খুব ভোরে নাশতার পরই রওয়ানা হই আজিজান আলী রামিতানী রহ.-এর জায়গায়। লোকেরা বলে, এখানে তার কবর। কিতাবে পড়েছি, তাঁর কবর খাওরিজমে। সম্ভাবত এটি বেশি প্রামাণিক। এখানে কবর না হলেও এটি তার এক সময়ের আস্তানা ছিল। তিনি আল্লাহর মহব্বতে এতই মগ্ন ও নিমজ্জিত ছিলেন যে নিজেকে নিজে নাম দিয়েছিলেন আজিজান। মানে আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা। আসল নাম আলী। এই বান্দা প্রথম যখন বুখারার এই গ্রামে এসেছিলেন তখন এই অঞ্চলের মানুষ একটি ভাইরাসজনিত চর্ম রোগে আক্রান্ত ছিল।
সব মানুষের এ অবস্থা দেখে তিনি খাস ইবাদত-বন্দেগীর সময় আল্লাহর কাছে দুআ করলেন, আল্লাহ যেন এলাকার সব মানুষকে এই পরীক্ষা থেকে মুক্তি দান করেন। পর দিন তার দিলে আল্লাহ তাআলা কিছু লতাপাতা দিয়ে একটি গায়ে লাগানোর ওষুধের ধারণা ঢেলে দিলেন। ওষুধের ফর্মুলাটি তার দিলে ইলক্বা করলেন। আলী আগে কোনো দিন গাছ-গাছড়া চিনতেন না। কিন্তু মুরাকাবার হালতে একটি ঘোরের ভেতর তিনি কিছু ওষুধ তৈরি করে ফেললেন। প্রথম পরীক্ষা করা হলো তার এক ভক্তের ছোট্ট বালিকার ওপর।
কিছু সময়ের মধ্যেই মেয়েটি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। এরপর ধীরে ধীরে এ ওষুধ এলাকার আবালবৃদ্ধবণিতা ব্যবহার শুরু করল। সবাইকে আল্লাহ সুস্থ করে দিলেন। মানুষ শায়খের আস্তানাকে নাম দিলো, আরামে তন। এরপর গোটা গ্রামটির নাম হয়ে গেল আরামে তন থেকে রামেতন। সেখান থেকেই রামিতান। শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চলের মানুষকে রামিতানী খেতাব দেয়া শুরু হলো। বুযুর্গদের জীবনীগ্রন্থে খাজা আলী রামিতানী আজিজানের বিস্তারিত জীবনী পাওয়া যায়। তার অনেক কবিতাও সুফিদের সমাজে প্রচলিত আছে।
আমরা তার সে জায়গাটি ঘুরে ফিরে দেখলাম। ফেরার পথে গ্রামের বাড়ি-ঘর চোখে পড়ল। সব বাড়ি একই ডিজাইনের। রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত একটি লোহার রডের তৈরি মাচার মতো। অনেকটা বিয়ে বাড়ির গেট যেমন থাকে। গেটের পর থেকে বাড়ির মূল গেট পর্যন্ত লোহার মাচা। উপরে আঙুরের লতা। পুরনো আঙুরের গাছ। মূল গাছটি অনেক মোটা হয়ে আছে। গেট ও মাচা লতায় লতায় ছাওয়া। মৌসুম ছিল না বলে আঙুর চোখে পড়েনি। ড্রাইভার বলল, মে মাসে যদি আসেন তাহলে এ দেশের প্রতিটি বাড়ির সামনেই দেখতে পাবেন বাগানের মতো আঙুর ঝুলে আছে। আঙুর গাছের এই ১৫-২০ হাত জায়গা হচ্ছে প্রবেশদ্বার।
এ পরিমাণ জায়গা দু’পাশে লম্বা করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখানে কিছু আপেল গাছ, কিছু অন্য শাক-সবজি আর দুয়েকটা হলেও গোলাপ গাছ। গোলাপ ফুল অনেক দেখেছি। কিন্তু আপেল আঙুর ছিল না। এরপর লোহার গেটওয়ালা বাড়ি। গেটের ভেতরে দেখা যায় গৃহপালিত কোনো না কোনো পশু। ভেড়া দুম্বাই বেশি। পাশে বস্তায় কোনো খাদ্য-শস্য অথবা সার, বীজ, পশুখাদ্য। একই সাথে হয় ট্রাক্টর কিংবা সেচের যন্ত্র রাখা আছে।
কোনো কোনো বাড়িতে এ জায়গাটিতে ব্যক্তিগত গাড়ি রাখা। দু’পাশে থাকার ঘর। ভেতরে এক টুকরো উঠান। একটু দূরে বাউন্ডারি ওয়াল। এক সাথে দু-চার-দশটি বাড়ি হলেও সব একই প্যাটার্নের। সমাজতান্ত্রিক যুগের রীতিতে এমন বাড়ি-ঘর অনুমোদিত ছিল। জায়গা নষ্ট না করার এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ গৃহস্থির সুবিধার্থে উজবেকরা এ নিয়মটি এখনও ধরে রেখেছে।
অন্য এক জায়গায় যাওয়ার পথে দেখলাম, বহুতল বিশিষ্ট এক ভবন নির্মিত হচ্ছে। প্রজেক্টটি মনে হয় কোনো কমার্শিয়াল ভবনের। নির্মাতারা চার পাশে যে নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়েছে সেই স্টীলের গায়ে ইংরেজি হরফে বড় করে লেখা, দস্ত ব কার, দিল ব ইয়ার। দেখে ভালো লাগল। ইংরেজি হওয়ায় পড়তেও পারলাম। এই শহরের অন্যতম বিখ্যাত সন্তান ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দের অমূল্য বাণী এটি। যার অর্থ, হাত থাকবে কাজে ব্যস্ত আর অন্তর থাকবে আল্লাহর যিকিরে মগ্ন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন