কাশ্মীর ভ্যালিতে ১৯৮৬ সালে একটি মাত্র এতিমখানা ছিল। এখন চলছে ৭ শতাধিক। কোনোটা ব্যক্তি উদ্যোগে, কোনোটা ট্রাস্ট, আবার কোনোটা রাজ্য চালিত। সেভ দ্যা চিলড্রেনের জরিপ অনুসারে ভ্যালিতে দুই লাখ ১৫ হাজার এতিম শিশু আছে, যাদের ৩৭ শতাংশ সংঘাতের কারণে মা-বাবা বা উভয়কে হারিয়েছে। ১৫ শতাংশের বেশি এতিম এতিমখানায় থাকে। বাকিরা কোনো সহায়তা ছাড়াই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে থাকে। এদের বলা হয় অরফানস অব কনফ্লিক্ট। আরেকটি জরিপ অনুসারে, এতিমাখানার ৪০ শতাংশের বেশি শিশু নানা মানসিক সমস্যায় ভোগে, যা সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেই।
লক্ষণীয়, সেখানে সংঘাত শুরু হয়েছে তিন দশকের বেশি হলো। অর্থাৎ, এখনকার যুবকদের জন্ম এর মধ্যেই। এর মধ্যেই বেড়ে ওঠা তাদের। তারা শান্তির সময় দেখেনি। তাদের কাছে মৃত্যু স্বাভাবিক। যে কোনো সময় এখানে-ওখানে তাদের ভাই-বন্ধুর মৃত্যু হয়। সুতরাং, এই যুব সমাজকে গঠনমূলক সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া কিভাবে সম্ভব? এ নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। ভারতীয় সেনাদের ‘সম্ভাবনা প্রকল্প’ আছে। কাশ্মীর থেকে যুবকদের নেওয়া হয় শিক্ষা সফরসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সেই সুযোগগুলোকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা হয় সন্দেহের চোখে। জনগণের কাছে ওইসব সদ্ভাবনা প্রকল্প এখনও ‘বন্দুকের নলে গোলাপ-এর মতো।
শোপিয়ান জেলার এক যুবক যেমনটা বলছিল, সে রসায়ন শাস্ত্রে মাস্টার্স। তার বাবা নিহত হয়েছেন ১৯৯৫ সালে। বড় ভাই নিহত হয়েছেন, ১৯৯৬ সালে। পরিবারের সে সবার ছোট। তারা চার ভাই বেঁচে আছে। তাদের সংসার চলে আপেল বাগানে। বলছিল, ‘পরিস্থিতি আমাদের সবসময় টানে অস্ত্র তুলে নিতে।’
৮ ও ৯ আগস্ট, ২০১৫ কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় শিক্ষার্থীদের। আলোচনার বিষয় ছিল লিডারশিপ ও উদ্যোক্তা তৈরি। আলোচক প্রশ্ন করেছিলেন, লিডার শব্দটি শুনলেই আপনাদের সামনে কোনো ছবি ভেসে ওঠে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিল, গিলানী সাহাব। ওই অনুষ্ঠানে সরকারি প্রতিষ্ঠান জেঅ্যান্ডকে এন্টারপ্রেনরশিপ ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তা এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সবাইকে সরকারি চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। স্বাবলম্বী হওয়ার গুরুত্ব বর্ণনা করেছিলেন তিনি। এজন্য দ্বাদশ শ্রেণি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষিথ বেকার যুবকের সহজ শর্তে এত এত টাকা ঋণ দিচ্ছে সরকার-এ খবর দিলেন তিনি। যারা আগ্রহী তারা তাদের নিজস্ব উদ্যোগের পরিকল্পনা নিয়ে আসলেই ঋণ দেওয়া হবে।
এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা! আমি টাকা ঋণ নেবো। কাল আমি গুলি খেয়ে মরে গেলে আমার ঋণ কে পরিশোধ করবে? আমার নিরাপত্তা কী আপনার প্রতিষ্ঠান দেবে?’ এই প্রশ্নের কোনো জবাব সরকারের কাছে নেই। রাজ্য সরকার সেখানে বড় অসহায়। এই অসহায়ত্বের মধ্যেই বেড়ে উঠছে সেখানকার যুবসমাজ।
এত মন্দের মধ্যেও বেশ কিছু অবহেলিত ভাল খবরের সন্ধান মেলে আশাজাগানিয়া। যেমন, জায়েদের নামে এক যুবকের কাÐ। সে নিজের ঘরে বসে বিভিন্ন এনিমেটেড ভিডিও তৈরি করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। তার ভাষায় এর উদ্দেশ্য হলো, ‘২৫ বছরের সংঘাত আমাদের দু:খী ও গোমড়ামুখো বানিয়েছে। আমি মানুষকে একটু হাসাতে চাই’। মানুষকে হাসানোর এই শখ থেকেই সে তৈরি করে ছোট ছোট কার্টুন ভিডিও। এটি সে করে কেবলই শখে। কোনো বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ছাড়াই। ২০১৪ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নেতারা তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল ভিডিও বানিয়ে দিতে। তাতে রাজি হয়নি জায়েদ। এভাবে সাইথ কাশ্মীরে উবাইদ হায়দার নামে সপ্তম শ্রেণিতে পড়–য়া এক কিশোরের সন্ধান দিয়েছিল খবরের কাগজ। ওই কিশোর কাশ্মীরের প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত গোটা ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছে একটি বইয়ে যেটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। মোদ্দাকথা, কাশ্মীরে এখনও আপেল গাছে সাদা ফুল ফোটে বসন্তে। শীতের আগে, হেমন্তে, লাল আপেলের ভারে নুয়ে পড়ে সবুজ গাছ। বাক্স ভরে বিক্রি হয়। মানুষের হাতে আসে টাকা। গাছের পাতারা ঝরে পড়ে শীতে। তুষারপাত হয়। ন্যাড়া গাছেরা ফের সবুজ হয়ে জেগে ওঠার নিশ্চয়তা পায় প্রকৃতির কাছ থেকে। কিন্তুু, মানুষের জীবন চলে অনিশ্চয়তায়। এ অবস্থায়ও আশার কথা শুনিয়েছিলেন কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্তে¡র এক গবেষক। তিনি জানান, ‘উত্তর কাশ্মীরে (সোপুর) আমাদের গ্রামে প্রায় প্রত্যেক ঘরে কেউ না কেউ নিহত হয়েছে। আমার স্কুলজীবনের বন্ধুদের মধ্যে কেউ বেঁচে নেই। কারও মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছি। কেউ হয়েছে নিখোঁজ। একমাত্র আমি বেঁচে আছি। আমি ডক্টরেট করেছি। এখনও আমি আশা করি কাশ্মীর একদিন ফিরবে স্বাভাবিক অবস্থায়। হয়তো, শিগগিরই অথবা শতাব্দী সময় পর।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন