ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে আন্ডারওয়ার্ল্ডের পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রভাব বিস্তারে বেশ চিন্তিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। পুরো ঢাকা শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কাজ করেছেন এবং সন্ত্রাসীদের সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের বেশির ভাগই জয়লাভ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিপক্ষে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন সে মুহূর্তে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা যারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়েছেন তাদের সঙ্গে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যোগ-সাজস থাকা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে দলের ভিতরে বিশ্লেষণ চলছে, এছাড়া ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের অন্যান্য বিষয় নিয়েও দলে আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের আগামী কার্যনির্বাহি সভায় সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং এইসব সমস্যা থেকে উত্তোরণের ফায়সালা করা হবে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সিটি নির্বাচনের দিন বিভিন্ন এলাকার পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজয়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিজয়ের কারণ বিশ্লেষণ এবং দলের পরাজিত প্রার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচনে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি উঠে এসেছে। দলের প্রার্থী এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের যোগ-সাজসের বিষয়টি নিয়ে বেশি চিন্তিত আওয়ামী লীগের নেতারা। বিষয়টি প্রকাশ্যে না আসলেও দলের অভ্যন্তরে এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
আরো জানা যায়, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীদের মনোনয়ন কারা পাবে সে বিষয়েও সন্ত্রাসীরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। এছাড়া দলের কমিটিতে কারা পদ পাবে সে বিষয়েও অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রভাব বিস্তার করে এমন তথ্যও উঠে এসেছে।
দলের নেতাদের বাইরেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সিটি নির্বাচনের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট তৈরী করেছে ইতোমধ্যে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা রিপোর্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ বিষয়ে তারা অবহিত করবেন এবং আওয়ামীলীগের আগামী কার্যনির্বাহি বৈঠকে দলীয় রাজনীতিতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা হবে।
আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, জিসান, সুব্রত বাইন, কিলার আব্বাস, হারেস, মানিক, শাহাদাত, নবী, রাজু, খোরশেদ, প্রকাশ কুমার, বিকাশ, আশিক, ওমর ফারুক কচি, মহি আলম মহিদ, বুদ্দিন, মোবারক, নিজাম, লেংরা শরিফ, ইলিয়াস, নান্নু, কালু, আনোয়ার, ফারুক, শওকত, তপন, খোরশেদ, কামাল, আলমগীর, উজ্জ্বল, তুরান, সান্টু, রুবেল, সাগর, রানা, আলী রেজা খান, অয়ন, ইমরান, হৃদয়, আলমগীর হোসেন, তাপু, ডাকাত সাগর, কালা মামুদ, প্রিন্স মোহম্মদ, রাজু, সুন্দর শরিফসহ অনেক সন্ত্রাসীই এই নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপর ছিল। অনেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী এই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনের দিন এই সন্ত্রাসীরা তাদের লোকজন ও অস্ত্র দিয়ে প্রার্থীদের সহায়তা করেছেন। যেখানে মারামারি করা দরকার সেখানে সন্ত্রাসীদের লোকজন মারামারি করেছেন, যেখানে অপজিট প্রার্থীকে ভয় দেখানো দরকার তাদের লোকজন সে কাজও করেছেন। নির্বাচনের দিন প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে অনেক ওয়ার্ডেই মহড়া দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
আওয়ামী লীগের বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা সূত্র আরো জানায়, ঢাকা উত্তর সিটির উত্তরা অঞ্চলে শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাসের প্রভাব ছিল। বিজয়ী হওয়া একজন বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী ও পরাজিত হওয়া দলের একজন প্রার্থী কিলার আব্বাসের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ রেখেছেন। আর অন্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা যোগাযোগ রাখলেও তেমন ঘনিষ্টতা নেই আব্বাসের সঙ্গে।
মোহাম্মদপুর অঞ্চলে প্রভাব ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী সেন্টু ও নবীর। তাদের সহায়তায় ৩১ নং ওয়ার্ডে জাতীয় পার্টির শফিকুল ইসলাম সেন্টু বিজয়ী হয়েছেন এমন তথ্য রয়েছে আওয়ামী লীগের হাই-কমান্ডের কাছে।
মিরপুর অঞ্চলে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত। এই অঞ্চলে শাহাদাতের রিকুয়েস্ট রেখেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি হয় বলে রাজনীতির মাঠে আলোচনা রয়েছে। শাহাদাতের অনেক শীর্ষ বিভিন্ন কমিটিতে পদে আছেন বলেও দলের তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
এছাড়া ধানমন্ডিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন, শাহজাহানপুরে মানিক ও জিসান, জুরাইন-গেন্ডারিয়াতে উমর ফারুক কচি ও সুমন; যাত্রাবাড়ি ও ডেমরাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম বাড়ি একজন সন্ত্রাসীর প্রভাব ছিল।
এই সন্ত্রাসীদের প্রভাবে ঢাকা দক্ষিণে ১১, ১২, ৪৫, ৪৭, ৫২, ৫৩, ৬৬ নং ওয়ার্ডে এবং ঢাকা উত্তরে ৩, ৬, ১৪, ৩১, নং ওয়ার্ড পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীরা। ঢাকা দক্ষিণে ৪৫ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনিত কাউন্সিলর প্রার্থী হেলেন আক্তার পরাজিত হয়েছেন, বিদ্রোহী শামসুজ্জোহা পাশ করেছেন। হেলেন ইনকিলাবকে বলেন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসান আসকারি, সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম এপোলো প্রকাশ্যে তার বিপক্ষে কাজ করেছেন। নির্বাচনের দিন বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা চালিয়েছেন। কোথা থেকে এসব সন্ত্রাসীরা এসেছে সে বিষয়ে তিনি ভয়ে কোন কথা বলেননি। ৪৭ নং ওয়ার্ডে পাশ করেছেন এক সময়ের আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী শহীদ কমিশনারের মেয়ে শাহানা আক্তার। ৫২ নং ওয়ার্ডের প্রার্থী নাছিম মিয়া নির্বাচনের মাঠে দাড়াতেই পারেননি। পরাজিত হয়েছেন ৫৩ নং ওয়ার্ডের প্রার্থী নূর হোসেন। ১১ নং ওয়ার্ডে হামিদুল হক খান শামীম ও ১২ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম আশরাফ তালুকদারও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের কথা বলেছেন কিন্তু কারো নাম মুখে আনতে চাননি।
যাত্রবাড়ি থানার দুটি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৯ নং ওয়ার্ডে স্বাধীনতার পর কখনো আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়লাভ করেনি। ৪৮ নং ওয়ার্ডে এবার নিয়ে দুইবার আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন আবুল কালাম অনু। এ দুটি ওয়ার্ডসহ ডেমরার কয়েকটি ওয়ার্ডে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাসিন্দা একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর প্রভাব ছিল।
ঢাকা সিটি নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের তৃণমূল রাজনীনিতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রভাব বিস্তার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলের সভাপতিমন্ডলীর প্রভাবশালী সদস্য কর্ণেল (অব.) ফারুক খান ইনকিলাবকে বলেন, আমরা কিছু কিছু বিষয়ে শুনেছি। বিস্তারিত খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছি। এছাড়া সিটি নির্বাচনের সকল বিষয়ে আওয়ামী লীগের আগামী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহি সংসদের সভায় আলোচনা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন