্রীতির। নির্ধারিত কাউন্টারে টিকিট নেই অথচ কাউন্টারের আশপাশে প্রকাশ্যে কালোবাজারির কাছে চড়া দামে তা বিক্রি করছে বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ ছাপা হয়েছে। একদিকে যেমন বাড়ছে অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করতে যাওয়া যাত্রীদের দুর্ভোগ তেমনি একই সঙ্গে তাদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে কালোবাজার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হচ্ছে। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আমাদের প্রত্যাশা, শুধু লোক-দেখানো অগ্রিম টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা নয়, মানুষ যেন স্বাভাবিকভাবে অগ্রিম টিকিট হাতে পায়, তাদের ঘরমুখো যাত্রা যেন নির্বিঘœ হয়, সে জন্য সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। সেই সঙ্গে যানবাহনের টিকিট নির্ধারিত দামে কোনো রকম হয়রানির শিকার না হয়েই কাটতে পারবে সেই নিশ্চয়তাও সংশ্লিষ্টরা দেবেন। স্বভাবতই ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের চাহিদা পূরণে পরিবহন সংকট নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়ায়। এ সংকট কিছু মানুষের পকেট স্ফীত করার সুযোগ সৃষ্টি করে। মানুষের দুর্ভোগ কারও কারও কাছে কাম্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য লোকজন বাড়ি ফেরে। কিন্তু টিকিট অপ্রাপ্তি এবং যাত্রাপথের নানা বিড়ম্বনা যেন সেই আনন্দকে নষ্ট করে না দেয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে নজর দিতে হবে। যে কোনো মূল্যে ঘরে ফেরা মানুষের এহেন বিড়ম্বনার অবসান হওয়া উচিত। আর এ জন্য সর্বপ্রথম চাই ডিজিটাল পদ্ধতির টিকিট ব্যবস্থা। সরকার অচিরেই এ পদ্ধতির টিকিট বিক্রি পদ্ধতি চালু করবেন বলে আমরা আশা করি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
হবংিংঃড়ৎব১৩@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন