সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী থানার অজ পাড়া গাঁ থেকে প্রথম বিভাগে দাখিল পাশ করে ১৯৮২ইং এর শেষার্ধে ভর্তি হলাম আলিম শ্রেণীতে ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকাতে । যেয়ে দেখলাম কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে ১৯৮১ইং মাদরাসা-ই-আলিয়ার দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন। স্বাভাবিকভাবে হাতে পেলাম দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপনের স্মারক গ্রন্থ। আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে ইতিহাসের পাতা উল্টাতে থাকলাম। আহা! ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ইং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্যালকাটা আলিয়া মাদরাসা যার প্রিন্সিপ্যালও ছিলেন নিজেই। ১৯৪৭ইং ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়েছিল দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে। আর সেই ধারায় ক্যালকাটা আলিয়া মাদরাসা বিভাজিত হয়ে পঞ্চাশ হাজার কিতাবাদিসহ টেবিল চেয়ার নিয়ে আসা হলো পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার ঢাকাতে। সদরঘাটে শুরু হলো ঢাকা আলিয়ার শিক্ষাকার্যক্রম ১৯৪৮ইং। পরবর্তীতে বর্তমান অবস্থানে(বকসী বাজার) স্থানান্তরিত হয় মাদরাসা-ই- আলিয়া, ঢাকা। মাদরাসা ও মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড একই বিল্ডিং-এ ছিল। পরবর্তীতে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড পশ্চিম পাশে স্থানান্তর হয়। প্রথম দিন আলিম শ্রেণীর ক্লাশে ঢুকে টেবিলের নীচে হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার। কারণ আমি তখন এতো ছোট ছিলাম যে গোফও উঠেনি এবং সাইজে ছোট হওয়ায় ক্যালকাটা থেকে নিয়ে আসা ঐসব উচু টেবিলে লেখা অত্যন্ত কষ্টকর ছিল আমার জন্য। ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আলিয়া হোস্টেলে জীবন কাটতে লাগলো।
ওস্তাদদের মুখে শুনতে লাগলাম আলিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস গণের স্তুতি। বিশেষভাবে সবার মুখে মুখে ছিলেন সৈয়দ আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেী বারাকাতী (রহ.) কারণ ওনার ছাত্রগণই তখন আলিয়ার শিক্ষকবৃন্দ। ছাত্রদের মুখে মুখে যে সব শায়খুল হাদীস গণের নাম শুনতাম মওলানা ওবাইদুল হক জালালাবাদী (রহ.), মাওলানা মিয়া মুহাম্মদ কাসেমী (রহ.), মাওলানা মাহবুবুল হক (রহ.), মাওলানা ফখরুদ্দীন (রহ.), মাওলানা ওজিহ উদ্দিন প্রমুখ। সে সময় আমাদের আলিমের ক্লাশ হতো দু’ তলায়, তখন কামিলের ক্লাশ হতো নীচ তলায় ও তিন তলায়। আলিয়া হোস্টেল থেকে বের হয়ে একাডেমিক ভবনের করিডোরে ঢুকতেই কোন কোন শায়খুল হাদীসের সামনে পড়ে যেতাম। কাউকে সালাম দেয়ার সুযোগ পেতাম, আবার কেউ কেউ সালাম দেয়ার কোন সুযোগই দিতেন না বরং সালামের উত্তর দিতে বাধ্য করতেন। আমার জীবনে আগে কখনই এমন ওস্তাদের সাক্ষাৎ মেলেনি। মিয়া মুহাম্মদ কাসেমী (রহ.) যাঁকে আমি কখনই আগে সালাম দিতে পারেনি। ভাবছি দু’কদম এগিয়ে গিয়ে সালাম দিবো কিন্তু তার আগেই উনার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতো ”আস-সালামু আলাইকুম”। ঢাকা আলিয়া আমার জীবনটাকেই পাল্টে দিলো। বুঝতে পারলাম মানুষ যত বড় হয়, ততো বিনয়ী ও নম্র হয়। তিনমাস সাইন্সে পড়ার পর সাধারণ বিভাগে পড়ে বড় আলিম হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আবেদন নিয়ে গেলাম হেড মাওলানা ওবাইদুল হক জালালাবাদী (রহ.) এর অফিসে, যেখানে বসা ছিলেন ঐসব শায়খুল হাদীস যাদের কথা বড় ভাইদের মুখে শুনতাম। আমার বুখারীর উস্তাদ শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন জাতজামী (রহ.)ও বসা ছিলেন। সেদিনের ঐ স্মুতি আমার জীবনে কখনো ভোলা সম্ভব নয়। শায়খুল হাদীস ওবাইদুল হক জালাজালাবাদী (রহ.)সহ সবাই আমাকে সাধুবাদ দিলেন আমি আলিম হতে চাই বলে এবং হাত তোলে দু’আ করলেন, আমার জন্য যা ছিল আমাার ওস্তাদগণের শ্রেষ্ঠ উপহার। আমি ভাবতে লাগলাম ঐসব স্বনামধন্য ওস্তাদগণের দারসে বসার সুযোগ কবে মিলবে তখন ঘটনাচক্রে আলিম ক্লাশেই পেয়ে গেলাম শারহুল বেকায়ার উস্তাদ হিসেবে শায়খুল হাদীস ওবাইদুল হক জালাজালাবাদী (রহ.) কে। উনার উর্দু তাকরীর আজও কানে বাজে। ফাযিল শ্রেণীতে পড়াকালীন হারালাম শায়খুল হাদীস মিয়া মুহাম্মদ কাসেমী (রহ.)কে, সড়ক দুর্ঘটানায় চলে গেলেন আল্লাহর সান্নিধ্যে।
আমি ছিলাম বই পোকা, ক্যালকাটা আলিয়ার সেই সব বইগুলো ঘাটছিলাম আর নোট করছিলাম আলিয়ার লাইব্রেরীতে বসে। কোন এক পড়ন্ত বিকেলে ফাযিল শ্রেণীর ফিকহের নোট করছিলাম আরবীতে, পেছন থেকে কেউ একজন আমার পিঠ চাপড়াচ্ছিলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে সালাম দিলাম বটে, চিন্তে পারলাম না,। লাইব্রীয়ান এগিয়ে এসে বললেন উনি খাত্তানী হুজুর। আমি স্তম্ভিত, যার সুনাম সুখ্যাতি ছারছিনা দারুস সুন্নাহ মাদরাসার গন্ডি পেরিয়ে সারা বাংলার জমিনে শায়খুল হাদীস হিসেবে সেই কী না আমার পিঠ চাপড়াচ্ছেন। আমি ভাংগা ভাংগা আরবীতে উনার সাথে কথা বলছিলাম। আমার নোট বুক হাতে নিয়ে প্রশ্ন করলেন ফিকহের সকল উত্তর আরবীতে দিবো কী না? আমি বললাম না’আম, ইনশা আল্লাহ। উনার মুখ থেকে তখন আমার জন্য দোয়া বের হচ্ছিল। আমি শুধু আমিন আমিন বলছিলাম। আমি এখনও ভাবি কী করে সেই সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আমি আদায় করবো যিনি আমার জন্য ওয়ারাসাতুল আন্বিয়ার ধারক ও বাহকদেরকে দোয়ার হাত প্রসারিত করালেন।
ফাযিল পেরিয়ে যখন কামিল হাদীসে ভর্তি হলাম তখন অবসরে চলে গেলেন ওবাইদুল হক জালালাবাদী (রহ.) এবং বায়তুল মুকাররামের খতীব হিসেবে বরিত হলেন আমার উস্তাদ। কামিল হাদীসে পেলাম বাঘা বাঘা সব শায়খুল হাদীস যাদের ক্লাশে বসার বহু দিনের স্বপ্ন ছিল। যাদের অগ্রভাগে ছিলেন মাওলানা ফখরুদ্দীন (রহ.), মাওলানা ওজিহ উদ্দিন, মাওলানা আব্দুর রহীম (রহ.) মাওলানা মাহবুবুল হক (রহ.),মাওলানা আব্দুল লতিফ সিলেটীসহ প্রমুখ। আলিম ক্লাশ থেকেই আমার ক্লোজ বন্ধু ছিলেন কাজী সিরাজ, ফাযিলে যুক্ত হলো বন্ধু হিসেবে আরো একজন খান মুহাম্মদ মুফিজুর রহমান (প্রিন্সিপ্যাল, লাউড়ী রামনগর কামিল মাদরাসা, মনিরামপুর, যশোর।) কামিল হাদীসে পেলাম আরো দু’বন্ধু মো: রুহুল আমীন (সাতক্ষীরা) এবং ড. মুহাম্মদ যাকারিয়া মজুমদারকে(প্রফেসর, আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল ষ্টাডিজ বিভাগ ইবি.)। কাজী সিরাজ একদিন আমাকে বললো আমরা বুখারী শরীফ যদি খতম করতে চাই উস্তাদের সান্নিধ্যে তাহলে ক্লাশের পড়া দ্বারা সম্ভব নয়। আমাদেরকে ক্লাশের বাইরে গিয়ে পড়তে হবে। যাহোক তার প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা দশ বারো জন ঐ সময়কার শ্রেষ্ঠ শায়খুুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন হুজুরকে রাজী করাতে পারলাম এবং শুরু হলো খাতমে বুখারী দারসের মিশন যেখানে আমার প্রিয় বন্ধু মুফিজও সাথী হলো। বাদ মাগরিব উস্তাদ আমাদেরকে সময় দিলেন। কখনও রাত দশটা কখনও রাত একটা এভাবে চলতে থাকলো বুখারী শরীফের তাকরীর। এ খবর চাউড় হয়ে গেলে ক্লাশেই ফুসে ঊঠলেন মাওলানা ওজিহ উদ্দিন (দা:বা) এবং বললেন: আমি তোদেরকে ক্লাশ টাইমের আগেই বুখারী শরীফ পড়াবো। শুরু হলো বুখারীর দারস আলিয়া মাদরাসার বিশাল হল রুমে দুইশত ছাত্রের মধ্যে প্রায় দেড় শতাধিক ছাত্রের উপস্থিতিতে। এ ভাবে মাস খানেক চলার পর ছাত্রদের আগ্রহ কমতে থাকলো ভোর বেলার দারসে। দ্বিতীয় মাসে ছাত্রদের আগ্রহে ভাটা দেখে উস্তাদ ওজিহ উদ্দিন(দা:বা)ও আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। আমরা যারা নিয়মিত হাজিরা দিতাম তারাও বেকায়দায় পড়ে গেলাম, তবে আমরা ১৫/২০জন চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলাম। একসময় উস্তাদ নিজে থেকেই ভোর বেলার হাদীস দারস বন্ধ করে দিলেন। হাদীসে পড়েছিলাম জ্ঞানার্জনে গিবতা বা ঈর্ষা বৈধ কিন্তু জ্ঞান বিতরণেও গিবতা হতে পারে এই প্রথম দেখলাম আমাদের দারসে বুখারীর দুই দিকপালকে(মাওলানা ফখরুদ্দীন (রহ.) ও মাওলানা ওজিহ উদ্দিন (দা:বা) মাঝে)। যাহোক আমরা মাওলানা ফখরুদ্দিন (রহ.) এর দারসে বুখারীতে শরীক হতে থাকলাম। কিছুদিন পর যুক্ত হলো আমার আরেক প্রিয় বন্ধু যাকারিয়া মজুমদার। উস্তাদ ফখরুদ্দিন (রহ.) দীর্ঘ সময় নিয়ে বুখারীর দারস দিতে লাগলেন আমাদেরকে। যতই দিন যেতে লাগলো আমরা অবাক আর বিষ্ময়াবিভূত হতে লাগলাম উস্তাদের তাকরীর শুনে। মনে হতে লাগলো জ্ঞানের সমুদ্র থেকে মণি মুক্তা ছড়াচ্ছেন আমাদের মাঝে। (চলবে)
লেখক : সাবেক সভাপতি, আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক ষ্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন