আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মেঘনায় বালু উত্তোলনের মহোৎসবে মেতেছে কয়েকটি প্রভাবশালী মহল। দীর্ঘদিন যাবৎ তারা অবাধে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। এতে ভাঙনের হুমকিতে সেচ প্রকল্পের বাঁধ।
প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত নৌ-যান জব্দ করা হলেও কোনোভাবেই মেঘনার বালু উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না। মেঘনার তলদেশ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে নদীর তীরে দেখা দিয়েছে ভাঙন। মোবাইল কোর্টসহ স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত অভিযানেও বালু উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না। বালু মহাল থাকলেও প্রশাসন দিতে পারছে না ইজারা। এতে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
অব্যাহত বালু উত্তোলনে ১৫ গ্রামের মানুষ নদীভাঙন আতঙ্কে দিনযাপন করছে। এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অনেকের বসতভিটা ও ফসলি জমি। বালুদস্যুদের কবল থেকে ভিটে রক্ষায় প্রতিবাদ করায় বালু ব্যবসায়ী সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকিতে এলাকা ছাড়তে হয়েছে অনেককে। এ অবস্থায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন প্রায় ২৫ গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।
জানা যায়, কুমিল্লার মেঘনা ও নারায়ণগঞ্জের সোনাগাঁও এবং চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলার আশপাশ এলাকায় বালু উত্তোলন আব্যাহত রয়েছে। দিন রাত সমানতালে অসংখ্য অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন ও বিক্রয় চলছে। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার নির্দেশ দেয়া হলেও তা কার্যক্রর হয়নি। বালু উত্তোলন করার কারণে তীব্র ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে চরের আশ্রয়ণ প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ইকোনমিক জোন ও প্রস্তাবিত হাইটেক পার্কসহ চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি।
বিগতদিনে বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ করায় মতলবের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আজহার উদ্দিন খুন হয়েছেন। বালু উত্তোলনকারীদের ধরতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্যকেও প্রাণ দিতে হয়েছে। গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে প্রাণ গেছে আরো দুই জনের।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার আওতাধীন সাতমারা চরেরগাঁও, ভাসানিয়া দড়িচর, সেনেরচর ও চালিভাঙ্গা মৌজার অভ্যন্তরে বালু উত্তোলন না করার জন্য হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকা সত্তে¡ও কয়েকটি প্রভাবশালী বালুদস্যু সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন যাবৎ বালু উত্তোলন করেই যাচ্ছে। উপজেলার চালিভাঙ্গা, রামপ্রসাদেরচর, মহিশারচর, নলচর, ফরাজিকান্দি, সোনাকান্দা এছাড়াও সোনাগাঁও উপজেলার খাসেরচর, ভুরভুরিয়া, ভাটিবন্দর ও সুলতাননগর গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। মালিগাঁও, হাড়িয়া, গোবিন্দি, হাড়িয়া, বৈদ্যেপাড়া, সোনামুই এবং চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলার কয়েকটি গ্রাম নদীতে বিলীন হওয়ার হুমকিতে রয়েছে। মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত আমান অর্থনৈতিক অঞ্চলও রয়েছে হুমকির মুখে।
সরেজমিন দেখা যায়, মৈশারচর, নলচর ও ফরাজীকান্দি এলাকায় রাতের আঁধারে সারি সারি ড্রেজার বসিয়ে মেঘনার বুক চিরে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর তা শত শত ভলগেট, কার্গো ও ট্রলারযোগে বালু ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পেশি শক্তি ব্যবহার করে প্রতিদিন কেটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকার বালু। এলাকার লোকজন জানান, রামপ্রসাদচর গ্রামের মহসীন নামে এক ব্যক্তি ২০১৭ সালের ৯ এপ্রিল নদীভাঙনের কবল থেকে ওই গ্রামগুলো রক্ষা করতে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। পরে ১১ এপ্রিল এক শুনানিতে হাইকোর্ট বালু উত্তোলন না করার জন্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই বালুদস্যু সিন্ডিকেট হাইকোর্টের নির্দেশ তোয়াক্কা না করে বালু উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আবারও হোসাইন মোহাম্মদ মহসীন নামে এক ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। হাইকোর্ট গত ১৭ সেপ্টেম্বর দুটি ইজারা বাতিলসহ আশপাশের এলাকায় বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু এ নির্দেশনা পাওয়ার পর বালুদস্যুরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং ভিন্ন কৌশলে রাতের অন্ধকারে বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখে।
ক্ষতিগ্রস্ত ভাসানিয়া দড়িচরের সুফিয়া খাতুন জানান, সারা রাত বালু উত্তোলন করা হয়। কৃষি জমি নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় অনাহারে জীবন পার করছেন তিনি। বালুদস্যু সিন্ডেকেটের জনৈক ওয়াসীম ও আবদুল লতিফ সরকার গংরা বালু উত্তোলন করছে অভিযোগ করেন এই বৃদ্ধা।
রিট আবেদনকারী মোহাম্মদ মহসীন বলেছেন, বালুদস্যুরা খুবই ভয়ঙ্কর। তারা হাইকোর্টের আদেশ মানছেন না। এ বিষয়ে মেঘনা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কামরুল হাসান জানান, মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাতে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়েছে অনেককে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন