বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

যাকাত দিন, মানবিক সমাজ গড়ুন

প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জালাল উদ্দিন ওমর
ইসলামে নামাজ-রোজার মতোই যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষদের ওপর যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক। আর আর্থিক সচ্ছলতার মাপকাঠি ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতার কোন অবস্থায় যাকাত আদায় করতে হবে সেটা ইসলাম সুস্পষ্ঠভাবে বলে দিয়েছে। কী পরিমাণ যাকাত একজন মানুষকে আদায় করতে হবে সেটাও ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতার ওপর যাকাতের পরিমাণ নির্ভর করে। যাকাতের পরিমাণ নির্ণয়ের ফর্মুলাও ইসলাম বলে দিয়েছে। আর যাকাতের অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হবে, সেটাও ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। যাকাত একটি আরবি পরিভাষা। এর অর্থ পবিত্রতা, প্রাচুর্যতা, ক্রমবৃদ্ধি এবং প্রশংসা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় যাকাত হচ্ছে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ কোনো অসহায় মুসলমানকে দুনিয়াবী স্বার্থ ছাড়া প্রদান করা। যাকাত হচ্ছে অসহায়, অভাবী, অক্ষম এবং সুবিধা বঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্যতা বিমোচনের মূল হাতিয়ার। যাকাত হচ্ছে একটি মানবিক সমাজ গড়নের হাতিয়ার এবং মানবকল্যাণই যাকাতের মূলমন্ত্র। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে একজন মানুষের সম্পদ পবিত্রতা অর্জন করে, আর সেই যাকাতের অর্থ দিয়ে বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধান হয়। যাকাত হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার, যা আদায় করতে ধনী ব্যক্তিটি বাধ্য। মহান আল্লাহ কোরআন শরিফে সালাত আদায়ের সাথে সাথে যাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআন শরিফে তিনি মোট ৩২ বার যাকাত আদায়ের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ এককভাবে ৭ বার আর সালাতের সাথে ২৫ বার, যাকাত আদায়ের কথা বলেছেন। প্রকৃত পক্ষে যাকাত হচ্ছে মুসলমানদের জন্য একটি ফরজ ইবাদত। কিন্তু মুসলিম জাতির দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আজ আমরা ঠিকমত যাকাত আদায় করছি না। এমনকি যারা নামাজ পড়ি, রোজা রাখি তারাও সঠিকভাবে যাকাত আদায় করি না। সঠিকভাবে যাকাত আদায় করলে আদায়কৃত যাকাতের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতো। একদিকে আমরা মুসলমানেরা ঠিকমত যাকাত আদায় করি না, অপরদিকে সেই টাকা সঠিকভাবে সঠিক খাতে ব্যবহৃতও হয় না। এ কারণেই যাকাতের উপকার থেকে সমাজ বঞ্চিত হচ্ছে। তাই আসুন, সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করি এবং যাকাতের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলি।
ঈমান আনার পর ইসলামের বিধাসমূহকে পূর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং পালন করতে হবেÑএটাই ঈমানের শর্ত। আপনি কিছু বিধান পালন করলেন আর কিছু বিধান পালন করলেন নাÑএ রকম সুযোগ কিন্তু ইসলামে নেই। স্বাভাবিকভাবেই নামাজ আদায়ের মতো যাকাতও আদায় করতে হবে। যাকাত আদায়ের পর সে অর্থ যাকাতের অর্থ ব্যয়ের জন্য নির্ধারিত খাতসমূহে ব্যয় করতে হবে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত যাকাত আদায় সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে আমি এখানে কয়েকটি আয়াত বর্ণনা করছি। ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর’ (বাকারা-৪৩)। ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ’ (মুজাম্মিল-২০)। ‘তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর’ (মুজাদালাহ-১৩)। ‘যারা যাকাত দেয় না তাদের সম্পর্কে বলেছেনÑযারা যাকাত দেয় না, তারাই আখিরাতের অস্বীকারকারী কাফির’ (হা-মীম সাজদা-৭)। কোরআন শরিফে আল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত এই কয়েকটি আয়াত থেকে আমরা সহজেই যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমরা মুসলমানেরা যাকাতের গুরুত্ব এখনো সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি অথবা বুঝার চেষ্টা করছি না। এ কথাটি সত্য বলেই আমাদের দেশে মুসলমান সমাজে সঠিকভাবে এখনো যাকাত আদায় হয় না এবং আদায়কৃত যাকাত সঠিকভাবে ব্যয়ও হয় না। যে সমস্ত মানুষের ওপর যাকাত ফরজ হয়েছে, সেই সমস্ত মানুষ যদি প্রত্যেকেই সঠিক পরিমাণে যাকাত প্রদান করতেন এবং সেই যাকাতের অর্থ যাকাতের নির্দিষ্ট খাতসমূহে ব্যয় করতেন তাহলে আমাদের মুসলিম সমাজে কোনো দরিদ্র, বঞ্চিত এবং অসহায় মানুষ থাকত না। মনে রাখতে হবে, যাকাত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিধান। আর এটা হচ্ছে ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের অধিকার। এটা বঞ্চিতদের প্রতি ধনীদের কোনো করুণা বা অনুগ্রহ নয়। আবার এটা দানও নয়। এটা হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবদের এমনই একটা অধিকার, যেটা প্রতি বছর ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের প্রদান করতে বাধ্য এবং সেটা গরিবদের ঘরে পৌঁছে দেয়াটাও ধনীদের দায়িত্ব। এভাবে যাকাত প্রদানকে আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন যাতে একদিকে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা তাদের ধর্মীয় বিধান পালন করবেন, অপরদিকে যাকাতের অর্থ দিয়ে অটোমেটিক্যালি সমাজ থেকে দারিদ্র্যতা এবং সমস্যা দূর হবে। এভাবে যাকাত সিস্টেমের মাধ্যমে ইসলাম সার্বজনীন এবং কল্যাণমুখী অর্থনীতি চালু করেছে, যার মাধ্যমেই কেবল একটি আলোকিত এবং মানবিক সমাজ গড়া সম্ভব।
অর্থের প্রতি মানুষের লোভ আদিকাল থেকেই। মানুষেরা সহজে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অপরের কল্যাণে টাকা-পয়সা খরচ করতে চায় না। তাই অনেকে সঠিকভাবে যাকাতের অর্থ আদায় করেন না। অনেকে মনে করেন যাকাতের টাকা প্রদান করলে সম্পদ কমে যাবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্রটা ঠিক উল্টো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাবার জন্য তা মূলত : আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাই বৃদ্ধি পায় এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত হয়’ (রূম-৩৯)। একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন একজন মানুষ সুদ খায় সম্পদ বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বাস্তবে সুদের কারণে যিনি সুদ খায় তার সম্পদ বাড়ে না। কারণ সুদি সিস্টেমে গরিবের টাকা ধনীদের হাতে চলে আসে। ফলে যারা সুদ প্রদান করে তাদের হাতে টাকা থাকে না, ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। এ অবস্থায় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, সমাজে দারিদ্র্যতা সৃষ্টি হয় এবং সমাজে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ে। অপরদিকে যাকাত আদায়ের ফলে ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের হাতে যায়। ফলে গরিবদের হাতে টাকা থাকে এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল হয়, সমাজে দরিদ্রের সংখ্যা কমে এবং সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্যও কমে। ফলে সমাজে সাম্য সৃষ্টি হয়। এভাবে যাকাত ব্যবস্থার কল্যাণে সমাজ উন্নত হয়। অপরদিকে সুদ গ্রহণের ফলে মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টি অর্জন করে আর যাকাত প্রদানের ফলে মানুষ আল্লাহর সস্তুষ্টি অর্জন করে। এভাবে সুদের কারণে মানুষ ইহকাল এবং পরকাল উভয় অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে যাকাত প্রদানের ফলে মানুষ ইহকাল এবং পরকাল উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা র্অজন করে। যাকাতের অর্থ প্রদানের পর সেই অর্থ আবার যেনতেন খাতে ব্যয় করা যাবে না। কারণ যাকাত প্রদনের আটটি খাত আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন- নিশ্চয়ই সদাকা হচ্ছে (যাকাত পাবে আট প্রকার লোক) ১. ফকির, ২. মিসকিন, ৩. ওইসব লোক যারা সদাকা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত, ৪. ওই সমস্ত কাফির, যাদের অন্তর আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, ৫. দাস আজাদ করা, ৬ ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করা, ৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী এবং ৮. মুসাফিরদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনির্ধারিত। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, তিনি প্রজ্ঞাময় (তওবাহ-৬০)। সুতরাং যাকাতের আদায়কৃত অর্থ সঠিক খাতেই ব্যয় করতে হবে। যাকাত ইস্যুতে একজন মুসলমানের অবস্থান হচ্ছে হয় তিনি যাকাত দিবেন অথবা যাকাত ভোগ করবেন। এ ক্ষেত্রে এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোনো অবস্থান নেই। কারণ যাকাত না দেয়া মানে যাকাত গ্রহণ করা। বিষয়টি একদম সিম্পল। মনে করুন, একজন ব্যক্তির দশ হাজার টাকা যাকাত হলো। তিনি পাঁচ হাজার টাকা যাকাত প্রদান করলেন। যাকাতের বাকি পাঁচ হাজার টাকা নিজের কাছে রয়ে গেল। তার মানে এই টাকাটা তো তিনি নিজেই ভোগ করলেন। সুতরাং যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তিটিই কিন্তু যাকাত ভোগ করলেন, যা মারাত্মক গুনাহের কাজ।
প্রত্যেক মুসলমান ভাইদের প্রতি আমার একটি ছোট্ট আবেদন, আর তা হচ্ছে আপনাদের মধ্যে যাদের ওপর ইসলাম নির্ধারিত যাকাত আদায় ফরজ হয়েছে, তারা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্ধারিত যাকাত প্রদান করুন। এর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর বিধান পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করলেন আবার সমাজ থেকে দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ভূমিকা রাখলেন। তাই অনুগ্রহ করে যাকাত প্রদানে কার্পণ্য করবেন না। আপনি যাকাতের অর্থ দিয়ে একটি যাকাত ফান্ড গঠন করতে পারেন। সেই ফান্ড থেকে যাকাতের টাকা সমাজের অসহায় এবং বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধানের কাজে ব্যয় করুন। প্রতিটি ধনাঢ্য পরিবারের কর্তারা যদি যাকাতের টাকা দিয়ে একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব নেন তাহলে সমাজ খুব সহজেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে যাবে। একইভাবে দেশের প্রতিটি ব্যবসায়ী এবং শিল্প গ্রুপ যদি তাদের তত্ত্বাবধানে একটি যাকাত ফান্ড পরিচালিত করে এবং সেই যাকাত ফান্ডের টাকা দিয়ে সমাজের অসহায় এবং বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে সমাজ আপনা-আপনিই উন্নত হয়ে যায়। দুর্ভাগ্য আমাদের, যাকাত নিয়ে আমরা অনেকে এখন হাসি-তামাশাও করি। বাজারে গিয়ে যখন বিজ্ঞাপন দেখি, যাতে লেখা থাকে- “এখানে যাকাতের কাপড় পাওয়া যায়” তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না যে যাকাতকে খেল তামাশার বস্তুতে পরিণত করে ফেলেছি। আর যে কোনো ব্যক্তি এই যাকাতের কাপড়সমূহ কিনলেই বুঝতে পারবেন, এ কাপড়গুলোর মান কতটা নিম্ন। আমার অনুরোধ, যাকাতের কাপড়ের নামে এ ধরনের কৃপণতা বন্ধ করুন। সরকারের প্রতি আমি সঠিকভাবে যাকাত আদায় এবং তার সঠিক ব্যবহারের জন্য একটি যাকাত মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানাচ্ছি।
ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানব কল্যাণেই ইসলামের মূলমন্ত্র। তাই ইসলাম যার যাবতীয় কর্মই মানব কল্যাণের সাথে সংযুক্ত। মূলত মানব কল্যাণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ইসলামের মূল লক্ষ্য। যাকাত তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আল্লাহ যাকাতকে অবশ্যই পালনীয় ধর্মীয় বিষয় হিসেবে মুসলমানদের ওপর ফরজ করেছেন। অপরদিকে এর মাধ্যমে দারিদ্র্যতা দূরীকরণের স্থায়ী সিস্টেম চালু করেছেন। এর মাধ্যমে গরিবের প্রতি ধনীদের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করেছেন। ফলে সমাজে সাম্য, সম্প্রীতি এবং মানবতা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই যাকাত প্রদান করি। মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও কিন্তু যাকাতের সিস্টেমে গরিবদের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারেন। কারণ এই অর্থ তো মানব কল্যাণেই ব্যয় হবে। আসুন এর মাধ্যমে সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা এবং অভাবকে দূর করি আর মানবিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন