বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। জাতির জনক। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছিলেন। এই স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু ধ্বংসপ্রায় দেশটির পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে নানা কল্যাণমুখী পরিকল্পনা করেন। মাত্র ১০ মাসের মধ্যে তিনি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেন, যার ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের এসব আদর্শের বিপরীতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন নেতা, যাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের সম্পর্ক গভীর। ঘাতকের বুলেট তাঁকে হত্যা করলেও সে সম্পর্ক মোটেই ছিন্ন করতে পারেনি। যত দিন যাচ্ছে, ততই ইতিহাসে তাঁর নাম সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের যে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয় তার ধারাবাহিকতায় বারবার বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ যে সাম্প্রদায়িকতার কবর দিয়েছিল, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলে ১৫ আগস্টের পর থেকে।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমি ছিলাম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম কেমন চলছে, কীভাবে করলে ভালো হবে, কোথায় কি সমস্যা আছে, সেসব বিষয় নিয়ে আমরা (তৎকালীন নগর সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক সুলতান, কোষাধ্যক্ষ আমি আর কে চৌধুরীসহ অনেকে) নিয়মিত সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতাম। তারি ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৪ আগষ্ট সন্ধ্যার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে তার সঙ্গে বসি। আলোচনা হয় দীর্ঘসময় ধরে। পূর্বের ন্যায় বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেদিনও ছিল খুব প্রাণচাঞ্চচলতা। বঙ্গবন্ধুর কখনই ভাবেনি তার করা স্বাধীন বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকরা তার ঘনিষ্টজনদের উপর নির্যাতন চালায়। আমাকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার আমার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাকে ৬ মাস আত্মগোপনে থাকতে হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পুরোধা এবং বাংলাদেশের জাতির জনক। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব নামে বেশি পরিচিত এবং তার উপাধি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। সেরা মুক্তি সংগ্রামী, সেরা রাষ্ট্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দায়বোধ তাকে মহীরূহে পরিণত করেছিল। ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই বিপন্ন করতে চেয়েছিল। তাই বলছি পিতৃ হত্যার অভিশাপ থেকে জাতি আজও মুক্ত নয়।
আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, সর্বোপরি সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ৭ মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে যে ভাষণ দেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তা হয়ে আছে এক চির অ¤øান মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অমল ধবল স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তিনি এবং কেবল তিনিই তাঁর বলিষ্ঠ সুযোগ্য সুদৃঢ় অনমনীয় অকুতোভয়, সর্বোপরি দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দিয়েছেন স্বাধীনতার সুবর্ণ তোরণে। এর পরের ইতিহাস সবার জানা এবং তা বিশ্ববাসীরও অজানা নয়। ভাষণটি ইতোমধ্যে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের স্বীকৃতি পেয়েছে। কেবল একটি ভাষণ ‘ওয়ার্ল্ডস ডুকমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির গৌরব বহির্বিশ্বে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু অমর। তার মৃত্যু নেই। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্র থাকবে যতদিন ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকবেন পৃথিবীর বুকে স্মরণীয় হয়ে। তাইতো কবি বলেছেন, যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন