রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

বৈপ্লবিক চেতনার পথিকৃৎ মাওলানা মুহিউদ্দীন ও তাঁর ‘মদীনা’

প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম
বাংলা ভাষায় যে ক’জন ক্ষণজন্মা মর্দে মুজাহিদ ইসলামের সুমহান আদর্শে দরদি মন নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছানোকে ইবাদত মনে করতেন তন্মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অন্যতম। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। লাখো ভক্তকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি গত ২৫ জুন ২০১৬ মোতাবেক ১৯ রমজান ইফতারের আগ মুহূর্তে মাওলায়ে পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মাহে রমজানের দ্বিতীয় দশকের মাগফিরাতপ্রাপ্তির শেষ দিবসে তিনি পূর্ণ মাগফিরাতপ্রাপ্ত হয়েই আপন রবের সাথে মিলিত হতে গেছেন বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ায় বাংলাভাষার সাহিত্যাকাশে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ হওয়ার কোনো শুকতারা আকাশে নিভু নিভুও জ্বলছে না। আল্লাহতায়ালা যেন আমাদের এই শূন্যতা পূরণ করতে যোগ্য কোনো দরদি ত্রাতা পাঠিয়ে দেনÑকায়মনোবাক্যে এই কামনা করছি।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের অসংখ্য বিশেষণ থাকলেও তিনি মাসিক মদীনার সম্মাদক হিসেবেই মানুষের কাছে সম্যক পরিচিত। ‘মাসিক মদীনা’র নামের সাথে যে নামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তিনি হলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। মাসিক মদীনাকে কল্পনা করলেই পাঠকের মনের আয়নায় ভেসে ওঠে ওই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিটির নাম। তার দক্ষ সম্পাদনায়ই পত্রিকাটি পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষে রয়েছে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ধর্মপ্রাণ মানুষসহ সকল মহলের নিকট একজন পরিচিত মুখ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি এদেশের শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত। ইতিহাসবিদ, আরবি ভাষা বিজ্ঞানী, ধর্মতত্ত্বের গবেষক, বাংলায় সীরাত সাহিত্যের স্থপতি, মোতামারে আলম আল-ইসলামী বাংলাদেশের সভাপতি এবং বিশ্ব মুসলিমলীগ ‘রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অন্যতম সদস্য, বাদশাহ ফাহাদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প মদীনা মুনাওয়ারাহ সৌদিআরব কর্তৃক মুদ্রিত ‘তাফসীরে মারেফুল কোরআন’-এর বাংলা অনুবাদক, বহু গ্রন্থ প্রণেতাসহ তাঁর নানা পরিচয়ের বিশালত্ব থাকলেও মূলত তিনি ‘মদীনা’ সম্পাদক হিসেবেই অধিক সমাদৃত।
তিনিই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সীরাত কর্মসূচির প্রবক্তা। প্রিয়নবী (সা.) ও সর্বস্তরে সুন্নাহ বাস্তবায়নে তাঁর অসংখ্য কর্মসূচি ছিল। তিনিই প্রথম বাংলাদেশে সীরাত সম্মেলনের নামে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চালু করেন। আর ‘মাসিক মদীনা’র প্রতিটি পরতে পরতেই বলতে গেলে সীরাত বিষয়ক লেখাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। তাইতো প্রতিটি লেখার শিরোনামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় মসজিদে নববীর গম্বুজকে। এ যে নবীপ্রেমের এক সার্থক নজরানা।
বাংলা ভাষায় যে ক’টি মাধ্যম ইসলাম প্রচারের সুমহান দায়িত্ব পালন করে আসছে তন্মধ্যে ‘মাসিক মদীনা’ অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের প্রাচীনতম খ্যাত এ বাংলা পত্রিকাটি মাতৃভাষায় দীন ইসলাম প্রচারে ব্যাপক অবদান রেখে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ‘মাসিক মদীনা’ ইসলামী জ্ঞানের এক জীবন্ত রতœভা-ার। দেশ ও জাতির চরম দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে মুসলিম সংস্কৃতির সার্বিক লালন ও বিকাশের লক্ষ্যে ‘মাসিক মদীনা’ প্রতিষ্ঠালাভ করে। এর ক্ষুরধার ও বলিষ্ঠ লেখনী দেশ ও জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। এসব লেখনীর তেজস্বী ভাষা এবং মিনতি বলিষ্ঠভাবে প্রভাব ফেলেছে হুঁশহারা আদম সন্তানকে জাগাতে।
আজ অসংখ্য ধর্মীয় প্রকাশনার বাহারি আয়োজন বাজার জুড়ে। কিন্তু যখন মানুষ ইসলামী তাহজীব তামাদ্দুন শেখার কোনো মাধ্যম পাচ্ছিল না, তখন তারা রানারের লণ্ঠনের মতো হাতের কাছে পেয়েছিল ‘মাসিক মদীনা’। তাই মহানবী (সা.)-এর স্মৃতিধন্য ‘মদীনা’ মানুষের ভালোবাসায় টইটম্বুর হয়েছে। আজো শিক্ষিত মহলের অনেক জানার তৃষ্ণা নিবারণ করে যাচ্ছে ‘মদীনা’।
প্রকাশনার দীর্ঘ অর্ধশতক যাবৎ এ পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ১৯৬১ সালের মার্চ মাসে পত্রিকাটি তার যাত্রা শুরু করে। ধারাবাহিক প্রকাশনার দশ বছরের মাথায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে ১৯৭৩-এর দুর্ভিক্ষের শেষ পর্যন্ত সময়ে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের কারণে এর ধারাবাহিক প্রকাশনায় ছন্দপতন ঘটে। তারপর যে শুরু আর পত্রিকাটিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, কোরআন, হাদিস, কুড়ানো মানিক, জীবনী, বিভিন্ন গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ, সমসাময়িক নিবন্ধ, কবিতাগুচ্ছসহ নানা আয়োজনে সমৃদ্ধ থাকে ‘মাসিক মদীনা’। পত্রিকাটির সমসাময়িক বিষয়ের প্রশ্নোত্তর পর্বটি দারুণ পাঠকপ্রিয়। ইতোমধ্যে ‘মদীনা’ কর্তৃপক্ষ তাদের পঞ্চাশ বছরের দিকনির্দেশনামূলক সুচিন্তিত সম্পাদকীয়গুলো একত্রে সন্নিবেশ করে ‘কালের কণ্ঠ’ নামের ভিন্ন স্বাদের একটি সংস্করণের প্রথম খ- প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় খ-টিও প্রকাশের পথে। কালজয়ী এ সংস্করণগুলো সমকালীন সমস্যা-সম্ভাবনায় বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ ঘটাবে বলে তারা মনে করেন।
‘মাসিক মদীনা’র খ্যাতি উপমহাদেশের ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে আরব, ইউরোপ ও আমেরিকার জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষের হৃদয়েও বহুমাত্রিক প্রতিভার কারণে আসন পেয়েছে। ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা মহাদেশের অসংখ্য রাষ্ট্রে ‘মাসিক মদীনা’র অসংখ্য পাঠক রয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশসহ দেশের বাইরেও ‘মদীনা’ তৈরি করেছে একঝাঁক লেখক। বলতে গেলে ‘মাসিক মদীনা’ই এদেশের ধর্মীয় শিক্ষিতদের সাহিত্যের জগতে এগিয়ে আসার অনুপ্রেরণা। পত্রিকাটির ওয়েব সাইটও রয়েছে (িি.িসধংযরশসধফরহধ.পড়স.নফ)।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আমাদের মাঝে আর নেই। আছে তাঁর রেখে যাওয়া ‘মাসিক মদীনা’ আর তাঁর অসংখ্য শৈল্পিক রচনা। এগুলোকে জীবিত রাখতে এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলেই হয়তো মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে থেকেও পাবেন সাদকায়ে জারিয়া।
য় লেখক : বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন আলোচক; বিভাগীয় প্রধান (হাদীস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন