শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

প্রার্থীদের ইভিএম সংশয়

ব্যালট ছিনতাইয়ের সুযোগ নেই : সিইসি

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম | আপডেট : ১২:০৬ এএম, ২৯ জানুয়ারি, ২০২০

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে শঙ্কা ও সংশয়ের শেষ নেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থী, ভোটার ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের মধ্যে। ভোট দিলে কী আদৌ পছন্দনীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট পড়বে কি না, সফটওয়্যারের মাধ্যমে ইভিএম টেম্পারিং করা হবে কি না এমন সংশয় সকল ভোটারদের মাঝে। তবে আগে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেয়া গেলেও ইভিএম দখল করে জাল ভোট কীভাবে দিতে হবে তা নিয়েও সংশয় বিরাজ করছে। কারণ ইভিএম নিয়ে বেশিরভাগেরই জ্ঞান নেই।

জানা যায়, ইভিএমের মূল শঙ্কা হলো, ইভিএমে বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ফল পরিবর্তন সম্ভব। কারণ, ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। অর্থাৎ যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রিন্ট কপি ব্যালট জমা হওয়ার সুযোগ নেই। তাই কারচুপি হলে তা প্রমাণ করা যাবে না। দ্বিতীয় শঙ্কা হল, ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিজের আঙুলের ছাপে ২৫ শতাংশ ভোটারকে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে পারবেন। এই সুযোগটির কারণে কেন্দ্র দখল ও আগের রাতে ভোট দিতে পারার সম্ভাবনা থেকে যায়।

তবে ভোটার, বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থীদের পাশাপাশি সরকারি দল আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীদের মাঝেও কিছু ব্যতিক্রমী শঙ্কা রয়েছে। তা হল- জোর করে কেন্দ্র দখল করলেও কী ভোট দেয়া যাবে? কারণ ইভিএম নিয়ে প্রার্থী, পোলিং অফিসার, পোলিং এজেন্ট কেউই সম্যক ধারণা রাখেন না। যারা কেন্দ্র দখল করবে তাদেরও ধারণা নেই ইভিএমে কীভাবে জাল ভোট দিতে হবে। আগে ব্যালট ছিনতাই করে, সন্ত্রাসীদের দিয়ে ব্যালটে প্রার্থীর মার্কায় সিল মেরে জাল ভোট দেয়া গেলেও ইভিএম মেশিনে কীভাবে জাল ভোট দেয়া যাবে তা নিয়ে কেউই স্পষ্ট নন। আবার ইভিএম বুঝেন এমন শিক্ষিত ভদ্র দলীয় কর্মীকে জাল ভোটের কাজে ব্যবহার করা যাবে কি না তা নিয়েও প্রার্থীদের মাঝে দুঃচিন্তা রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রার্থীরা বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে কি হবে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রায় ৩০ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে ইভিএম নিয়ে তাদের আশা ও শঙ্কার বিষয়ে জানা গেছে। তবে তারা কেউই প্রকাশ্যে এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। ইভিএম নিয়ে বিএনপি সমালোচনা করলেও কাউন্সিলর প্রার্থীরা ইভিএম নিয়ে বেশ খুশি। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও খুশি। কারণ তাদের মতে, যদি ইভিএম সফটওয়্যার নিয়ে মেকানিজম হয় তাহলে মেয়র পদে মেকানিজম হবে। কাউন্সিলর পদে মেকানিজম করা কঠিন কারণ ১২৯টি ওয়ার্ডে সকল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রতীক এক না। এছাড়া গত নির্বাচনে আগের দিন রাতে ভোট দেয়া হয়ে গেলেও ইভিএমে বেশি জাল ভোট দিতে পারবে না কারণ এই মেশিন নিয়ে বেশিরভাগেরই জ্ঞান নেই। এছাড়া এক মেশিনে বেশি ভোট দেয়া হলে সে মেশিন অকার্যকর বা হ্যাং হতে দেখা গেছে বিগত নির্বাচনগুলোতে।

এদিকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মতে, ইভিএমে আরেকটি সুবিধা হল- ভোটাররা ভোট দিতে গেলে অতীতের নির্বাচনে ভোটারদের বলতে দেখা গেছে ‘আপনার ভোট হয়ে গেছে’। কিন্তু এবার সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার তার আঙুলের ছাপ দিয়ে ২৫ শতাংশ ভোট দিলেও কার ভোট দেয়া হয়েছে তা নিয়ে কাউকে বলা যাবে না যে ‘আপনার ভোট হয়ে গেছে’। ভোট চুরি হলেও যদি ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকে তাহলে দিন শেষে দেখা যাবে ১০০ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে। তাতে দুর্নীতির বিষয়টি সবার সামনে চলে আসবে। আর হয়তো প্রভাব বিস্তার নিয়ে মারামারি হলেও ভোট কেন্দ্র দখল করার জন্য মারামারির ঘটনা কমবে।
ইভিএম নিয়ে জ্ঞান না থাকার কারণে নির্বাচনে জয়লাভ করতে ইতোমধ্যে ভিন্ন রকমের জালিয়াতি করতে নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে প্রার্থীরা। ইভিএমের সফটওয়্যার জালিয়াতির জন্য সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের দারস্থ হচ্ছেন প্রার্থীরা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের দুইজন প্রার্থী ভুয়া মেজিস্ট্রেটকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে ধরাও খেয়েছেন। অনেকেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন ভোট চুরিতে সহায়তা পাবার জন্য। এ নিয়ে কয়েকজন কাউন্সিলর ভুয়া আইন-শৃঙ্খলা কর্মকতার কাছে টাকা দিয়ে ধরাও খেয়েছেন কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে কিছু বলতে পারছেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর আপন ছোট ভাই ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, রিটার্নিং কর্মকতার কাছের লোক সেজে সফটওয়্যার জালিয়াতির মাধ্যমে সুনিশ্চিত বিজয়ের লোভ দেখিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। ওই প্রতারক বলেছিল, সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ রিটার্নিং কর্মকতার কাছে। তিনি যদি চান সফটওয়ার জালিয়াতির মাধ্যমে বেশি ভোট দেখিয়ে তার ভাইকে পাশ করিয়ে দেবেন। তারাও বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছেন কিন্তু পরে ওই প্রতারকের আর খোঁজ নেই। লজ্জায় তারা থানায় অভিযোগও করতে পারছেন না।

এদিকে রাতের বেলায় ভোট কেন্দ্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালনে থাকার সময় ভোট জালিয়াতিতে সহায়তার কথা বলে কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর কাছে কুপ্রস্তাব করেছেন থানার ওসি’র কাছের গোপন কর্মকর্তা পরিচয় দেয়া প্রতারক। এসব বিষয় নিয়ে অবশ্য সেই কাউন্সিলর প্রার্থীরা সরাসরি কথা বলতে চান না।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত¡াধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেছেন, ১ ফেব্রæয়ারির নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাছে এমনটি আমি আশা করি না। তাদের অতীতের যে কর্মকাÐ তাতে এই কমিশন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়। সাবেক এই উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেন, নির্বাচন কমিশনের যে সততা ও কর্ম দক্ষতা থাকা উচিত সেটি নেই। ইভিএম ব্যবহারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরো বলেন, অনেক বিশেষজ্ঞই এটি ব্যবহার চাননি। এমনকি বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীও কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন ইভিএম ব্যবহার না করতে।

নির্বাচন কমিশনের ইভিএম প্রকল্পের অপারেশন প্লানিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের অফিসার ইনচার্জ স্কোয়াড্রন লিডার কাজী আশিকুজ্জামানের সই করা এক চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ইভিএমে ভোট সহজ ও নিভর্রযোগ্য। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইভিএমে কারচুপির সুযোগ একেবারেই নেই, তা নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইভিএমে ইন্টারনেটের কোনো সংযোগ নেই। ফলে হ্যাকিংয়ের সুযোগ নেই। আঙুলের ছাপ বা স্মার্ট কার্ড বা ভোটার নম্বর বা জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে ভোটার শনাক্ত করা হবে। ভোটারের ছবি পোলিং এজেন্টরা দেখতে পাবেন। তাই জাল ভোট, ভোটকেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়া, একজনের ভোট অন্যজনে দেওয়া বা একাধিকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। অনুমোদিত কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে ইভিএম চালু করা সম্ভব নয়। এক ভোট কক্ষের জন্য নির্দিষ্ট করা ইভিএম অন্য কোথাও ব্যবহার করার সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, আগে ব্যালট ছিনতাইয়ের সুযোগ থাকলেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) সে সম্ভাবনা নেই। বেইলি রোডে সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ইভিএমে ভোটদান প্রদর্শনী পরিদর্শন শেষে সিইসি আরো বলেন, সবগুলো কেন্দ্রে ডেমোনেসট্রেশন (প্রদর্শন) হচ্ছে যাতে জনগণ যারা জানতে চায় বুঝতে চায় তারা যাতে বুঝতে পারে ভালোই তো হচ্ছে। আগে জাল ভোটের সুযোগ ছিল স্বীকার করে তিনি বলেন, তখন ব্যালট ছিনতাইয়েরও সুযোগ ছিল কিন্তু ইভিএমে সেটা থাকছে না। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব দাবি করে তিনি বলেন, এত পরিশ্রম করি, এত মেধা খাটাই কিসের জন্য? ভোটারের ভোট দিতে পারা নিশ্চিত করার জন্য। ইভিএমের মাধ্যমেই ভোটার নিজের ভোট দিতে পারবে। ইভিএমের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। অনেকেরই ফিঙ্গার প্রিন্ট নিচ্ছে না এর কারণ কি এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, এর দুইটা কারণ হতে পারে একটা হচ্ছে তিনি এই কেন্দ্রের ভোটার না অথবা পাশের বুথের ভোটার। বলেন, সবার হবে না এটা হয়তো দু -একজনের হতে পারে। কারো হাতের রেখা বিলীন হয়ে গেছে বা ডিসপ্লেসড হয়ে গেছে এরকম হতে পারে দুই একজনের।

নির্বাচনী প্রচারণায় একাধিক মারামারির কথা স্বীকার করে নুরুল হুদা বলেন, মারামারি হওয়া খারাপ। মারামারি মানে যদি ক্রিমিনাল অফেন্স হয় তাহলে, থানায় কেস করবে তারা ব্যবস্থা নেবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন