বই পড়া যে শিক্ষিত মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, সে বিষয়ে দেশে-বিদেশে কারোরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। একালেই অনেক বড় লোকের বাড়িতে মেহগনির তাকে বই সুন্দর করে সাজিয়ে রাখাকে অনেকে কটাক্ষ করেন কিন্তু বাড়িতে বই রাখা যদি ফ্যাশন হয় তবে সেই ফ্যাশনকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেব। আজকের পৃথিবীতে একথা সবাই জেনে গেছে, যে জাতি যত বেশি বই পড়ে সে জাতি তত বেশি শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান। এ কথা তো জানা যে, কাব্যচর্চা এক নির্মল আনন্দ। বৃহত্তরভাবে বলা যায়, সাহিত্যচর্চা না করলে সে আনন্দ থেকে মানুষ বঞ্চিত থাকে। তার ভেতরকার সুকুমার বৃত্তিগুলো বিকশিত হতে পারে না। মানবিকতার প্রতি টান রুদ্ধ হয়ে যায়।
বই পড়ার জন্য পৃথিবীর সব দেশেই লাইব্রেরি গড়ে ওঠে। পাড়ায় পাড়ায় যেমন লাইব্রেরি থাকে তেমনি বৃটিশ মিউজিয়াম বা আমাদের ন্যাশনাল লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগার কিংবা এশিয়াটিক সোসাইটির মতো বৃহৎ লাইব্রেরিও গড়ে উঠে। ব্যক্তিগতভাবে বই কিনে নিজের মতো লাইব্রেরি গড়ে তোলা অনেকেরই শখ। এই লাইব্রেরিকে অধ্যাপক আবুল ফজল বলেছেন, ‘মনের হাসপাতাল’। তিনি আরো বলেছেন, এর স্থান স্কুলের অনেক ওপরে। এ কথা সহজে জানা, পাশ হওয়া মানে শিক্ষিত হওয়া নয়। আর সুশিক্ষিত মানেই স্বশিক্ষিত। মনকে সতেজ রাখে সাহিত্য পাঠ। স্বাভাবিকভাবেই নতুন প্রজন্মকে গ্রন্থাগারমুখী করে তোলা দেশের সচেতন নাগরিকদের একটা সামাজিক কর্তব্য। আমরা একালে বড়রা এ কাজটা সঠিকভাবে করতে পারি না বলেই আমাদের বংশধররা ক্রমান্বয়ে গ্রন্থবিমুখ হয়ে উঠেছে। অনেকে বলবেন, এজন্য টেলিভিশনের একটা ভূমিকা আছে। কথাটা পুরো সত্য নয়, কোনো শিশুকে শৈশব থেকে গ্রন্থবিমুখ করে তুললে কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাধ্য নেই যে তাকে গ্রন্থবিমুখ করে তোলে। ইউরোপে দেখেছি, দু’তিন বছর বয়সের শিশু নার্সারি স্কুলে যায়। সেখানে খেলার ছলে বর্ণ পরিচয় ও শব্দ ভান্ডার বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় রং আর তুলি। ইচ্ছে মতো তারা রং আর তুলি নিয়ে কল্পনার বর্নময় রুপগুলো কাগজে তুলে ধরতে থাকে। সপ্তাহে দু’দিন তাদের একটা করে বই বাড়িতে আনতে দেওয়া হয়। এ ভাবে বুক সেলফ থেকে বই নিতে নিতে এমন একটা অভ্যাস তৈরি হয় যে, আগে নেওয়া কোনো বই শিশু কখনো বাড়ি নিয়ে যায় না। যে শিশুর বর্ণ পরিচয় হয়নি সে বই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কি করবে, একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবলেই বোঝা যাবে সপ্তাহে দু’বার করে বাড়িতে বই নিয়ে যাওয়া একটা অভ্যাস তৈরি করে দেয়। শিশু বাড়িতে ছবি সম্বলিত গল্পের বইগুলো বাবা-মাকে দিয়ে পড়িয়ে গল্পরস আস্বাদ করে থাকে। পড়তে শিখলে আগ্রহে নিজেই বই পড়তে থাকে । এই পঠন অভ্যাস দ্বারাই একটা জাতি তৈরি হয় ধীরে ধীরে।
আমাদের শৈশব-কৈশোর বয়সে বই পড়া নিয়ে আমরা যে সব কান্ড করতাম, সে কথা জানলে একালের অভিভাবকরা আর্তনাদ করবেন। আমরা জ্যামিতির বই’র তলায় ‘বিদুষীভার্যা’ লুকিয়ে চিৎকার করে জ্যামিতি মুখস্থ করার ছলে উপন্যাসটি শেষ করার চেষ্টা করতাম। কারণ, পরের দিন সকালে সে বই ফেরত দিতে হবে। আমাদের কলেজ জীবনে প্রথম ক্লাসেই আমাদের জিজ্ঞেস করা হতো, আমরা সে সময় কী বই পড়ছি? কেউ বলত রাজসিংহ, কেউ গোরা, কোনো ছেলে যখন বলে উঠতে সে ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’ পড়ছে তখন খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠতেন অধ্যাপক। আমরা এখন যখন ছেলে-মেয়েদের অনার্স ক্লাসে কী বই পড়ছে, জিজ্ঞেস করি তখন প্রায় সবাই ফ্যালফ্যাল করে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। জানা যায়, সে সময় নষ্ট হবে ভেবে জীবনে একটা গল্পের বইও পড়েনি। এই দোষটা ছাত্র-ছাত্রীদের নয়, সম্পূর্ণভাবে শিক্ষকদের, কিছুটা বাবা-মায়ের। আমরা তাদের শৈশব থেকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দিইনি।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উল্টোভাবে চলে। ইংরেজ দেশ ছেড়ে চলে গেছেঅনেক আসে; কিন্তু ক্রমান্বয়ে ইংরেজিয়ানা আমাদের চেপে ধরেছে। এখন তো ইংরেজি না-শিখলে উচ্চ সমাজে মেলামেশা করা যায় না। ঔপনিবেশিক শিক্ষার একবারের খারাপ একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমাদের জাতি চলছে এখনও। এর মধ্যেই কী বিপুল উদ্দীপনায় গ্রামে, গঞ্জে, শহরে প্রচুর বইমেলা হচ্ছে। শহরে আন্তর্জাতিক বইমেলায় ছোটোখাটো স্টলে যে পাঠকরা আসে তাঁরা সাহিত্যে নিবেদিত পাঠক- দূর গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসে তাঁরা। কিন্তু পাশের ছোটোবড়ো ইংরেজি বইর স্টলগুলোতে ভিড় করে যে উজ্জ্বল তরুন-তরুণীরা তারা আমাদের বাঙালি ঘরের ছেলেমেয়ে অথচ ভাষা হিসেবে বরণ করে নিয়েছে ইংরেজি ভাষাকে। দেশের উজ্জ্বল ছেলে-মেয়েরা যদি এভাবে বাংলা সাহিত্যের বাইরে চলে যায় তাহলে একটা জাতির সাহিত্য বেড়ে ওঠা ভবিষ্যতে খুবই কষ্টকর, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। শিশুদের বই কেনার একটা ধুম চলে এসব মেলায় কিন্তু পিতা-মাতারা কেনেন নানা কমিক্স আর ছবিতে গল্প জাতীয় কাহিনির চিত্রিত বই। শিশুর কল্পনা শক্তি বাড়ে রূপকথা অ্যাডভেঞ্চারের ভ্রমণ জাতীয় বইতে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, এ জাতীয় বইতে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে তাদের আগ্রহ তৈরি করে দেওয়া। তার ফল হবে এই যে, ধীরে ধীরে তারা সাহিত্য পাঠ করে এমন এক আনন্দের সংকেত পেয়ে যাবে যে, কখনই আর বই না পড়ে থাকতে পারবে না।
প্রয়োজনের তাগিদে ইংরেজি ভাষা শেখা দরকার। কিন্তু ইংরেজি শেখার অর্থ নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা বা বর্জন করা নয়। নিজের ভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, তাকে কখনই ভালো নাগরিক বলা যায় না। ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় নিজের মাতৃভূমির জন্য ভালোবাসা। আজ যে আমাদের দেশের উজ্জ্বল ছেলে-মেয়েরা বিদেশে পড়তে গিয়ে, চাকরি করতে গিয়ে আর দেশে ফিরতে চায় না, সে তো শুধু অর্থের লোভ নয়, দেশের প্রতি ভালোবাসার কোনো টান থাকে না বলেই এমনটা হতে পারে। আশ্চর্য এই যে, দেশে বাবা-মা পড়ে রয়েছে সেই মাতৃভূমির প্রতি কোন দায়বদ্ধতা এই ভালো ছেলে-মেয়ের দল কখনই অনুভব করে না। সাহিত্য যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করে তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলেই এমনতর ঘটনা আজ ঘরে ঘরে ঘটে যাচ্ছে। বই পড়াকে যদি শখ হিসাবেও দেখা হয়, তবে বলতে হবে সেটা মনুষ্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ। বই পড়ে ইহলৌকিক নানা জাতীয় লাভের আশা করা দুরাশা। এমনকি বই পড়লেই মানুষ নীতিবাদী হয়ে একটা সমাজকে রক্ষা করবে এমনও নয় তবে বইপড়ায় থেকে যে সংস্কৃতি তৈরি হয় সেটা মানুষকে রুচিবান করে তোলে। এই রুচিশীলতা মানবজীবনের অন্যতম কৃত্য ।এই রুচির অভাবের জন্যই আমরা এত অসহিষ্ণু হয়ে পথে-ঘাটে, পার্লামেন্টে যে কান্ড করি তা শুধু হাস্যকরই নয়, রুচিহীন বলেই তা একটা জাতির জীবনে গভীর সংকট সৃষ্টি করে। বইপড়ায় অভ্যস্ত হলে একজন মানুষ যে আনন্দের আস্বাদ পাবে, তা তার মনকে শুধু সজীব করে রাখবে, তা নয় ভালবাসতে শেখাবে প্রকৃতিকে, মানুষকে, তার নিজের কল্পনা শক্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। ফলত জগতকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে নতুন সৃষ্টিময় জগৎ তৈরি করতে উৎসাহিত হবে সেই পাঠক। এইভাবে একটা জাতির জীবনে বইপড়া সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠলে সেই জাতি শুধু সহনশীল রুচিশীল হয়ে উঠবে তাই নয়, পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে বহুল পরিমাণে সাহায্য করবে।
বইপড়া জ্ঞানচর্চার সহায়ক, বিশ্বজগতের নানা আবিষ্কার, মানুষের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তনের রোমাঞ্চকর কাহিনী যে-কোন পাঠককে মানব প্রজাতি সম্পর্কে আগ্রহী করে তার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনে তাঁকে তুলবে রুচিশীল এক বিশিষ্ট নাগরিক রূপে। এইভাবে বইপড়া শুধু একজন পাঠককে জ্ঞানী বা প্রাজ্ঞ করে তুলবে না, তাকে এমন এক জগতের সঙ্গে পরিচিত করবে, যে জগৎটি সারা বিশ্বের রুচিশীল মানুষের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
একজন রুচিশীল নাগরিক হিসাবে আমাদের সামাজিক দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের মধ্যে বইপড়ার আকর্ষণ তৈরির সমস্ত সুযোগ সৃষ্টি করে রাখা। এটা শুধু মুখের ভাষাতে হবে না, নিজেদের তা করে দেখাতে হবে। আর তখনই আমরা আমাদের একটা সুস্থ-সবল জাতি হিসাবে গড়ে তুলতে পারব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন