শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

ভাষাসৈনিক আলী তাহের মজুমদার : তার খবর কেউ নেয় না

কামাল আতাতুর্ক মিসেল : | প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০০ এএম

 বয়স একশর বেশি। পরনে খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এক হাতে ছড়ি আরেক হাতে কিছু খুচরা টাকা ও ছোট একটি শপিং ব্যাগ। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে জনাকীর্ণ সড়কে এরকম যে লোকটি গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যান তার নাম আলী তাহের মজুমদার। মানুষ তাকে ভাষা সংগ্রামী হিসেবেই চেনে। তাকে দেখলেই বলে-ঐ দেখ ভাষা সৈনিক যায়।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা হয়ে মুক্তিযুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছেন। দেশকে আলী তাহের মজুমদার ভালোবাসেন। তবে সব ছাপিয়ে ভাষাসৈনিক হিসেবেই বেশি পরিচিতি তার। কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড়ের মানুষ প্রতিদিনই তাকে দেখেন। আলী তাহের মজুমদারের জন্ম ১৯১৭ সালের ১২ ফেব্রæয়ারি (সনদ অনুযায়ী)। বাবার নাম চারু মজুমদার, মা সাবানী বিবি।
চাঁদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর কুমিল্লা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন আলী তাহের মজুমদার। ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৫ সালে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অষ্টম পাঞ্জাব আর্মিতে যোগ দিলেও সাত-আট মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ছুটিতে এসে আর ফিরে যাননি। তখন তার বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তাকে বাঁচাতে কুমিল্লার তখনকার জেলা প্রশাসক আবদুল মজিদ ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ের মোজাফফর হোসেন ভূঁইয়া ফেনীতে জাপানি বাহিনীর বোমায় আলী তাহের মজুমদার নিহত হয়েছেন বলে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেন। ওই সময়ে নেতাজি সুভাষ বসুর গুপ্তচর হিসেবে কাজ শুরু করেন আলী তাহের মজুমদার। কুমিল্লা ও ফেনীতে বিলি করেন সুভাষ বসুর লিফলেট।
১৯৪৬ সালে নোয়াখালীতে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা হলে কুমিল্লায় সা¤প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী কমিটি গঠন করেন। ১৯৪৬ সালের কলকাতার এক চা দোকানে আড্ডা দেয়ার সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয় আলী তাহের মজুমদারের। তার মুখেই আলী তাহের জানতে পারেন বাংলা ভাষাভাষী এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ করার কথা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বোসের পরিকল্পিত বাংলা ভাষাভাষী এলাকা নিয়ে স্বাধীন সরকার গঠনের জন্য কাজও করেছেন আলী তাহের। দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি তোলেন কুমিল্লার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। আলী তাহের মজুমদার তখন আরএসপি (রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি) করতেন। ওই অফিসে বসে ভাষা আন্দোলনের লিফলেট-পোস্টার লিখে বিলি করতেন। কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও বিপ্লবী অতিন্দ্র মোহন রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চালাতেন আন্দোলন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রæয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলি হলে তা অতীন রায়ের মাধ্যমে জানতে পারেন। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কুমিল্লার মানুষ। আলী তাহের মজুমদার মিছিল করার সময় কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জে গ্রেফতার হন।
১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় আরএসপি (রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি) দলের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় আলী তাহের মজুমদারকে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার অনুরোধ করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর কথায় মুগ্ধ হন আলী তাহের। যোগ দেন আওয়ামী মুসলিম লীগে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে তিন বছর কারাগারে ছিলেন। ১৯৫৬ সালে কারামুক্ত হয়ে কুমিল্লা সদর থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে চলে যান ভারতে, অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি সেনারা তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। রাজনীতি করেই জীবন কেটেছে তার।
যেমন আছেন এখন : সংসারে অভাব। ফেব্রæয়ারি মাসে লোকে যা কিছু খোঁজখবর করে। আর বছরের বাকি সময় কোনোভাবে কেটে যায়। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান কান্দিরপাড়ে পরিচিত এক হোমিও ওষুধের দোকানে। থাকেন কুমিল্লার দুর্গাপুর ভ‚মি অফিসের কাছে। নাতনি নাজমা আক্তারের বাড়িতে। তার দুই স্ত্রী আকলিমা আক্তার ও সূর্যবান বিবি অনেক আগেই মারা গেছেন। কষ্টের কথা কাউকে বলতে চান না। তবে না বললেও হয় না। বলেন, আমার তেমন জায়গাজমি নেই, জমানো টাকাও নেই। একটা নাতি আছে, বেকার। দীর্ঘদিন অনেকের কাছে বলেকয়েও কাজের ব্যবস্থা হয়নি। তার একটা চাকরি দরকার। এভাবে চলতে কষ্ট হয়। আরো বললেন, সারাটা জীবন রাজনীতি করলাম। কংগ্রেস করলাম, আওয়ামী লীগ করলাম। নেতাজি সুভাষ বসুর সঙ্গে চললাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চললাম। এখন আর কেউ খবর নেয় না।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
** হতদরিদ্র দীনমজুর কহে ** ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৭:৩৯ পিএম says : 0
ভাষাসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা আলী তাহের মজুমদার কে ভক্তিপুর্ন সালাম যানাচ্ছি।এ ভাবে অনেকেই আছেন যারা দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে অবদান রেখেছেন।অথচ রাষ্টের কোন দাখ্খিন্য পায়নাই।বর্তমান সরকার এসব অবদান রাখা লোকদের মুল্যায়ন করেছে।করবেন।।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন