শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আমরা বৃত্ত থেকে বের হতে পারব কি?

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন প্রত্যক্ষ সৈনিক আমি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখ হচ্ছে আমাদের বিজয় দিবস। ওই দিন অপরাহ্নে, তৎকালীন রমনা পার্কে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তদানীন্তন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। ওই ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত আমাদের ব্যাটালিয়ন (২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) যুদ্ধরত ছিল ডেমরার পাশের বালু নদীর অপর পাড়ে পূর্বগাঁও-পশ্চিমগাঁও এলাকায়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ পাওয়া মাত্রই, আমাদের ব্যাটালিয়ন নিজেদের গুছিয়ে নেয় এবং বালু নদী পার হয়ে ডেমরা হতে ঢাকা শহরগামী রাস্তার ওপর আমরা জমায়েত হই। অতঃপর আমরা হেঁটে হেঁটে ঢাকা শহরে প্রবেশ করি। পুরো ব্যাটালিয়নের সাথে, আমি তৎকালীন ঢাকা শহরের একমাত্র স্টেডিয়ামে এসে পৌঁছাই রাত সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে। তারপর ঢাকায় চাকরি করেছি, অন্যত্র চাকরি করেছি এবং অবসর জীবনের বেশির ভাগ অংশ ঢাকায় থাকছি। গত আট-নয় বছর রাজনীতির কারণে জনগণের পাশে থাকার তাগাদায়, চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কাটাচ্ছি। ঢাকা আর চট্টগ্রাম এমন কোনো আকাশ-পাতাল তফাত নয়। কথাটি দাঁড়াল যে, বাংলাদেশেই ছিলাম, বাংলাদেশেই আছি। আমাদের চোখের সামনেই ঢাকা শহর মহানগরীতে রূপান্তরিত হলো। চোখের সামনেই গলিগুলো সড়ক হলো, নদীগুলো খাল হলো, সুটকেসগুলো হলো কনটেইনার, বাঁশের কঞ্চিগুলো বরাক বাঁশ হলো, তালপাতার টুপিগুলো পাগড়ি হলো, চোরগুলো ডাকাত হলো, নুলা-মাজুরগুলো মাস্তান হলো এবং দেশটা তৈলাক্ত বাঁশ আর বানরের গল্পে রূপান্তরিত হলো।

আজকের বাংলাদেশের জনসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগের জন্ম ১৯৭১ সালের পরে। ১৯৭২ বা ৭৩ সালে ঢাকা শহর কেমন ছিল, এটা তাদের পক্ষে কল্পনা করা মুশকিল ও অসম্ভব। ১৯৭২ সালের মধ্য মার্চ থেকে ঢাকা সেনানিবাসে বাস করেছি। গত ৪৮ বছরে, বেআইনিভাবে বা অযৌক্তিকভাবে বা লোভের বশবর্তী হয়ে বা নিজের প্রভাব অন্যায়ভাবে খাটিয়ে একটি গাছের পাতায়ও হাত দিইনি, এক খÐ মাটি পর্যন্ত অর্জন করিনি। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, কখনো লোভের বশবর্তী হইনি। আমার মতো আরো সহগ্র সহগ্র ব্যক্তি আছেন। কিন্তু আমাদের এই ক্যাটাগরির মানুষগুলোর দোষ হচ্ছে, আমাদের প্রতিবাদের শক্তি নেই, আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ দুর্বল, আমরা কেবল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যায়ভাবে গত ৪৮ বছর ধরে বহু ব্যক্তি, বহু মানুষ, বহু পরিবার সম্পদ অর্জন করেছে। তারা প্রতারণা করেছে; তারা ফাঁকিবাজি ও চুরি করেছে; তারা মিথ্যা বলেছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, তারা পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে। অর্থাৎ চোর-বাটপার ও লুণ্ঠণকারী গত ৪৮টি বছর ধরে নিজেদের মধ্যে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার পরিবেশ রক্ষা করেছে; অথচ যারা তা নয়, তারা নিজেদের মধ্যে কোনো সহমর্মিতা ও সহযোগিতার পরিবেশ রক্ষা করতে পারেনি। এই অবস্থান থেকে কিভাবে উন্নতি করা যায়, সেটি একটি চিন্তার বিষয়। নিজের কল্পনাই দ্বিধাবিভক্ত। একভাগে আছে আশা, প্রত্যয়, সংগ্রাম, প্রতিবাদ। আরেকভাগে আছে নিরাশা, হতাশা, নির্বিকারত্ব, তাচ্ছিল্য, ভবিতব্যে আত্মসমর্পণ। সমস্যা হলো, আমার দৃষ্টিতে পুরো সমাজটিই এ রকম দ্বিধাবিভক্ত। উভয় অংশের মধ্যে দূরত্ব কমানো যায় কিভাবে, সেটা বলা মোটেই সহজ নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র অবস্থায় একটি থিওরি পড়েছিলাম। সেটির নাম ছিল ভিশাস সাইকেল অব পোভার্টি অর্থাৎ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র। পাঠক মেহেরবানি করে অনুসরণ করুন। (এক) সমাজের বেশির ভাগ মানুষের আয় কম, যেহেতু আয় কম সেহেতু এর বেশির ভাগ জীবন ধারণে ব্যয় হয়ে যায় এবং সেহেতু সঞ্চয় কম। (দুই) যেহেতু সমাজের বা দেশের মানুষগুলোর সঞ্চয় কম, সেহেতু বিনিয়োগ করার মতো বা ব্যাংকে জমা রাখার মতো টাকার পরিমাণ কম। (তিন) যেহেতু বিনিয়োগ কম সেহেতু শিল্পের প্রসার কম, ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার কম। (চার) যেহেতু শিল্প বা ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসার কম বা আকৃতি ছোট, সেহেতু সেই শিল্প বা ব্যবসায়-বাণিজ্যে লাভ বা লাভের পরিমাণ কম। (পাঁচ) লাভ কম মানে, ঘুরে ফিরে বিনিয়োগে ফিরে আসার মতো সম্পদ বা টাকার পরিমাণ কম। (ছয়) যেহেতু লাভ কম সেহেতু ব্যক্তিরা নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য খরচ করতে পারে কম। (সাত) যেহেতু উন্নয়নের জন্য খরচ কম হয় সেহেতু শিল্প বা ব্যাবসায়-বাণিজ্যে গুণগত পরিবর্তন হয় কম। (আট) অর্থাৎ একটা কম থেকে দুইটা কম, দুইটা কম থেকে চারটা কম, এ ভাবে কম থেকে কমের যাত্রা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

বর্তমান বাংলাদেশে চিত্র ঠিক উল্টা। (এক) যাদের হাতে ক্ষমতা তারা ক্ষমতা ব্যবহার করে, পরস্পরের সহযোগিতা করে আরো ক্ষমতা অর্জন করছে। (দুই) যাদের হাতে ক্ষমতা, তারা ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পদের মালিক হচ্ছে। (তিন) যাদের হাতে সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারা ক্ষমতা ও সম্পদের যৌথ ব্যবহারে আরো ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে। (চার) যাদের হাতে সম্পদ ও ক্ষমতা, তারা সমাজের দুর্বল অংশের হাত থেকে অবশিষ্ট ক্ষমতা ও সম্পদও কেড়ে নিচ্ছে। (পাঁচ) যাদের হাতে সম্পদ ও ক্ষমতা, তারা অন্যদের ক্ষমতা ও সম্পদকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে এবং সেই ‘অন্য’রা ক্রমান্বয়ে সম্পদ ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছে। (ছয়) যাদের হাতে সম্পদ ও ক্ষমতা তারা নিজেদের সুরক্ষা বাড়াচ্ছে; তাদের চতুর্দিকের প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেদ করার ক্ষমতা দেশের সাধারণ মানুষের নেই।

আমরা যারা এই কলাম পড়ছি, আমরা কি নিজেরাই উপযুক্ত উদাহরণ খুঁজে পাবো না? শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কথা চিন্তা করি। ‘কেলেঙ্কারি’ বললে কম বলা হয়, এটাকে বলতে হবে শেয়ারবাজার লুণ্ঠন; বলতে হবে শেয়ার বাজারে ডাকাতি। যারা সেখানে সম্পদ হারিয়েছে, তারা রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন, তাদের পেশিশক্তি নেই, তাই তাদের সাংগঠনিক শক্তি কম। তাই তাদের প্রতিবাদে ‘ধার’ কম। যারা লুণ্ঠন করেছে, তারা বিবিধ আঙ্গিকে ক্ষমতাসীন। তাই তাদের গায়ে আঁচড় দেয়া কঠিন। আমরা যদি একটু চিন্তা করি তাহলে দেখব, কেমন একটি কাকতালীয় মিল! ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেই একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিছু প্রকাশিত এবং আনুষ্ঠানিক; কিছু অপ্রকাশিত এবং অনানুষ্ঠানিক। অপ্রকাশিত অনানুষ্ঠানিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি ছিল পুঁজি আহরণ এবং সম্পদ গচ্ছিত করা। তাই কী সুন্দর সাজিয়ে শেয়ারবাজারকে নববধূর মতো দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করা হলো। অতঃপর বিয়ের আসর থেকে নববধূকে যদি কেউ অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং শ্লীলতাহানী করে, তাহলে যেমনটি ঘটবে, তেমনই ঘটল শেয়ারবাজার নিয়ে। শেয়ারবাজারের পুঁজি লুণ্ঠিত হলো। বারো বা তেরো বা চৌদ্দো বছর পরে ‘একই নাটকের পুনরায় মঞ্চায়ন।’

২০১০-১১ সালের কথা। পুঁজিবাজার পুনরায় লুণ্ঠিত হলো। বনের হায়েনা নয়, মহানগরের রাজপথের হায়েনাদের ক্ষুধা তাতেও মেটেনি। পুনরায় শেয়ারবাজার লুণ্ঠন শুরু হলো ২০১৯-২০ সালে। লুণ্ঠিতদের কণ্ঠ, সম্পদহারাদের কণ্ঠ, দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। তাদের পাশে কেউ নেই। একবার তদন্ত হয়েছিল; রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের সাহস হয়নি এই তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ করার। তাহলে ক্ষতিগ্রস্তদের, লুণ্ঠনের শিকার যারা তাদের সামনে কী রাস্তা খোলা আছে? আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে অপেক্ষা করা, নিজে রক্তাক্ত বিদ্রোহী হওয়া, নিজে আত্মহত্যা করা? আর কী? আমার মস্তিষ্কে অন্য কোনো পথ আবিষ্কার হচ্ছে না।
অনেকেই আমাকে তিরস্কার করেন; কেন রাজনীতিতে এসেছি? অল্পসংখ্যকই উৎসাহিত করে থাকেন। কারণ, ক্ষমতা ও সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে রাজনীতি এখন একটি গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। রাজনীতি সে গোষ্ঠীর কাছে ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের মাধ্যম মাত্র। সম্পদ ও ক্ষমতা থাকলে মনে হয় মাথার বুদ্ধিও খুলে যায়! সম্পদ ও ক্ষমতা না থাকলে মনে হয় ভালো মানুষও হয়ে যায় প্রতিবন্ধী। সম্পদ ও ক্ষমতা থাকলে কূটকৌশল অবলম্বন ও বাস্তবায়ন সহজ। সম্পদ ও ক্ষমতা না থাকলে, কৌশল শব্দের বানান করতেও মানুষের কষ্ট হয়। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঘটনাটিই ধরুন। যে দু’টি মামলার মাধ্যমে (অরফানেজ ট্রাস্ট এবং চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) তাকে দÐ দেয়া হয়েছে, এর পুরো ঘটনাটি প্রতারণা ও ধাপ্পাবাজি। ওয়ান ইলেভেন সরকার মামলা করেছিল দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে বিরাজনীতিকরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুই নেত্রীর একজন যখন ক্ষমতায় এলেন তিনি একজনকে রাজনীতির ময়দান থেকে দূর করার জন্য এই অস্ত্র বেছে নিলেন। মামলাটিকে তিনি বানালেন রাজনৈতিক অস্ত্র। কিন্তু আমরা সেটা ধরতে পারলাম না। আট বছর পার করে দিলাম আইনি লড়াইয়ে। তত দিনে রাজনৈতিক বীজ, রাজনৈতিক চারা শুকিয়ে মরে একশেষ। বহু লোকের মনে অনেক প্রশ্ন। একটা প্রশ্ন হলো, আমরা কেন প্রতিবন্ধী হলাম? আর একটা প্রশ্ন হলো, আমরা কেন ক্ষমতাসীনদের হাতে দাবার ঘুঁটি হলাম? ২০১৮-১৯-২০ সালের কথাই ধরুন। জাতীয়তাবাদী ঘরানার পূর্ণ রাজনৈতিক শক্তির ফোকাস বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে। তাকে মুক্ত কিন্তু করতে পারলাম না, করতে পারব বলেও মনে হচ্ছে না। কিন্তু মুক্তির জন্য চেষ্টা করতেই হবে। লড়াই এখন একটাই। তাহলো, বেগম জিয়ার মুক্তি। তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অর্ধেকের বেশি যাদের দখলে, তারা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তার অবকাশ পাচ্ছে না। দাবা খেলার বোর্ডে যেমন চেক-মেইট হয়, সরকার আমাদেরও চেক দিয়েছে। আমাদের ব্যস্ত রাখবেই। আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতে থাকবে। বিশ-তিরিশ বা পঞ্চাশ বছর আগের কথা বলছি। গ্রামাঞ্চলে বাড়ির উঠানে শীতকালে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা হতো; আমিও কিশোর বয়সে আনন্দের সাথে ধান মাড়াইয়ের সময় গরুগুলোর পেছনে হেঁটেছি। একটা খুঁটি গাড়া থাকে; গরুগুলো খুঁটির সাথে বাঁধা এবং চক্রাকারে ঘুরতে থাকে; চোখ খোলা থাকলেও বৃত্ত থেকে ছুটতে পারে না। আমরাও রাজনৈতিকভাবে চক্রাকারে ঘুরছি, বৃত্ত থেকে বের হতে পারছি না। পারব কি?

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন