দেশের প্রবীনতম আলেম শায়খুল হাদীস আল্লামা মোঃ ইউনুছ সাহেব গত ৩রা এপ্রিল ২০১৯ইং তারিখে পরপারে চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ------ রাজিউন।
তিনি চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র ফটিকছড়ি উপজেলার জামেয়া ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
মাদ্রাসার নিজস্ব কবরস্থান ‘মাকবারায়ে হারুনীতে’ তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
বাবুনগর মাদ্রাসার ময়দানে তাঁর জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার মানুষ তাতে অংশ গ্রহণ করেন। জানাযায় ইমামতি করেন হযরত আল্লামা মোঃ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, মুহতামিম বাবুনগর মাদ্রাসা। আল্লামা ইউনুছ সাহেবের জন্ম হাটহাজারী রেলওয়ে ষ্টেশনের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত আলীপুর গ্রামে। তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রথম থেকে জামাতে উলা পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৫০ইং সনে তিনি ভারতের বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ গমণ করেন। সেখানে দাওরায়ে হাদীস, তাফসীর ও উচ্চতর ফনুনাত এর শিক্ষা সম্পন্ন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দাওরায়ে হাদীস পাশ করেন ১৩৭১হিঃ/১৯৫১ইং সনে। ১৯৫৩ইং সনে তিতিন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ইং সাল থেকে ২০১৯ইং পর্যন্ত ৬৬ বৎসর তিনি শিক্ষকতা করেন। প্রথম শ্রেণী থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত সকল দরসী কিতাবের তিনি দরস প্রদান করেন। শিক্ষা বিভাগীয় পরিচালক ও শায়খুল হাদীস হিসেবেও দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশে তিনিই ছিলেন দেওবন্দ ফেরত প্রবীনতম আলেম। শায়খুল ইসলাম কুতবে আলম হযরত মাওলানা সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর জীবিত প্রবীনতম শাগরিদ ছিলেন তিনি। দেওবন্দ থেকে দেশে আসার পর চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আলেম হযরত মাওলানা গোলাম আকবর সাহেবের (রহ.) মেয়েকে শাদী করেন তিনি। আল্লামা মুফতী মোঃ ইউসুফ ইসলামাবাদী (রহ.) ছিলেন মরহুমের ভাইরা ভাই। মুফতী ইউসুফ ইসলামাবাদী (রহ.)ও ছিলেন ফাযেলে দেওবন্দ। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলনের প্রবীন নেতা। হাটহাজারী মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ফতেপুর মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত আল্লামা আবদুল হামিদ সাহেবের (রহ.) কনিষ্ঠ পুত্র মুফতী ইউসুফ ইসলামাবাদী।
একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা মোঃ ইউনুছ আলীপুরী (রহ.)। নিয়মিত মাদ্রাসায় উপস্থিত থাকতেন। অনুপস্থিত থাকতেন না। সময়মত মোতালায়া করে প্রত্যেকটা সবকে উপস্থিত থাকতেন। প্রত্যেক শনিবার সকালে বাবুনগর মাদ্রাসায় চলে আসতেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাড়ি পৌঁছে যেতেন। এর ব্যতিক্রম করতেন না। ছাত্র শিক্ষক সকলে তাকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন। খুব কম কথা বলতেন। মোতালায়ায় মনোযোগী থাকতেন। ভাব গম্ভীর থাকতেন।
ঢাকা জামেয়া কুরআনীয়া আররিয়া লালবাগ মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল আল্লামা হেদায়েতুল্লাহ সাহেব (রহ.) ও চট্টগ্রাম হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল কায়উম সাহেবের (রহ.) নমুনার আলেম ছিলেন তিনি। তাদের মত আদর্শ মানুষ, আলেম তেমন চোখে পড়ে না। আল্লামা সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর মুরিদ ছিলেন তিনি। হযরত মাওলানা শাহ্ আবুল হোসাইন সাহেব (রহ.) তাঁকে ইজাযত দিয়ে বয়আত করাতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি বয়আত গ্রহণে রাজি হননি। লোকদের ফিরিয়ে দিতেন। অন্য বুযুর্গদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। শাহ আবুল হোসেন (রহ.) বলতেন, আল্লামা ইউনুছ ছোটকাল থেকে আদর্শ চরিত্রবান ও পরহেযগার ছিলেন। একজন আদর্শ চরিত্রবান ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
চট্টগ্রামের বিখ্যাত পীর হযরত শাহ আবদুস সাত্তার (রহ.) এর সাথী ছিলেন তিনি। দু’জনের মাঝে ঘনিষ্ঠতা ছিলো। একই সাথে হযরত মাদানী (রহ.) এর খানেকায় অবস্থান করেছেন তারা। আল্লামা ইউনুছ হাটহাজারী মাদ্রাসার মজালিশে শুরার অন্যতম সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি সুয়াবিল তা’লিমুল ইসলাম বালিকা মাদ্রাসার সবক উদ্ভোধন, খতমে বুখারী প্রভৃতি অনুষ্ঠানে তিনি কয়েকবার তশরীফ এনেছেন আমাদের আবেদনে। এ লেখকও মাদ্রাসার শিক্ষকগণকে তিনি হাদীসের এজাযত প্রদান করে ধন্য করেছেন।
আমাদের আবেদনে তিনি আমার ঘরেও তশরীফ এনেছেন আমার ভাই ও বাচ্চা এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য তিনি দোয়া করেছেন। যখনই তার সাথে দেখা করতে যেতাম তিনি অত্যন্ত স্নেহ ও মমতার সাথে কথা বলতেন এবং দোয়া করতেন। তার স্নেহ মমতার কথা ভোলা যায় না।
ইলম ও আমলের দৌলত আল্লাহ পাক তাঁকে দান করেন। তাকবীরে উলার সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন। ঘন্টা শুরু হবার সাথে সাথে ক্লাস শুরু করতেন। ঘন্টা শেষ হবার পর পরই ক্লাস শেষ করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতেন। গোটা বছরে কতদিন সবক হবে, কত পৃষ্ঠা করে পড়াবেন তা আগে থেকেই হিসাব করে রাখতেন। ছাত্রদের পড়ানোই মনে হতো তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ। এতে অবহেলা করতেন না।
জামেয়া ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদ্রাসা ১৯২৪সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ হারুন বাবুনগরী (রহ.)-এর প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম ছিলেন। এ মাদ্রাসার প্রথম শায়খুল হাদীস ছিলেন হযরত আল্লামা মুফতী মোঃ আমিন বাবুনগরী (রহ.)। তিনি হযরত মাওলানা সুফী আজিজুর রহমান সাহেবের পুত্র। তিনি আল্লামা সৈয়দ আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ.) এর শাগরিদ। ২য় শায়খুল হাদীস ছিলেন হযরত আল্লামা ওবাইদুর রহমান সাহেব প্রকাশ মুহাদ্দিস সাহেব (রহ.)। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের ফাজেল, শায়খুল ইসলাম কুতবে আলম আল্লামা সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর বিশিষ্ট শাগরিদ ও খলিফা। তৃতীয় শায়খুল হাদীস ছিলেন যুগের খ্যাতনামা মুহাক্কিক আলেম ও ওলীয়ে কামেল শায়খুল আদব ও শায়খুল হাদীস হযরত আল্লামা ইসহাক গাজী (রহ.)। ৪র্থ শায়খুল হাদীস ছিলেন হযরত আল্লামা মোঃ ইউনুছ সাহেব (রহ.)। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন