দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন পুলিশের মূলনীতি হলেও পুলিশ বাহিনীর আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি অনেকটা সর্ষের ভেতর ভূত থাকার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপর থেকে সংশোধন না হলে শুধুমাত্র মাঠের পুলিশ কর্মকর্তাদের লঘুদন্ড দিয়ে পুলিশের দুর্নীতি ও অপরাধ প্রবণতা দূর করা সম্ভব নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যকার নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই কেবল অবস্থার বাস্তবসম্মত পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে। ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশ অ্যাক্ট এবং স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে পুলিশ বাহিনীর গুণগত পরিবর্তন ও জনবান্ধব বাহিনীতে পরিণত হওয়ার বাস্তবতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রতিকূল হলেও আমাদের দেশেও পুলিশ বাহিনীতে পরিবর্তনের হাওয়া ক্রমে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ট্রিপল নাইন নম্বরে বহুমুখী জরুরি সেবা কার্যক্রমসহ পুলিশ বাহিনীর কর্মকান্ডে গতিশীলতা নিশ্চিত করার বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও পুলিশের এক শ্রেণীর সদস্যের দুর্নীতি ও অপরাধ প্রবণতা বাহিনীর সামগ্রিক সাফল্য, অগ্রযাত্রা ও গতিশীলতাকে ¤øান করে দিচ্ছে। পক্ষান্তরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা ধরনের অভিযোগে বছরে হাজার হাজার পুলিশ সদস্য বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীন হলেও অপরাধ-দুর্নীতি কমছে না।

এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মুক্তিপণ আদায়, গ্রেফতার বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ আছে। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে শতকোটি কিংবা হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্যও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ডিআইজি স্তরের কয়েকজন পুলিশ ও কারা কর্মকর্তার কাছ থেকে নগদ কোটি কোটি টাকা উদ্ধারসহ দুর্নীতির নানা তথ্য দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। সরকার এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের সদিচ্ছার কারণেই এসব দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যরা জবাবদিহির সম্মুখীন হতে বাধ্য হচ্ছে। গত আড়াই মাসে শুধুমাত্র ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের ১৬টি থানার ওসিসহ ৭০০ সদস্যকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে বলে গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়। গত সেপ্টেম্বরে বর্তমান ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে অথবা ঢাকার বাইরে বদলি করার প্রক্রিয়া গতি লাভ করে। গত বছর ফেব্রæয়ারিতে অনুষ্ঠিত ডিএমপির ত্রৈমাসিক ক্রাইম কনফারেন্সে তেজগাঁও রেঞ্জের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ওসি এসপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে তাদের পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে মোটা দাগের ঘুষ বা খরচের প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসেন। একজন ওসিকে পসন্দ মাফিক বদলির জন্য ৩০ লাখ থেকে দেড়কোটি টাকা এবং সাব ইনস্পেক্টরদের লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। বদলি ও পদায়নের এই টাকা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মধ্যেই বণ্টিত হয়। এ ধারা অব্যাহত রেখে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতি ও গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায় না।

এহেন বাস্তবতায় গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদেরকে ডিএমপির বাইরে এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ কম এমন দায়িত্বে বদলি করার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তবে গুরুতর অপরাধপ্রবণ ও অপেশাদারী ভূমিকায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গতানুগতিক ধারার তিরষ্কার, বদলি, জরিমানাসহ বিভাগীয় লঘু শাস্তিতে তেমন কাজ হচ্ছে না। অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যরা এ ধরনের শাস্তির পরোয়া না করেই ঘুষ-দুর্নীতি, গ্রেফতার বাণিজ্য, মাদক ব্যবসায়ী ও পেশাদার অপরাধীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের মাধ্যমে তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে। এ কারণেই সমাজে অপরাধ-অপকর্ম ও মাদকের বিস্তার বেড়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ আইনগত নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পেশাগত নিরপেক্ষতার কথা ভুলে গিয়ে এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হওয়া এবং মন্ত্রী-এমপিদের তল্পিবাহকের ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদেরকে পেশাগত শৃঙ্খলার বাইরে বলে ভাবতে শুরু করেন। এদের কারণে পুলিশের বিভাগীয় চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। পুলিশের দুর্নীতি দমনে এবং পেশাগত শৃঙ্খলা সেবার মান উন্নত করতে এসব এখন চিহ্নিত অন্তরায়। বিশেষতঃ পুলিশের পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও মেধাকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিভাগীয় ব্যবস্থার নামে গুরুতর অপরাধে লঘুদন্ডে কোনো কাজ হচ্ছে না। অতএব, গুরুতর অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যদের বাহিনী থেকে সরিয়ে দিতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।